মঙ্গলবার, ২৭ জুন, ২০২৩ ০০:০০ টা

বেপরোয়া চিকিৎসা ব্যবসা

♦ সামাজিক মাধ্যমে বিজ্ঞাপন দিয়ে রোগী খোঁজ ♦ গোপনীয়তা লঙ্ঘন ♦ একজনের প্রেসক্রিপশনের টেস্ট দেখেন না অন্য চিকিৎসক ♦ নেমপ্লেটের পাশে ট্রেনিংগুলোও লিখে দেন অনেক চিকিৎসক

নিজস্ব প্রতিবেদক

বেপরোয়া চিকিৎসা ব্যবসা

‘চেম্বারে একসঙ্গে পাঁচজন রোগীকে ডাকছেন চিকিৎসক। সঙ্গে তাদের স্বজনরা। রুমের ভিতরে সব মিলিয়ে ১৫ জনের মতো মানুষ। আমরা সন্তান নেওয়ার চেষ্টা করছি; কিন্তু বারবার সন্তান পেটে আসার পর নানা জটিলতা তৈরি হয়ে গর্ভপাত হচ্ছে। আমি মানসিকভাবেও বিধ্বস্ত। গত সপ্তাহে একজন ডাক্তার দেখিয়েছি, তিনি প্রায় ৩০ হাজার টাকার টেস্ট দিয়েছেন। এন্ড্রোক্রাইনোলজির এই চিকিৎসক আমার কথাও শুনলেন না, আগের টেস্টগুলোও দেখলেন না। ওই টেস্টগুলোই আবার দিয়ে নির্দিষ্ট একটি হাসপাতালের নাম বলে সেখান থেকে করাতে বললেন। চিকিৎসকের এই ব্যবহারে আমি মানসিকভাবে আরও ভেঙে পড়ি।’

চিকিৎসক দেখাতে গিয়ে নিজেদের তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা বলছিলেন রাজধানীর লালমাটিয়া এলাকার বাসিন্দা নাজনীন নাহার। তার স্বামী ফয়সাল আহমেদ বলেন, ‘সমস্যায় না পড়লে দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার ফাঁকফোকর জানা যায় না। সেবা দেওয়ার নামে কিছু চিকিৎসক এবং হাসপাতালের অনৈতিক বাণিজ্য আমরা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি। প্রায় দেড় লাখ খরচ হয়ে গেছে, কিন্তু সন্তান না হওয়ার কারণটাই কেউ এখনো জানতে পারিনি। শুধু টেস্টের লিস্ট ধরিয়ে দেয়।’

চিকিৎসায় অব্যবস্থাপনা, সেবার নামে রোগীদের নিয়ে চলছে বিজ্ঞাপন তৈরি। এসব বিজ্ঞাপন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে, হাসপাতালের ভিতরে-বাইরে ব্যানার-পোস্টার আকারে ঝুলিয়ে রাখা হচ্ছে। এতে নষ্ট হচ্ছে রোগীর গোপনীয়তা। মনোযোগ দিয়ে রোগীর কথা না শোনায় বেশ কিছু চিকিৎসকের বিরুদ্ধে অভিযোগ দীর্ঘদিনের। অনেক চিকিৎসক বিদেশে তিন দিন, ছয় দিনের ট্রেনিংয়ে অংশ নিয়ে সেগুলোও লিখে রাখেন নেমপ্লেটের পাশে; যাতে নামের পাশে এগুলোকে ডিগ্রি মনে করে রোগী ভিড় করেন তার চেম্বারে।

দেশের স্বাস্থ্যসেবায় আস্থাহীনতার কারণে বিদেশগামী রোগীর ভিড় বাড়ছে। ভারত, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুরসহ বিভিন্ন দূতাবাসে মেডিকেল ভিসার জন্য যাওয়া মানুষের ভিড় ঊর্ধ্বমুখী। দেশের সরকারি হাসপাতালে অব্যবস্থাপনা, সংকট, প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা। বেসরকারিতে রয়েছে আস্থার সংকট, প্রতারণার ফাঁদ। উচ্চবিত্তের বিদেশ যাওয়ার প্রবণতাকে এসব কারণ আরও উসকে দিচ্ছে। ভালো সেবার আশায় মধ্যবিত্ত এমনকি নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষও ছুটছেন বিদেশ।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপ-উপাচার্য এবং বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই-মাহবুব বলেন, ‘সেবা বিষয়ে জনগণের প্রত্যাশা রয়েছে। এসব বিষয়ে নজর দিতে হবে চিকিৎসা পদ্ধতি এবং নীতি-নৈতিকতা বজায় রেখে। কিন্তু দেশে যার যা মন চাইছে তা-ই করছে। আমরা কখনো রোগী পেতে বিজ্ঞাপন করিনি। সেবা ভালো দিলে এমনিতেই রোগী আসবে। কিন্তু এখন চিকিৎসা ব্যবসা হয়ে উঠেছে। ব্যবসা ফুলে ফেঁপে ওঠার জন্য ডাক্তাররা এখন বিজ্ঞাপন দিয়ে রোগী খুঁজছে। এগুলো দেখে অবাক হই। ব্যবসা করে যদি টাকা কামাই করতে হয়, তাহলে আলু-পটোলের ব্যবসা করা ভালো।’

হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টারে প্রায়ই ভুল টেস্ট রিপোর্টে বিপাকে পড়ছেন রোগী। পেটের ডান পাশে ব্যথায় মাসখানেক ধরে ভুগছিলেন সানজিদা ইয়াসমিন (৪৮)। রাজশাহীতে এক চিকিৎসকের কাছে গেলে তিনি পুরো পেটে আল্ট্রাসনোগ্রাম করতে বলেন। বেসরকারি এক ডায়াগনস্টিক সেন্টারে আল্ট্রাসনোগ্রাম করিয়ে রিপোর্ট নিয়ে চিকিৎসকের কাছে গেলে জানান তার জরায়ুপথে টিউমার হয়েছে। দ্রুত অপারেশন করতে হবে।

সানজিদা ইয়াসমিন বলেন, ‘চিকিৎসকের কথা শুনে আমার পুরো পরিবার দুশ্চিন্তায় পড়ে যায়। আমরা অপারেশনের জন্য টাকার জোগাড় শুরু করি। তখন আমার স্বামী বলেন অপারেশনের আগে আরেকবার ঢাকা থেকে ডাক্তার দেখানো প্রয়োজন। আমাকে ঢাকা নিয়ে গিয়ে আবার আল্ট্রাসনোগ্রাম করানো হয়। সে রিপোর্ট নিয়ে আরেক চিকিৎসকের কাছে গেলে জানান টিউমারের কোনো অস্তিত্বই নেই। আগের রিপোর্ট দেখে অকারণে অপারেশন করলে আমার কত বড় ক্ষতি হতো ভাবলেই গা শিউরে ওঠে।’ সম্প্রতি মাহবুবা রহমান আঁখি ও তার নবজাতকের মৃত্যুর ঘটনায় স্বাস্থ্যব্যবস্থার নানা অব্যবস্থাপনা নিয়ে চলছে আলোচনা। সেন্ট্রাল হাসপাতাল ও ডা. সংযুক্তা সাহা একে অন্যকে দুষছেন। এ ঘটনায় নড়েচড়ে বসেছে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি)। সেন্ট্রাল হাসপাতালের ঘটনায় ডা. সংযুক্তা সাহাসহ অন্য চিকিৎসকদের বিষয়ে বিএমডিসি এক্সিকিউটিভ কমিটিকে অনিয়মের কথা জানিয়েছে শৃঙ্খলা কমিটি। আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করেছেন কমিটির সদস্যরা। রোগীকে দেখিয়ে লাইভ এবং ভিডিও করাকে অনৈতিক হিসেবে ব্যাখ্যা করেছে কমিটি। ২০১০ সালে ডা. সংযুক্তা সাহার লাইসেন্সের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। দুই দিন আগে বিএমডিসিতে লাইসেন্স নবায়নের আবেদন করেছেন ডা. সংযুক্তা সাহা।

চিকিৎসক হিসেবে পেশাগত কাজের জন্য বিএমডিসি থেকে সনদ নিতে হয়, সময়ে সময়ে তা নবায়নও করতে হয়। ডা. সংযুক্তা সাহা নিবন্ধন নিয়েই কর্মজীবন শুরু করেছিলেন, তবে তা নবায়ন করেননি গত ১৩ বছরে। গতকাল রাজধানীর পরিবাগের বাসায় সংবাদ সম্মেলন করে এই চিকিৎসক বলেন, ‘আমার নিবন্ধন নেই, বিষয়টি কিন্তু এমন না। নিবন্ধন আছে, তবে সেটি নবায়ন করা হয়নি। বিএমডিসিতে নবায়নের একটা ফি দিতে হয়, এটা গত বছর থেকেই অনলাইন সিস্টেম ছিল, এটা আমি জানতাম না। আমার আগেই নিবন্ধন নেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু আমি এত ব্যস্ত থাকি যে অনেক সময় বাসায় আসার সময়ও পাইনি। এটা করতেও সময় পাইনি, আমার ভুল হয়েছে।’ এ ঘটনার পর ফেসবুকসহ সোশ্যাল মিডিয়ায় চিকিৎসকদের আত্মপ্রচার নিয়েও প্রশ্ন উঠছে।

সংযুক্তা সাহা আরও বলেন, ফেসবুক লাইভ করা অনৈতিক হলে তিনি তা আর করবেন না। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চিকিৎসকদের এ ধরনের প্রচার চালানো যে যায় না, তা তিনি জানতেন না। ‘যদি সরকার মনে করে এতে হিতে বিপরীত হচ্ছে, এটা অন্যায় করা হচ্ছে তাহলে এটা নিয়ে আমাকে ভাবতে হবে। এতদিন এটা নিয়ে আমাকে কেউ নোটিফাই করেনি। আজ এটা আমি জানলাম, এখন হয়তো আর এটা করা হবে না। যদি মনে করে এটা হিতে বিপরীত হচ্ছে, জনগণের উপকার না করে অপকার করছে, তাহলে অবশ্যই এটা আমি বন্ধ করে দেব। আমরা একটা ভালো কাজের জন্য এগিয়েছি, যদি সেটা দশটা খারাপ কাজ করে তাহলে তো সেটা চালানো যাবে না’, বলেন এই চিকিৎসক।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর