শিরোনাম
সোমবার, ৩ জুলাই, ২০২৩ ০০:০০ টা

নষ্ট যন্ত্রের পাহাড় সরকারি হাসপাতালে

♦ একবার নষ্ট হলে ঠিক করানোই দায় ♦ বাইরের ডায়াগনস্টিক থেকে টেস্ট করে আনতে হয় রোগীদের ♦ সেবা দিতে অসুবিধায় চিকিৎসকরা ♦ ভোগান্তিতে মানুষ

নিজস্ব প্রতিবেদক

নষ্ট যন্ত্রের পাহাড় সরকারি হাসপাতালে

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আল্ট্রাসনোগ্রাম করার পাঁচটি যন্ত্রের তিনটিই নষ্ট। গর্ভবতী মা কিংবা জরুরি রোগীদের বসে থাকতে হচ্ছে দীর্ঘ সিরিয়ালে। জীবন বাঁচাতে বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ছুটছে মানুষ। রোগী নিয়ে দৌড়াদৌড়িতে বাড়ছে ভোগান্তি, বাড়ছে খরচের বোঝা।

শুধু ঢাকা মেডিকেল নয় রাজধানী থেকে শুরু করে দেশের সব বিভাগীয়, জেলা, উপজেলা পর্যায়ের সরকারি হাসপাতালে নিত্যচিত্র এটি। একবার যন্ত্রপাতি নষ্ট হলে আর সারানোর ব্যবস্থা হয় না। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে শত কোটি টাকার যন্ত্র নষ্ট হয়ে পড়ে আছে। অনেক জায়গায় যন্ত্র কেনার পর বাক্সবন্দি অবস্থায় থেকে নষ্ট হয়ে গেছে। টেকনিশিয়ান নিয়োগ না দিয়ে পাঠানো হয়েছে যন্ত্রপাতি। ফলে কাক্সিক্ষত সেবা পায় না রোগীরা। রাগ ক্ষোভ গিয়ে পড়ে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের ওপর।

গত ২১ ফেব্রুয়ারি স্বাস্থ্য অধিদফতরের হাসপাতাল সেবা ব্যবস্থাপনা শাখা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত সভায় জানায় যে, দেশের তিনটি প্রধান সরকারি হাসপাতালে প্রায় ১০০ কোটি টাকা মূল্যের ২৩৮টি যন্ত্রপাতি নষ্ট হয়ে পড়ে আছে। এর মধ্যে অনেক যন্ত্রপাতি ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। এ ছাড়া অচল হয়ে পড়ে আছে চারটি অ্যাম্বুলেন্স। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের গাইনি বিভাগের এক চিকিৎসক বলেন, এই হাসপাতালের পাঁচটি আল্ট্রাসনোগ্রাম যন্ত্রের তিনটিই নষ্ট। পেটের ভিতরে রক্তক্ষরণ হচ্ছে এমন জরুরি রোগীর চিকিৎসার জন্য আল্ট্রাসনোগ্রামের বিকল্প নেই। কিন্তু দীর্ঘ সিরিয়ালে বসে রোগী টেস্ট করাতে পারছে না। তখন বাধ্য হয়ে তারা বাইরে থেকে টেস্ট করিয়ে আনে, নয়তো চিকিৎসকদের বলতে হয় বাইরে থেকে টেস্ট করানোর কথা। এ কথা শুনলে মানুষ চিকিৎসককে ভুল বোঝে। কিন্তু এই সিস্টেমের মধ্যে আমরা তো নিরুপায়। সবাই চিকিৎসকদের ভুল বোঝে। আল্ট্রাসনোগ্রামে এক বেলায় ৭০ জনের বেশি রোগীর সিরিয়াল নেয় না। তাহলে গর্ভবতী মা যার জরুরি চিকিৎসা দরকার তাকে কোথায় পাঠাব। তিনি আরও বলেন, রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে দামি দামি যন্ত্রপাতি নষ্ট হচ্ছে। এমআরআই, ল্যাপরোস্কপির মতো দামি দামি মেশিন রক্ষণাবেক্ষণ না করলে কেনার তিন মাসের মধ্যে তো নষ্ট হবেই।’

অনেক হাসপাতালে অসাধু স্বাস্থ্যকর্মীদের বিরুদ্ধে ইচ্ছাকৃতভাবে মেশিন নষ্ট করে রাখা কিংবা সচল থাকলেও বেসরকারিতে রোগী পাঠানোর জন্য অচল বলে চালানোর অভিযোগ রয়েছে। কমিশনের আশায় দালালদের সঙ্গে মিলে রোগী পাঠান সরকারি হাসপাতালের পাশে গড়ে ওঠা বেসরকারি ক্লিনিকে। অনেক সময় এর সঙ্গে টেকনিশিয়ান এবং ওয়ার্ডবয়দের জড়িত থাকার অভিযোগ করেন রোগীরা।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের দেওয়া নষ্ট হওয়া মেশিনের তালিকায় ছিল, এক্সরে যন্ত্র, ইসিজি যন্ত্র, আলট্রাসনোগ্রাম যন্ত্র, ওটি টেবিল, ওটি লাইট (সিলিং), ওটি লাইট (পোর্টেবেল), ডায়াথার্মি যন্ত্র, সাকার যন্ত্র, অ্যানেসথেসিয়া যন্ত্র, অটোক্লেভ যন্ত্র, ডেন্টাল যন্ত্র, অক্সিজেন সিলিন্ডার, অক্সিজেন কনসেনট্রেশন, নেবুলাইজার যন্ত্র, এনজিওগ্রাম যন্ত্র, এমআরআই যন্ত্র, সিটি স্ক্যান যন্ত্র ও অক্সিজেন জেনারেটর। এ ছাড়া রয়েছে অ্যাম্বুলেন্স।

সবচেয়ে বেশি যন্ত্রপাতি নষ্ট হয়ে আছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। দেশের সবচেয়ে বড় এই হাসপাতালে প্রয়োজনীয় ১৪৯টি যন্ত্রপাতি নষ্ট হয়ে আছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের হিসাব বলছে, এর অধিকাংশ আর মেরামত করার অবস্থায় নেই। সেই তুলনায় যন্ত্রপাতি কম নষ্ট দেখা গিয়েছে মিটফোর্ড হাসপাতালে। এই হাসপাতালে নষ্ট যন্ত্র আছে ৩৮টি। এর মধ্যে ৩টি যন্ত্র মেরামতের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। অন্যদিকে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নষ্ট যন্ত্র আছে ৫১টি। এর মধ্যে ৩টিকে আর চেষ্টা করেও ব্যবহার উপযোগী করা যাবে না।

রোগীর সেবায় ঢাকা মেডিকেলে অ্যাম্বুলেন্স আছে ১২টি। এর মধ্যে অচল দুটি। অচল একটি অ্যাম্বুলেন্স মেরামতের অনুপযোগী। শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চারটি অ্যাম্বুলেন্সের একটি নষ্ট এবং সেটি আর চালানো যাবে না।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালটি ২ হাজার ৬০০ শয্যার। শয্যার চেয়ে প্রায় দেড় গুণ বেশি রোগী এই হাসপাতালে ভর্তি থাকে। প্রতিদিন বহির্বিভাগে ৫ থেকে ৬ হাজার রোগী চিকিৎসা নেয়। সাধারণ চিকিৎসার পাশাপাশি এই হাসপাতালে অনেক বিষয়ে বিশেষায়িত সেবা দেওয়া হয়। এই হাসপাতালের জরুরি বিভাগ বছরের ৩৬৫ দিনই খোলা থাকে। জরুরি বিভাগে দিনে প্রায় ১ হাজার রোগী আসে। সাধারণ মানুষের একটি ধারণা আছে, কোথাও চিকিৎসা না জুটলেও ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসা পাওয়া যাবে। কিন্তু যন্ত্রপাতি নষ্ট থাকায় প্রয়োজনীয় সেবা পেতে ভোগান্তিতে পড়ছে মানুষ। জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে ক্যান্সার চিকিৎসায় ব্যবহৃত অন্যতম জরুরি রেডিওথেরাপি মেশিন রয়েছে ছয়টি। কিন্তু প্রায় দুই বছর আগে এগুলোর মধ্যে মেয়াদোত্তীর্ণ হয়েছে চারটির। এর পাঁচটিই প্রায় নষ্ট থাকে। একটি মেশিন দিয়ে খুঁড়িয়ে চলছে স্বাস্থ্যসেবা।

কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ’র (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘সরকারি হাসপাতালে যন্ত্রপাতি নষ্ট থাকলে সেবা পেতে বিড়ম্বনায় পড়ে মানুষ। এটা রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপচয়ও বটে। অনেক সময় জনবল নিয়োগ না দিয়ে যন্ত্রপাতি কেনা হয়। বাক্সবন্দি অবস্থায় নষ্ট হয়ে যায় কোটি টাকার যন্ত্র। এর জন্য সরকারের ক্রয় পদ্ধতি কিছুটা দায়ী। তিনি আরও বলেন, এর পাশাপাশি আরও দায় রয়েছে হাসপাতালে দায়িত্বরত সংশ্লিষ্টদের। তাদের অবহেলা, অযতেœ নষ্ট হয়ে যায় মেশিনগুলো। ঠিকমতো রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এ ঘটনা ঘটে। তাই আমরা প্রত্যাশা করি যন্ত্রপাতি যাতে নষ্ট হয়ে না পড়ে সেদিকে তারা নজর দেবেন। যন্ত্রপাতির সুষ্ঠু রক্ষণাবেক্ষণের মাধ্যমে মানুষের সেবা প্রাপ্তি নিশ্চিত করবেন।’

 

 

সর্বশেষ খবর