সোমবার, ২৬ জুন, ২০২৩ ০০:০০ টা

পয়েন্টে পয়েন্টে বিক্রি মাদক

আজ আন্তর্জাতিক মাদকবিরোধী দিবস

সাখাওয়াত কাওসার

মাদক নির্মূলে চ্যালেঞ্জ প্রভাবশালীদের সংশ্লিষ্টতা। রুট, ব্যবসায়ী এবং সেবীরা চিহ্নিত হলেও ঠেকানো যাচ্ছে না মাদকের আগ্রাসন। কেবল রাজধানী কিংবা বড় বড় শহর নয়, মাদকের ভয়ংকর থাবা থেকে বাদ থাকছে না  অজপাড়াগাঁ। অভিযোগ রয়েছে, প্রভাবশালীরা পৃষ্ঠপোষক হওয়ায় কোনোভাবেই বন্ধ করা যাচ্ছে না মাদক ব্যবসা। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরাও রহস্যজনক কারণে একটা পর্যায়ে গিয়ে থেমে যাচ্ছেন। বহালতবিয়তেই থাকছেন শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ীরা। মাঝে-মধ্যে বহনকারীসহ ছোট-বড় কিছু চালান জব্দ করে নিজেদের সক্ষমতার প্রমাণ দিচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা। সরকারের উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকেও সম্প্রতি মাদক পরিস্থিতি নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করা হয়েছে। অন্যদিকে, মাদকসেবী এবং মাদক ব্যবসায়ীদের কারণে ইমেজ সংকটে পড়ছেন সহজ-সরল সাধারণ মানুষ। মাদক কলঙ্কের কারণে নিজেদের ছেলেমেয়ের ভবিষ্যৎ নিয়েও শঙ্কায় রয়েছেন তারা। জানা গেছে, এক বছরে দেশের বিভিন্ন থানায় মাদক মামলা হয়েছে ১ লাখ ৩২১টি। আসামি করা হয়েছে ১ লাখ ২৪ হাজার ৭৭৫ জনকে। এক বছরে প্রায় ৪০ হাজার মাদক কারবারি গ্রেফতার হয়েছে। এখনো ৮৪ হাজার ৭৭৫ জন মাদক ব্যবসায়ী গ্রেফতার হয়নি। মাদকাসক্তদের মধ্যে ৯০ শতাংশই কিশোর-তরুণ বয়সী। আবার তাদের ৮৫ ভাগই ইয়াবাসেবী। তাদের অনেকে ইয়াবা বিক্রিও করে। ইয়াবার বিস্তারের পাশাপাশি সেবীর সংখ্যাও আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে।

মাদকের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে গত ১৪ জুন সচিবালয়ে আইনশৃঙ্খলা বিষয়ক মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠক হয়। সেখানে মাদকনিয়ন্ত্রণ নিয়ে আলোচনা শেষে কমিটির সভাপতি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণাসহ সরকার নানা উদ্যোগ নিলেও মাদকসেবীর সংখ্যা কমেনি, বরং বেড়েছে। বর্তমানে মাদক পরিস্থিতি খুবই নাজুক। বিষয়টি উদ্বেগজনক। মাদকের বিরুদ্ধে ‘যুদ্ধ’ ব্যর্থ মেনে নিয়ে আরও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে বলেন তিনি। তিনি অভিভাবকদের সচেতনতা বাড়ানোর ওপরও জোর দেন। ওই বৈঠকে আইনশৃঙ্খলা বিষয়ক মন্ত্রিসভা কমিটির সদস্য হিসেবে কয়েকজন মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী উপস্থিত ছিলেন। এ ছাড়া সভায় উপস্থিত ছিলেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও বিভিন্ন সংস্থার শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তারা। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেছেন, বর্তমানে দেশে মাদকাসক্তের সংখ্যা ৮০ লাখের বেশি। এর মধ্যে ৮০ শতাংশই যুবক। ৪৮ শতাংশ শিক্ষিত। ৫৭ শতাংশ যৌন অপরাধী। জেলখানায় বন্দিদের বেশির ভাগই মাদক পাচারকারী কিংবা কারবারি।

জানা গেছে, মাদকনিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে বিভিন্ন সময় ‘বন্দুকযুদ্ধে’ চার শতাধিক মাদক কারবারি নিহত হয়েছে। চিহ্নিত হয়েছে মাদক চোরাচালানের অন্তত ১২টি রুট। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত পাঁচ মাসে সারা দেশে ৪১ হাজার ৭৫৯টি মামলা হয়েছে। আসামি করা হয়েছে ৫১  হাজার ৮৩৪ জনকে। জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়নবিষয়ক সংস্থা আঙ্কটাডের ৮ জুনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মাদকের কারণে প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে ৪৮১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বা প্রায় ৫ হাজার ১৪৭ কোটি টাকা পাচার হয়।

র‌্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল মাহাবুব আলম বলেন, র‌্যাব শুরু থেকেই মাদকনিয়ন্ত্রণে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে আসছে। প্রতিষ্ঠার পর থেকে মাদকনিয়ন্ত্রণে র‌্যাবের অনেক বড় বড় সফলতাও এসেছে। মাদকের বিষয়ে আমাদের সবকটি ব্যাটালিয়নে বিশেষ নির্দেশনা দেওয়া আছে।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের তথ্য বলছে, দেশে ২৫ ধরনের মাদক শনাক্ত করা হয়েছে। গত বছর দেশে ৪ কোটি ৫৮ লাখ ৬৮ হাজার ৫৬৯টি ইয়াবা বড়ি উদ্ধার হয়েছে। ইয়াবার মূল উপাদান ম্যাথঅ্যাম্ফিটামিন বা আইস উদ্ধার হয়েছে ১১৩ কেজি ৩৩১ গ্রাম। হেরোইন উদ্ধার হয়েছে ৩৩৮ কেজি। তার আগের বছর ২০২১ সালে ৫ কোটি ৩০ লাখ ৭৩ হাজার ৬৬৫টি ইয়াবা, ৩৬ কেজি ৭৯৪ গ্রাম আইস এবং ৪৪১ কেজি হেরোইন উদ্ধার হয়। দেশে এর কয়েক গুণ বেশি মাদক ঢোকে বলে সংশিষ্টদের ধারণা।

গত এক বছরে র‌্যাবের বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, গত এক বছরে সারা দেশে র‌্যাবের অভিযানে ১০ হাজার ৫৭৩ জন গ্রেফতার হয়েছে। এর মধ্যে মাঠপর্যায়ের মাদক ব্যবসায়ী  রয়েছে ৮ হাজার ৪৭৩। শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী রয়েছে ২২২ জন। তবে এখনো শতাধিক শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী গ্রেফতার হয়নি বলে মাঠপর্যায়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে।

ডিএনসির সর্বশেষ পরিসংখ্যান বলছে, দেশে বর্তমানে প্রায় ৩০ ধরনের মাদকের মধ্যে ইয়াবা বেশি সেবন করা হয়। দেশে প্রতিদিন প্রায় ৭০ লাখ ইয়াবা বিক্রি করা হয়। এর মধ্যে রাজধানীতে বিক্রি হয় অন্তত ১৫ লাখ। প্রতিটি ইয়াবার দাম ৩০০ টাকা হলে ৭০ লাখ ইয়াবার দাম দাঁড়ায় ২১০ কোটি টাকা।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক মো. আজিজুল ইসলাম বলেন, মাদকের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত আছে। তালিকা ধরে ধরে মাদক কারবারিদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।

জানা গেছে, মাদকের কারণে কয়েক বছর ধরে ফরিদপুরের মধুখালী উপজেলার ডুমাইন নামে একটি গ্রামের মানুষ ইমেজ সংকটে পড়েছে। এ গ্রামের বিভিন্ন বয়সী অন্তত ৭০ জন মাদক ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত। অনেকটা কক্সবাজারের টেকনাফের মতো অবস্থা এ গ্রামের। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক গ্রামবাসী এ প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলার সময় হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেন। তিনি বলেন, ‘আমরা কেউ ‘টু’ শব্দটি পর্যন্ত করতে পারছি না। মাদক ব্যবসায়ীরা পুরো গ্রাম গ্রাস করে ফেলেছে। অভিভাবকরা চরম বিপাকে আছেন। এ গ্রামের নাম শুনলে কেউ ছেলেমেয়েদের বিয়ে দিতে চান না। স্থানীয় পুলিশকে জানিয়েও তারা এর কোনো প্রতিকার পান না।’

এদিকে গত বছরের শেষের দিকে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের চনপাড়ায় র‌্যাবের অভিযানের পর কিছুদিন আতঙ্কে ছিল মাদক ব্যবসায়ীরা। তবে কয়েক মাস পরই চনপাড়া আগের রূপেই ফিরে যায়। চনপাড়ার অভিভাবকরাও তার প্রজন্মকে নিয়ে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠায় সময় পার করছেন। ইমেজ সংকটে ভুগছেন তারাও।

 

সরেজমিন দেখা গেছে, বুধবার রাত ১২টা। একটি প্রাইভেট কার এসে থামল কারওয়ান বাজার মাছের আড়ত রেলগেট এলাকায়। কারটির চালক সামনের দরজা খুলতেই এক তরুণ এগিয়ে এলেন। সঙ্গে থাকা ইয়াবার ট্যাবলেট দিয়ে ১ হাজার টাকা নিয়ে দ্রুত সরে পড়লেন। প্রাইভেট কারের চালকও মুহূর্তের মধ্যে সটকে পড়েন। এর কয়েকদিন আগে দিনের বেলা একই জায়গায় প্রকাশ্যে এক নারীকে দেখা যায় ইয়াবা বিক্রি করতে।

রাজধানীর কারওয়ান বাজার, মোহাম্মদপুরের গজনবী রোড, বাবর রোড, শাহজাহান রোড, হুমায়ুন রোডে গিয়ে দেখা গেছে, চারটি রোডেই দীর্ঘদিন ধরে রয়েছে পুলিশের তল্লাশি চৌকি। এরপরও ওই সব জায়গায় দিন-রাত চলছে মাদক বেচাকেনা। গোয়েন্দারা বলছেন, কমপক্ষে ৫০০টি স্পটে মাদক কেনাবেচা চলে খোদ রাজধানীতে। অন্তত ২০ জনের নিয়ন্ত্রণে মোহাম্মদপুর জেনেভা ক্যাম্পে দিন-রাত চলে মাদক কারবার। তেজগাঁও রেল বস্তি, বনানীর কড়াইল বস্তি, সবুজবাগের ওহাব কলোনি, কামরাঙ্গীর চর, মতিঝিলের এজিবি কলোনিতে মাদক বাণিজ্য চলে অর্ধশতাধিক মাদক কারবারির নিয়ন্ত্রণে। পল্লবী বিহারি ক্যাম্প এলাকায় রয়েছে ১৯ জন মাদক কারবারি। স্থানীয় ওয়ার্ড পর্যায়ের রাজনৈতিক নেতা এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর কিছু সদস্যও তাদের মাদক কারবারে সহযোগিতা করেন। কয়েক দিন ধরে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার অন্তত ২৩টি স্পট ঘুরে প্রকাশ্যে মাদক বিক্রির চিত্র দেখা যায়। তবে রাজধানীর বিভিন্ন থানার পুলিশের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিটি এলাকায়ই একাধিক স্পট রয়েছে। পুলিশ এক বছরে ৭ শতাধিক স্পট চিহ্নিত করেছে। অনেক স্পট তাদের নিয়ন্ত্রণে এসেছে।

সর্বশেষ খবর