রবিবার, ২৫ জুন, ২০২৩ ০০:০০ টা
মস্কোর রাস্তায় রাস্তায় ট্যাংক সেনা, কঠোর শাস্তির হুঁশিয়ারি পুতিনের

বিদ্রোহে টালমাটাল রাশিয়া

প্রতিদিন ডেস্ক

বিদ্রোহে টালমাটাল রাশিয়া

ট্যাংক অস্ত্রশস্ত্র সজ্জিত ওয়াগনার বাহিনীর সদস্যরা রাশিয়ার রোস্তভ শহরের রাস্তায় -এএফপি

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ যখন নতুন বিশ্বযুদ্ধের আশঙ্কা তৈরি করে চলেছে, তখন অপ্রত্যাশিতভাবে রুশ সেনাবাহিনীর পক্ষে অবস্থান করা ভাড়াটিয়া ওয়াগনার বাহিনী বিদ্রোহ করে বসেছে। এর জেরে বিদ্রোহী বাহিনীর মস্কোমুখী অগ্রাভিযান শুরু হলে রুশ হেলিকপ্টার বহর তাদের ওপর হামলা চালিয়েছে। এদিকে মস্কোসহ গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানগুলোয় ট্যাংক সেনা অবস্থানের খবর পাওয়া গেছে। এ ছাড়া রুশ প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন বিদ্রোহীদের আত্মসমর্পণ, নয়তো কঠোর পরিণতির হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। প্রাপ্ত খবর অনুযায়ী, পরিস্থিতি বিবেচনায় কোনো কোনো অঞ্চলের বাসিন্দাদের ঘরে থাকতে বলা হয়েছে। এদিকে মস্কোতেও আজ সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। সর্বশেষ আরেক খবরে বলা হয়েছে, এক ঘোষণায় ওয়াগনার গ্রুপের প্রধান রক্তপাত এড়াতে মস্কো অভিমুখে অভিযান থেকে তার যোদ্ধাদের ফেরত আসার নির্দেশ দিয়েছেন। বিবিসি, রয়টার্স, আলজাজিরা, স্পুৎনিক, তাস, এএফপিসহ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোর খবর অনুযায়ী, ওয়াগনার বাহিনীর প্রধান ইয়েভগেনি প্রিগোজিন হঠাৎই পক্ষ ত্যাগ করে রুশ বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরুর ঘোষণা দিয়েছেন। একই সঙ্গে তিনি রাশিয়ার রাজধানী দখলেরও হুমকি দিয়েছেন। এক ভিডিওবার্তায় তিনি জানান, এরই মধ্যে তিনি তার বাহিনী নিয়ে দক্ষিণ থেকে রাজধানী মস্কোর দিকে রওনা হয়েছেন।

মস্কো থেকে খবরে বলা হয়েছে, গতকাল রাশিয়ার দক্ষিণাঞ্চলের শহর রোস্তভ-অন-ডনের একটি সেনা সদর দফতরের কাছাকাছি বিকট বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে। বিকালে এ বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়। আরটিতে প্রচার করা এক মিনিটের একটি ভিডিও ক্লিপে দেখা গেছে, ঘটনাস্থল থেকে অনেক লোক পালিয়ে যাচ্ছে। আরেক খবরে বলা হয়, রাশিয়ার একাধিক সামরিক হেলিকপ্টার বিকালে বিদ্রোহী ওয়াগনার সেনাদের একটি কাফেলার ওপর গুলি চালিয়েছে। কাফেলাটি একটি ট্রাকে সেনা ও কমপক্ষে একটি ট্যাংক নিয়ে ভোরোনেজ শহরের পাশ দিয়ে মস্কোর উদ্দেশে এগিয়ে যাচ্ছিল। এদিকে রাশিয়ার ভোরেনেজ অঞ্চলের একটি তেলের ডিপোয় আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে। দেশটির যে দুটি শহরের সামরিক স্থাপনা ওয়াগনার বাহিনী দখলে নিয়েছে বলে মনে করা হয়, তার মধ্যে একটি হলো ভোরেনেজ। সেখানের আঞ্চলিক গভর্নর আলেকজান্ডার গুসেভ বলেছেন, আগুন নেভাতে শতাধিক কর্মী কাজ করছে। এদিকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা গেছে, তেলের ডিপোটি থেকে ব্যাপক কালো ধোঁয়া বের হচ্ছে।

প্রাপ্ত খবর অনুযায়ী, ইউক্রেন-রাশিয়ার দীর্ঘ সময়ের যুদ্ধ হঠাৎ ভিন্ন পথে ঘুরে গেছে। এতদিন রাশিয়াকে সমর্থন করা ওয়াগনার গ্রুপ হঠাৎই পাল্টে গেছে। ইউক্রেনীয় বাহিনীর বিপক্ষে লড়াইয়ে রুশ সেনাদের সমর্থনের বদলে এবার রুশ বাহিনীর ওপরই হামলা করছে তারা। এর মধ্যেই রাশিয়ার দক্ষিণাঞ্চলের একটি সামরিক সদরে দফতরে ওয়াগনার-প্রধান ইয়েভগেনি প্রিগোজিনকে দেখা গেছে। দক্ষিণাঞ্চলীয় রোস্তভ-অন-ডন এলাকার সামরিক দফতরে প্রবেশ করেছেন তিনি। এমনকি গ্রুপটির পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, ইউক্রেন সীমান্তের কাছে অবস্থিত ওই শহরের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে তারা। একটি ভিডিওতে তাকে বলতে শোনা গেছে, রুশ প্রতিরক্ষামন্ত্রী সেরগেই শোইগু এবং জেনারেল ভ্যালেরি গেরাসিমভ তাদের সঙ্গে দেখা করতে না এলে তার সেনারা শহর অবরোধ করবে এবং মস্কোর দিকে অগ্রসর হবে। এদিকে রুশ প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়েছেন এবং বিদ্রোহীদের নির্মূলে ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলেছেন। তিনি তাৎক্ষণিকভাবে বিদ্রোহী গোষ্ঠীকে আত্মসমর্পণেরও নির্দেশ দিয়েছেন।

এর আগের খবর অনুযায়ী, গতকাল সকালে টেলিগ্রামে পোস্ট করা এক বার্তায় ওয়াগনার গ্রুপের প্রধান ইয়েভগেনি প্রিগোজিন রুশ সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে তার বিদ্রোহের কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘ওয়াগনার গ্রুপের ভাড়াটে সেনাদের সবাই এখন মরতে প্রস্তুত। আমরা সবাই মরতে প্রস্তুত। আমার বাহিনীর ২৫ হাজার সেনা মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত আছে। রাশিয়ার জনগণের জন্য এ উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।’ প্রিগোজিন উল্লেখ করেন, তার দল এরই মধ্যে রোস্তভ-অন-ডনের গুরুত্বপূর্ণ সামরিক স্থাপনার নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে এবং রুশ প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই শোইগু এবং ভ্যালেরি গেরাসিমভের সঙ্গে তাকে দেখার অনুমতি না দেওয়া হলে তিনি তার বাহিনী নিয়ে মস্কোর দিকে ১ হাজার মাইল পদযাত্রা করে আগ্রসর হবেন।

প্রিগোজিন দাবি করেন, রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের পেছনে ক্রেমলিন বিভিন্ন যুক্তি দেখালেও সেগুলো রুশ সেনাবাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তাদের মিথ্যাচার ছিল। মিথ্যা যুক্তি দিয়ে রাশিয়া ইউক্রেনে আগ্রাসন চালিয়েছে। রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সমাজ ও প্রেসিডেন্টকে প্রতারিত করার চেষ্টা করেছে। তিনি বলেন, ‘তারা আমাদের একটি গল্প বলার চেষ্টা করেছে যে ইউক্রেন ন্যাটোর সঙ্গে জোট বেঁধে আমাদের আক্রমণ করার পরিকল্পনা করছে।’ তিনি রুশ প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই শোইগু এবং শীর্ষ জেনারেল ভ্যালেরি গেরাসিমভকে ‘অযোগ্য’ উল্লেখ করে বলেন, ‘শোইগু মার্শাল হতে পারেন, তিনি হিরো পদক পেতে পারেন, কিন্তু ইউক্রেনকে নিরস্ত্রীকরণ বা ডিনাজিফাই করার জন্য যুদ্ধের প্রয়োজন ছিল না। যুদ্ধের প্রয়োজন ছিল অভিজাত শাসক শ্রেণিকে আরও ধনী করতে, যারা ইউক্রেনের দনবাস অঞ্চলের বাণিজ্যিক সম্ভাবনা নিয়ে সন্তুষ্ট নন। আসল লক্ষ্য ছিল (ইউক্রেনের) সম্পদ ভাগাভাগি।’ প্রিগোজিন অবশ্য প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনের সমালোচনা করেননি। উল্লেখ্য, ওয়াগনার বাহিনীর নেতৃত্বে থাকা প্রিগোজিন রুশ বাহিনীর সহায়তায় ইউক্রেনীয় শহর বাখমুত দখল করেছিলেন।

রোস্তভ অঞ্চলে কারফিউ : রাশিয়ার দক্ষিণাঞ্চলের রোস্তভে গতকাল ভোর থেকে বিভিন্ন সড়কে সাঁজোয়া যান নিয়ে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। এইসঙ্গে রাশিয়ার ভাড়াটে ওয়াগনার গ্রুপের প্রধান ইয়েভগেনি প্রিগোজিন ‘বিদ্রোহ ঘোষণা করে দক্ষিণ সীমান্ত অঞ্চলে প্রবেশ করেছেন’ এমন খবরে রোস্তভের বাসিন্দাদের নিজ বাড়িতে থাকার আহ্বান জানায় রাশিয়া কর্তৃপক্ষ। রোস্তভের গভর্নর ভ্যাসিলি গোলুবেভ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বলেন, ‘আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো বাসিন্দাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছু করছে। আমি সবাইকে শান্ত থাকতে বলছি। স্থানীয়দের নিজ ঘরে থাকার জন্য বলছি।’ খবরে বলা হয়, বিদ্রোহের খবরে দেশটির বিভিন্ন অঞ্চলে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। মস্কোর মেয়র সের্গেই সোবিয়ানিন বলেন, ‘ভাড়াটে ওয়াগনার গ্রুপের প্রধান দেশের সামরিক নেতৃত্বের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণার পর রাশিয়ার রাজধানীতে সন্ত্রাসবিরোধী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। রোস্তভ ও লিপেটস্ক অঞ্চলেও নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। এরই মধ্যে কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা সংস্থা এফএসবি সশস্ত্র বিদ্রোহের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছে।’ এদিকে পর্যবেক্ষকরা বলছেন, প্রকৃত অর্থে ওয়াগনারপ্রধান ইয়েভগেনি প্রিগোজিন রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েছেন। তিনি মস্কোকে তার বাহিনীর ওপর মারাত্মক ক্ষেপণাস্ত্র হামলার জন্য দায়ী করে প্রতিশোধ নেওয়ার কথাও প্রকাশ করেছেন। যেমন ওয়াগনার গ্রুপের প্রধান অভিযোগ করেছেন, রাশিয়ার সেনারা তার কোম্পানির বহুসংখ্যক যোদ্ধাকে হত্যা করেছে। এ হত্যাকান্ডে জড়িত ব্যক্তিদের দায়ী করে তাদের বিচারের আওতায় আনার জন্য তিনি মস্কোয় তার যোদ্ধাদের নিয়ে মার্চ করার হুমকি দিয়েছেন। অন্যদিকে রুশ সরকার তার অভিযোগকে মিথ্যা বলে প্রত্যাখ্যান করেছে এবং বেআইনি তৎপরতা বন্ধের আহ্বান জানিয়েছে। ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ বলেছেন, প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন পরিস্থিতি সম্পর্কে সজাগ রয়েছেন এবং প্রয়োজনীয় সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

রাশিয়ায় বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা : রাশিয়ায় বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে ওয়াগনার বাহিনী। রুশ এ ভাড়াটে বাহিনী এতদিন ইউক্রেনের বিপক্ষে যুদ্ধ করে আসছিল। কিন্তু হঠাৎ গুরুত্বপূর্ণ বাহিনীটি রুশ কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধেই অবস্থান নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ভ্রমণকারীদের সতর্ক করে জানিয়েছে, রাশিয়াজুড়ে বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়তে পারে। মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, রাশিয়ার রোস্তভ অঞ্চলে সামরিক উত্তেজনা দেখা দিয়েছে, যা ছড়িয়ে পড়তে পারে পুরো দেশটিতে। তা ছাড়া রাশিয়া থেকে যুক্তরাজ্যে ফ্লাইট পরিচালনা করার সুবিধাও এ মুহূর্তে নেই বলে জানানো হয়েছে। একই সঙ্গে রাশিয়া ভ্রমণে বিরত থাকারও আহ্বান জানানো হয়েছে। এদিকে যারা রাশিয়াকে বিভক্ত করার চেষ্টা করছে, তাদের শাস্তি পেতে হবে বলে সতর্ক করেছেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন। তিনি অনিবার্য শাস্তির হুমকি দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, রাজধানী মস্কো এবং অন্য কয়েকটি অঞ্চলে এখন সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান চলছে।

আত্মসমর্পণ করবে না ওয়াগনার যোদ্ধারা : রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ও সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহ ঘোষণা করা ভাড়াটে বাহিনী ওয়াগনার গোষ্ঠীর প্রধান ইয়েভগেনি প্রিগোজিন জানিয়েছেন, তার যোদ্ধারা আত্মসমর্পণ করবে না। এক টেলিগ্রামে প্রিগোজিন বলেন, ‘রুশ প্রেসিডেন্ট বড় ধরনের ভুল করছেন। মাতৃভূমির সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার ক্ষেত্রে প্রেসিডেন্ট বড় ভুল করছেন। আমরা মাতৃভূমির প্রতি দেশপ্রেমী। আমরা লড়াই করেছি এবং লড়ছি। তাই আমরা প্রেসিডেন্ট, এফএসবি বা অন্য কারও অনুরোধে আত্মসমর্পণ করব না।’

বিদ্রোহীদের দমনে চেচেন নেতার হুঁশিয়ারি : চেচেন নেতা রমজান কাদিরভ বিদ্রোহী গোষ্ঠী ওয়াগনার বাহিনীকে ফিরে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। একই সঙ্গে তিনি বিদ্রোহীদের দমন করার হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, রুশ প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনের কথামতো আমরা কাজ করব।

একহাত নিলেন জেলেনস্কি : ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেছেন, ‘শয়তান নিজেরাই নিজেদের ধ্বংস করার পথ বেছে নিয়েছে। নিশ্চিতভাবেই দুর্বল হয়ে পড়ছে রাশিয়া।’ টেলিগ্রাম বার্তায় দেওয়া বক্তব্যে তিনি সরাসরি পুতিনের নাম উল্লেখ না করলেও বলেন, ‘ওই মানুষটা লাখ লাখ মানুষকে যুদ্ধের মুখে ঠেলে দিয়েছে। এই ওয়াগনার বাহিনীই রাশিয়ার বড় দুঃখের কারণ হয়ে দাঁড়াবে।’

সর্বশেষ খবর