শিরোনাম
সোমবার, ২৬ জুন, ২০২৩ ০০:০০ টা
বিদ্রোহ সামলালেও কাটেনি নানা শঙ্কা

পুতিনের ভয়ংকর ২৪ ঘণ্টা

প্রতিদিন ডেস্ক

পুতিনের ভয়ংকর ২৪ ঘণ্টা

রাশিয়ায় অবশেষে ভাড়াটে ওয়াগনার সেনাদের বিদ্রোহ সামাল দেওয়া হয়েছে। প্রতিবেশী বেলারুশের প্রেসিডেন্ট আলেক্সান্ডার লুকাশেঙ্কোর মধ্যস্থতায় আপাতত এ বিদ্রোহের অবসান ঘটেছে। রুশ সামরিক কর্তৃপক্ষ বিদ্রোহী নেতা ইয়েভজেনি প্রিগোজিন ও তার বাহিনীর ওপর থেকে শাস্তিমূলক নির্দেশনা তুলে নিলে বিদ্রোহীরা মস্কো অভিযান পরিত্যাগ করে পিছু হটে যায়। তারা তাদের দখল করা অবস্থানগুলোও ছেড়ে দিয়েছে। এর মধ্যদিয়ে গোটা বিশ্বে তোলপাড় সৃষ্টি করা রক্তপাতহীন বিদ্রোহ পরিস্থিতির অবসান ঘটেছে। তবে সমঝোতা অনুযায়ী, বিদ্রোহী নেতা ইয়েভজেনি প্রিগোজিনের বেলারুশে নির্বাসনে চলে যাওয়ার কথা থাকলেও শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত তার কোনো খোঁজ মিলছে না।

বিবিসি, রয়টার্স, এএফপি, স্পুটনিক, তাস, আল জাজিরাসহ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, গত শনিবার ভোর থেকে রাশিয়ায় আকস্মিক ভাড়াটে ওয়াগনার সেনাদের বিদ্রোহের খবর এবং তাদের রাজধানী মস্কো দখলের জন্য অগ্রযাত্রার ঘটনায় গোটা বিশ্বে তোলপাড় শুরু হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার সামরিক জোট ন্যাটো সঙ্গে সঙ্গে পূর্ণ সতর্ক অবস্থায় চলে যায়। যুক্তরাষ্ট্রের মুখপাত্ররা জানান, এই বিদ্রোহের প্রস্তুতির কথা তারা আগেই জানতেন। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপও আগেই রুশ প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনকে সতর্ক করেছিলেন। এমতাবস্থায় হঠাৎ করেই এ বিদ্রোহ শুরু হলে রাশিয়ার প্রতিপক্ষ এবং মিত্র মহলে নানা প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। পশ্চিমা প্রতিপক্ষরা ধারণা করছিল, রাশিয়ায় সামরিক অভ্যুত্থান ঘটতে চলেছে এবং ক্ষমতাচ্যুত হচ্ছেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন। এ নিয়ে রাশিয়া এবং বিশ্বব্যাপী পুরো আধা দিনের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার পর ফের চমকপ্রদ খবর আসে, যাতে বিদ্রোহের অবসান এবং বিদ্রোহীদের রাশিয়া ছাড়ার ঘোষণা পাওয়া যায়। প্রাপ্ত খবর অনুযায়ী, শনিবারই রাশিয়ার ভাড়াটে বাহিনী ওয়াগনারের প্রধান ইয়েভজেনি প্রিগোজিনের সঙ্গে বেলারুশের প্রেসিডেন্ট আলেক্সান্ডার লুকাশেঙ্কোর এক সমঝোতার মধ্যদিয়ে ওয়াগনারের বিদ্রোহের ফলে সৃষ্ট জটিল পরিস্থিতির অবসান ঘটে। ক্রেমলিন জানায়, বিদ্রোহ করার কারণে প্রিগোজিনের বিরুদ্ধে যে ফৌজদারি অভিযোগ দায়ের করা হয়েছিল তা প্রত্যাহার করা হবে। তার আগেই ইয়েভজেনি প্রিগোজিন রাশিয়ার দক্ষিণাঞ্চলীয় রোস্তভ-অন-ডন শহর থেকে তার বাহিনীকে সরিয়ে নেওয়া শুরু করেন। এ ব্যাপারে ক্রেমলিন এক বিবৃতিতে জানায়, বেলারুশের প্রেসিডেন্ট লুকাশেঙ্কোর সঙ্গে হওয়া সমঝোতা অনুযায়ী, প্রিগোজিন বেলারুশে চলে যাবেন এবং তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হবে না। লুকাশেঙ্কোর এই উদ্যোগকে রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন স্বাগত জানিয়েছেন। এদিকে বিদ্রোহী ভাড়াটে বাহিনীর পক্ষ থেকে গণমাধ্যমকে জানানো হয়, ওয়াগনারের প্রধান ইয়েভজেনি প্রিগোজিন রক্তপাত এড়াতেই তার সৈন্যদের মস্কোর দিকে অগ্রযাত্রা থামানোর নির্দেশ দিয়েছেন। একইসঙ্গে তিনি বেলারুশে নির্বাসিত জীবনযাপন করতে রাজি হয়েছেন।

রাশিয়ার বার্তা সংস্থা তাস জানায়, ওয়াগনার বাহিনীর পিছু হটার কারণে ফেডারেল রোড এজেন্সি মোটরওয়েতে আগে দেওয়া সব নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছে। উল্লেখ্য, রোস্তভ, লিপেটস্ক, ভোরোনেজ ও তুলা অঞ্চলসহ ২৪ ঘণ্টা ধরে রাশিয়ার দক্ষিণাঞ্চল থেকে মস্কো যাওয়ার রাস্তাগুলো বন্ধ ছিল।

এর আগে বিদ্রোহ শুরুর পর রাশিয়ার স্থানীয় সামরিক-বেসামরিক সব কর্মকর্তা প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনের প্রতি আনুগত্যের কথা ঘোষণা করেন। ক্রেমলিনের কর্মকর্তাদের পাশাপাশি আঞ্চলিক গভর্নর ও আইন প্রণেতারাও পুতিনের প্রতি আনুগত্যের শপথ পুনর্ব্যক্ত করেন। খবরে বলা হয়, ঘটনার সময় রাশিয়ার কোনো কেন্দ্রীয় নেতা ওয়াগনারের পক্ষ নেননি। তারা সবাই বলেন, এই বিদ্রোহ দমন করতে পারবেন পুতিন। তবে শেষ পর্যন্ত বিদ্রোহ দমন করতে হয়নি, বরং রক্তপাত ছাড়াই বিদ্রোহের আপাত অবসান ঘটেছে। রাশিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট ও রুশ নিরাপত্তা পরিষদের উপ-প্রধান দিমিত্রি মেদভেদেভ জানিয়েছেন, ‘আমরা একমত হয়েছি, ওয়াগনার সেনাদের মধ্যে যারা বিদ্রোহে অংশ নেননি, তাদের রুশ সেনাবাহিনীতে যুক্ত করা হবে। তারা চাইলে রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হতে পারবেন। আর সেন্ট পিটার্সবার্গের ধনকুবের প্রিগোজিন বেলারুশে চলে যেতে পারবেন।’ তিনি আরও জানান, ইউক্রেনের যুদ্ধক্ষেত্রে অবদানের কথা বিবেচনায় রেখে ওয়াগনার গ্রুপের সেনাদের বিচার করা হবে না।

বিশ্বে প্রতিক্রিয়া : রাশিয়া ইউক্রেনে সামরিক অভিযান শুরুর পর যে অল্প কয়েকটি দেশ মস্কো ও কিয়েভ উভয়ের সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখে চলেছে, তুরস্ক তার একটি। ভাড়াটে বাহিনী ওয়াগনার রাশিয়ার সামরিক নেতৃত্বের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে মস্কোর দিকে অগ্রযাত্রা শুরুর পর তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগান তার রুশ কাউন্টার পার্ট ভøাদিমির পুতিনের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেন। তুর্কি প্রেসিডেন্টের কার্যালয় জানিয়েছে, শনিবার ফোনালাপে এরদোগান পুতিনকে বিদ্রোহ মোকাবিলায় ‘কান্ডজ্ঞান খাটিয়ে’ ব্যবস্থা নিতে পরামর্শ দেন। তুরস্কের প্রেসিডেন্টের কার্যালয় জানায়, দুই নেতা রাশিয়ার পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলেন। এ সময় এরদোগান পুতিনকে জানান, সংকটের শান্তিপূর্ণ সমাধানে সহযোগিতা করতে আঙ্কারা প্রস্তুত। অন্যদিকে আলাদা বিবৃতিতে ক্রেমলিন জানায়, পুতিনের সঙ্গে আলোচনায় এরদোগান রাশিয়ার সরকার বিদ্রোহ দমনে যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে, তাতে সমর্থন দিয়েছেন।

এদিকে ফক্স নিউজের খবরে বলা হয়, রাশিয়ার সামরিক বাহিনীর শীর্ষ জেনারেলদের সঙ্গে ভাড়াটে বাহিনী ওয়াগনারের সংঘাতে মস্কোতে সরকার পতন ঘটতে পারে- পশ্চিমাদের এমন আশায় পানি ঢেলে দিয়েছেন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি পরিষ্কার জানিয়ে দেন, ‘ভøাদিমির পুতিনের পতন বিশ্বে অনাকাক্সিক্ষত পরিণতি ডেকে আনবে।’ শনিবার ট্রুুথ সোশ্যালে দেওয়া পোস্টে ট্রাম্প এ কথা বলেন। সাবেক এই মার্কিন প্রেসিডেন্ট আরও বলেন, ‘রাশিয়ায় অভ্যুত্থান নিয়ে আশাবাদী হওয়ার ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করা দরকার। কারণ তার পরিণতি আরও মারাত্মক হতে পারে।’

বিশ্লেষণ : সার্বিক ঘটনার বিশ্লেষণে পর্যবেক্ষকদের অনেকে বলছেন, রাশিয়ানরা পুতিন প্রেসিডেন্ট পদে না থাকলে  পরিস্থিতি কেমন হতে পারে- তার একটি নমুনা এ বিদ্রোহের মাধ্যমে দেখে ফেলল বিশ্ব, যেখানে কয়েক ঘণ্টা ধরে কেবল অরাজকতাই চলছে বলে মনে হচ্ছিল। তিনি এও বলেন, এর মধ্যদিয়ে এখর রাশিয়ার সামরিক বাহিনীও ২৫ হাজার যুদ্ধবাজ ভাড়াটে সৈন্যকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনার উপায় খুঁজে পেল।

পশ্চিমাদের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, রুশ প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন নতুন সংকটে পড়েছেন। আপাতত সংকট কাটাতে পারলেও তিনি এমন আচরণ পছন্দ করেন না। ফলে ববাবরের মতো শক্তি প্রদর্শন করেই প্রতিক্রিয়া দেখাবেন ভøাদিমির পুতিন। এ ছাড়া রাশিয়ার প্রভাবশালী টেলিগ্রাম চ্যানেলসহ অভ্যন্তরীণ স্বাধীনতা এবং সংবাদমাধ্যমে আরও নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে পারেন তিনি। ইউক্রেন ভূখন্ডে আরেকটি সামরিক হামলার বিষয়টিকে উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। ইউক্রেনের নতুন হামলা শুরুর পাশাপাশি বিভিন্ন ইস্যুতে আরও সতর্ক হবেন পুতিন।

পোল্যান্ডের ইউরোপীয় পার্লামেন্টের সদস্য (এমইপি) রাডেক সিকোরস্কি বলেছেন, প্রিগোজিনের বিদ্রোহের পর পুতিন একই সঙ্গে দুর্বল ও শক্তিশালী হয়েছেন। এতে পুতিনের দুর্বলতা প্রকাশ পেয়েছে। কারণ, একদল সশস্ত্র ব্যক্তি কোনো প্রতিরোধের মুখে না পড়েই রাশিয়ার ভিতরে কয়েক শ কিলোমিটার এগোতে পেরেছে। সিকোরস্কি আরও বলেন, ‘যারা বিদ্রোহীদের প্রতি সমর্থনসূচক অবস্থান নিয়েছিলেন তাদের নির্মূলের উদ্যোগ নেবেন রুশ নেতা। এর অর্থ হলো পুতিন আরও স্বৈরাচারী ও আরও নৃশংস হয়ে উঠবেন।’

বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘পুতিন বিশ্বাসঘাতকতা পছন্দ করেন না। তিনি এটিকে ঘৃণা করেন। ফলে বিদ্রোহে জড়িত ওয়াগনার যোদ্ধাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রত্যাহারের কথা ক্রেমলিন বললেও তা বিশ্বাস করা কঠিন।’ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পুতিনের জন্য বিষয়টি এখনো শেষ হয়ে যায়নি। আপাতত সংকট কাটানো গেছে। কিন্তু রুশ প্রেসিডেন্ট পুরোপুরি পার পেয়ে যাননি।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর