বৃহস্পতিবার, ২২ জুন, ২০২৩ ০০:০০ টা

দৃষ্টি আজ হোয়াইট হাউসে

মোদি-বাইডেন হবে বৈঠক, মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট কর্মকর্তা বললেন, বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে ভারতের অবস্থান নিজস্ব

প্রতিদিন ডেস্ক

দৃষ্টি আজ হোয়াইট হাউসে

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির তিন দিনের যুক্তরাষ্ট্র সফর শুরু হয়েছে। তিনি আজ হোয়াইট হাউসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে একান্ত আলোচনায় বসবেন। কূটনৈতিক সূত্রগুলোর মতে,  এ আলোচনায় এশিয়া এবং দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনৈতিক বিষয় গুরুত্ব পাবে। একই সঙ্গে গুরুত্ব পাবে ভারতের প্রতিবেশী বাংলাদেশ প্রসঙ্গও। ফলে দুই রাষ্ট্রনায়কের আলোচনার দিকে উৎসুক হয়ে আছে বাংলাদেশসহ এশিয়ার রাজনৈতিক পক্ষগুলো। এদিকে দুই নেতার বৈঠকের পাশাপাশি রয়েছে নৈশভোজ ও সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন। মোদির সম্মানে দেওয়া জো বাইডেনের এ নৈশভোজ ও সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মুহাম্মদ ইমরানকেও আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। এটি দুই নেতার আলোচনার সঙ্গে বাংলাদেশ প্রসঙ্গটি বিশেষভাবে গুরুত্ব পাওয়ার ইঙ্গিত বলেই কূটনৈতিক সূত্রগুলো ধরে নিয়েছেন। খবর : বিবিসি, ডয়েচে ভেলে, ভোয়া, এনডিটিভি, আলজাজিরা

প্রাপ্ত খবর অনুযায়ী, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি গত মঙ্গলবার দিল্লি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশে রওনা হন। রাত ২টা নাগাদ ওয়াশিংটনের অ্যান্ড্রুস এয়ারফোর্স বেসে নামেন। সেখানে একদল ভারতীয় বংশো™ূ¢ত মার্কিনি তাঁকে স্বাগত জানান। তিনি গতকাল টুইটারের কর্ণধার ও বিদ্যুচ্চালিত গাড়ি টেসলা কোম্পানির মালিক ইলন মাস্কের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এ বিষয়ে পরে বিশ্বের অন্যতম ধনী ইলন মাস্ক জানান, মোদি তাঁকে ভারতে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। মাস্ক জানান, সম্ভবত তিনি মোদির আমন্ত্রণ রক্ষা করতে আগামী বছর ভারতে যেতে পারেন।

মোদির তিন দিনের যুক্তরাষ্ট্র সফরে ঠাসা কর্মসূচি রয়েছে। এসব কর্মসূচির মধ্যে দুই নেতার একান্ত আলোচনায় বাংলাদেশসহ অঞ্চলিক ভূরাজনীতির বিভিন্ন বিষয় উঠে আসতে পারে। এরই মধ্যে বাংলাদেশ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান প্রশ্নে নরেন্দ্র মোদি কথা তুলবেন আঁচ করে ২০ জুন মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টে আয়োজিত এক প্রেস ব্রিফিংয়ে জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের (এনএসসি) স্ট্র্যাটেজিক কমিউনিকেশন্স পরিচালক অ্যাডমিরাল জন কার্বি বলেছেন, বাংলাদেশে ‘অবাধ ও সুষ্ঠু’ নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে ভারতের অবস্থান কী হবে, সে বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো মন্তব্য নেই। এ নিয়ে ভারতের অবস্থান একান্তই তাদের নিজস্ব।

সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশের বিষয়ে আমি মনে করি, ভারত সরকার বাংলাদেশের সঙ্গে তার দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের কথা বলতেই পারে। আমরা এরই মধ্যে বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য আমাদের আকাক্সক্ষা স্পষ্ট করে দিয়েছি। আমাদের ভিসানীতিতে এমন ব্যক্তিদের ভ্রমণ সীমিত করার উদ্যোগ নিয়েছি, যারা বাংলাদেশের নির্বাচন ক্ষতিগ্রস্ত করবে। তাই আমি শুধু আমাদের কথাই বলতে পারি। আমাদের অবস্থান খুব স্পষ্ট। তবে ভারত সরকার তাদের দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করতেই পারে।’

এদিকে দিল্লি ও ঢাকার কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছেন, ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন চুক্তির দিকে আঞ্চলিক পক্ষগুলোর নজর যতটা নিবদ্ধ রয়েছে, ততটা নজর রয়েছে বাংলাদেশেরও। দেশের জাতীয় সংসদের নির্বাচন ‘সুষ্ঠু, অবাধ ও শান্তিপূর্ণ’ করে তুলতে যুক্তরাষ্ট্র তাদের নতুন যে ভিসানীতি ঘোষণা করেছে, যা নিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতি এ মুহূর্তে সরগরম, আশা করা হচ্ছে সে বিষয়ে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করবেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। কারণ বাংলাদেশের নির্বাচন কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্রের নিরন্তর চাপ, নতুন ভিসানীতির মধ্য দিয়ে যা প্রতিফলিত; তা বাংলাদেশ তো বটেই, ভারতকেও খানিকটা অস্বস্তির মধ্যে ফেলেছে। ওই নীতির রূপায়ণ, দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতিতে তার সম্ভাব্য প্রভাব এবং নির্বাচনকেন্দ্রিক আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার প্রশ্ন ভারতের স্বস্তি ও চিন্তার কারণ। যুক্তরাষ্ট্রের এ নয়া ফরমান নিয়ে ভারত ও বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক মহল পরস্পরের সঙ্গে একাধিকবার কথা বলেছে। বাংলাদেশকে এ বিষয়ে আশ্বস্তও করা হয়েছে যে, আসন্ন সফরে এ নিয়ে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী মোদি অবশ্যই মতবিনিময় করবেন।

সম্প্রতি ভারতের উত্তর প্রদেশের বারানসিতে অনুষ্ঠিত জি২০ সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন। সেখানে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শংকরের সঙ্গে তাঁর একান্ত বৈঠক হয়। নির্বাচন, নতুন ভিসানীতি, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও যুক্তরাষ্ট্রের ‘চাপ’ নিয়ে দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মধ্যে বিস্তারিত কথা হয়। এরপর যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভানের সঙ্গে গত সপ্তাহে নয়াদিল্লিতে বৈঠক করেন ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল। ওই বৈঠকে তাঁকে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের এমন কোনো ব্যবস্থা নেওয়া ঠিক হবে না, যাতে ভারতের স্বার্থ বিনষ্ট ও আঞ্চলিক ভারসাম্য নষ্ট হয়। ভারতের এই স্পষ্ট অভিমত বাংলাদেশকে জানিয়েও দেওয়া হয়েছে। কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছেন, এ অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রকে ভারত বোঝাতে চায়, ভারসাম্য কিংবা আঞ্চলিক সুস্থিতি নষ্ট হয় এমন কিছুর জন্য বাংলাদেশকে জোরাজুরি করাটা ঠিক হবে না। এ আলোকে বাইডেনের সঙ্গে আলোচনায় চীনের দিকে বাংলাদেশের বেশি মাত্রায় ঝুঁকে পড়া যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত কারও পক্ষে মঙ্গলজনক নয়, সে কথাটিও বোঝানো হবে। তা ছাড়া ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের নিরাপত্তা ও সুস্থিতির প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্র যতটা উদ্বিগ্ন, ভারতও ততটাই। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের গুরুত্ব অসীম। সেই গুরুত্ব অনুধাবন করে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও সম্প্রতি এ বিষয়ে তাঁর দেশের নীতি ঘোষণা করেছেন। ওয়াকিবহাল মহলের মতে, সংগত কারণেই প্রধানমন্ত্রী মোদি যুক্তরাষ্ট্রকে বোঝাবেন আঞ্চলিক স্বার্থে হাসিনার ক্ষমতাসীন থাকার অর্থ কী। তাঁর ক্ষমতাসীন থাকা না-থাকার ওপর আঞ্চলিক বিচ্ছিন্নতাবাদী ও ধর্মীয় মৌলবাদী শক্তির মাথা চাড়া দেওয়া-না দেওয়ার প্রশ্নটি যে গভীর সম্পর্কযুক্ত, সে কথা বাইডেনকে মোদি জানাবেন। এই সঙ্গে বোঝাবেন এমন কিছু করা উচিত হবে না, যাতে আঞ্চলিক অপশক্তি উৎসাহ পায়।

দিল্লির কূটনৈতিক সূত্রগুলো মনে করছেন, বাংলাদেশে গণতন্ত্র স্বাভাবিকভাবে প্রসারিত হবে, নির্বাচন সুষ্ঠু ও অবাধ হবে, আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা নষ্ট হবে না এবং যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের স্বার্থ রক্ষিত হবে এমন একটা বাতাবরণ সৃষ্টি হওয়া জরুরি। তাঁরা মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসানীতি ঘোষণার পর সে দেশের স্থানীয় নির্বাচনগুলো নির্বিঘ্নে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এটা সুলক্ষণ। জাতীয় নির্বাচনও এমন সুষ্ঠুভাবে ও শান্তিতে হবে। বাংলাদেশের লক্ষ্যও যে তা-ই, সে কথা গত শুক্রবার দ্ব্যর্থহীনভাবে জানিয়ে দেন ভারতে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার মুস্তাফিজুর রহমান। নয়াদিল্লিতে ‘ফরেন করেসপনডেন্টস ক্লাব’ আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘নির্বাচন সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও অবাধ করতে বাংলাদেশ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখতেও তা জরুরি।

আজকের মোদি-বাইডেন বৈঠক নিয়ে কূটনৈতিক সূত্রগুলোর ভাষ্য, মোদির সম্মানে দেওয়া জো বাইডেনের নৈশভোজ এবং সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মুহাম্মদ ইমরানের আমন্ত্রণ পাওয়া তাৎপর্যপূর্ণ। এ বিষয়ে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত এবং কূটনীতিক মেজর জেনারেল (অব.) শহীদুল হকও গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘মোদির সম্মানে দেওয়া নৈশভোজে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের আমন্ত্রণ পাওয়া গুরুত্বপূর্ণ। এর ভিতরে হয়তো কিছু থাকতে পারে। তবে যা-ই থাকুক তা সাইডলাইনে বলেই আমার মনে হয়।’ আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘আমেরিকার সঙ্গে ভারতের এমনিতেই সম্পর্কের একটা টানাপোড়েন আছে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে। তারপর ব্রিকস সম্মেলন নিয়ে আমেরিকা অস্বস্তির মধ্যে আছে। কারণ ওটা আরও শক্তিশালী হয়ে আসছে। সেই প্রেক্ষাপটে হয়তো বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে কথার মধ্যে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ আসতে পারে।’ সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মো. তৌহিদ হোসেন মনে করেন, ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চাচ্ছে বাংলাদেশে ঠিকমতো ভোট হোক। ভোটে যাতে কোনো কারচুপি না হয়। ভারত কী চাচ্ছে? ভারত চাচ্ছে এখানে আওয়ামী লীগ সরকার কন্টিনিউ করুক। কারণ ভারতের জন্য আওয়ামী লীগ সুবিধাজনক। চীনের ব্যাপারে দুই দেশের স্বার্থের সমতা আছে। চীন এ অঞ্চলে যাতে আধিপত্য বিস্তার না করতে পারে এটা দুই পক্ষই চায়। চীনের ব্যাপারে তাদের স্বার্থের ঐকমত্য আছে, বাংলাদেশ সরকারের ব্যাপারে নেই। সুষ্ঠু নির্বাচন হলে তো সরকার পরিবর্তন হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র এ ব্যাপারে সিরিয়াস। কারণ এরই মধ্যে তারা বেশ কিছু ব্যবস্থা নিয়েছে। এখন যখন দ্বিপক্ষীয় বৈঠক হবে, তখন মতপার্থক্যের বিষয় নিয়েও কথা হবে। তাই বাংলাদেশ প্রসঙ্গও আসতে পারে।’

পর্যবেক্ষকরা বলছেন, পর্দার আড়ালে অনেক কিছু হতে পারে। তবে নানা কারণে তা প্রকাশ্যে আসার সম্ভাবনা খুব ক্ষীণ। তা ছাড়া বাংলাদেশকে ভারতের চোখে দেখার নীতি থেকে যুক্তরাষ্ট্র অনেক আগেই সরে এসেছে। সবকিছু তারা নিজেদের চোখে বিচার-বিশ্লেষণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বিপরীতে এ অঞ্চলে চীনকে বাগে রাখতে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ভারতের প্রয়োজনও প্রশ্নাতীত।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও ফার্স্ট লেডি ড. জিল বাইডেনের আমন্ত্রণে মোদির যুক্তরাষ্ট্র সফরে আজ তাঁকে একাধিকবার হোয়াইট হাউসে আপ্যায়িত করা হবে। নরেন্দ্র মোদির সম্মানে বাইডেন দম্পতি শুধু বিশেষ নৈশভোজই দিচ্ছেন না, প্রেসিডেন্ট তাঁর সঙ্গে একান্তে ও প্রতিনিধি পর্যায়ে একাধিকবার বৈঠকেও বসবেন। যুক্তরাষ্ট্রে নরেন্দ্র মোদির তিন দিনের এ সফরের দিকে নজর রয়েছে    গোটা বিশ্বেরই।

সর্বশেষ খবর