শনিবার, ৮ জুলাই, ২০২৩ ০০:০০ টা

ইয়াবার নতুন গডফাদার

উখিয়ায় নবী-সোনালী, টেকনাফে এনামুল

মির্জা মেহেদী তমাল

ইয়াবার নতুন গডফাদার

বাংলাদেশে ইয়াবা কারবারে গডফাদারের তালিকায় নতুন নাম যুক্ত হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কক্সবাজারের উখিয়ায় নতুন গডফাদারের নাম নবী হোসেন এবং সোনালী। রোহিঙ্গা এই দুই গডফাদার হলেন রোহিঙ্গা ক্যাম্পের হেড মাঝি। আর টেকনাফে নতুন গডফাদার হিসেবে ভয়ংকর হয়ে উঠছেন আত্মসমর্পণকারী ইয়াবা ব্যবসায়ী এনামুল। ৩৫ মামলার আসামি এই এনামুল পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণকারী ১০২ মাদক মাফিয়ার একজন। জেল থেকে বেরিয়েই তিনি টেকনাফে আবারও ইয়াবার কারবার চালু করেন। অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি হয়ে ওঠেন নব্য ইয়াবা গডফাদার। প্রকাশ্যে একজন ব্যবসায়ীর দুই হাত বিচ্ছিন্ন করার পর খি ত হাত নিয়ে টেকনাফে ঘুরে বেড়ানো এই মাদক মাফিয়া নিজের শক্তি-সামর্থ্য জানান দেন। সূত্র জানান, উখিয়ায় নবী হোসেন এবং সোনালী আর টেকনাফের এনামুল এখন ইয়াবার নব্য গডফাদার। এরাই মূলত দেশের ইয়াবা কারবার নিয়ন্ত্রণ করছেন।

পুলিশ ও গোয়েন্দা সূত্র জানায়, দুই বছর আগেও ইয়াবা প্রবেশের প্রধান দরজা ছিল বাংলাদেশের শেষপ্রান্ত টেকনাফ। হালে এই মাদক কারবারের পুরো নিয়ন্ত্রণ এখন রোহিঙ্গাদের হাতে। উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্পই এখন বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ মাদকের আখড়া। এখান থেকেই ইয়াবা ও আইস সরবরাহ করা হচ্ছে দেশের ৬৪টি জেলায়।

জানা গেছে, মিয়ানমার সীমান্তের কুমিরখালী, পার্শ্ববর্তী চাকমাকাটা, কোয়াঞ্চিবন, ঢেঁকিবুনিয়াসহ আশপাশের আরও কয়েকটি সীমান্তঘেঁষা

 গ্রাম থেকে ইয়াবা ও আইসের চালান ঢুকছে দেদার। প্রায় প্রতিরাতেই এ মাদকের চালান বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। মাদকের সঙ্গে ঢুকছে আগ্নেয়াস্ত্রও। মাদক কারবারে জড়িত রয়েছেন, এমন কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে। মিয়ানমার-বাংলাদেশ সীমান্ত এলাকার জিরো পয়েন্টে থাকেন রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গ্রুপ আল ইয়াকিনের নেতা নবী হোসেন। এই নবী হোসেন ইয়াবা এবং আইসের কারবার নিয়ন্ত্রণ করছেন। তিনি মাদকের চালান পাঠিয়ে দেন রোহিঙ্গা ক্যাম্পের মাফিয়া হেড মাঝি সোনালীর কাছে। ওপারে নবী হোসেন এবং এপারে সোনালী- এই দুজনে বর্তমানে উখিয়া কেন্দ্রিক মাদক ইয়াবা আর আইস কারবারের নিয়ন্ত্রক। যদিও এদের দলে রয়েছে অন্তত ১০ হাজার সদস্য। হেড মাঝি সোনালীর বাবার নাম সয়েদ আলম। তার সহযোগী আরও আছেন হোসেন মুরাদ, জাফর, শমসু। এরা ইয়াবা এবং আইস সারা দেশে সরবরাহ  করেন।

ইয়াবা এবং আইসের গডফাদার নবী হোসেনকে ফেব্রুয়ারি মাসে জীবিত অথবা মৃত ধরিয়ে দিতে ১০ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। তবে এখনো তাকে ধরা যায়নি। গোয়েন্দা সংস্থাগুলো থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে ইয়াবা-আইসের বড় চালান পাচার করাই নবী হোসেনের প্রধান কাজ। সীমান্তের কাছাকাছি পাঁচটি ক্যাম্পে তার আসা-যাওয়া রয়েছে। মিয়ানমারের বিজিপির সহায়তায় তিনি দেশের এক নাগরিকের মাধ্যমে দিয়েছেন চিংড়ির ঘের। ক্যাম্পে তার ৩০ সহযোগীর নাম-পরিচয় পাওয়া গেছে। তাদের মূল কাজ মাদক পাচার ও অর্থ লেনদেন। তিন বছর আগে রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (আরএসও) ছেড়ে ‘নসরুল্লাহ নবী’ গ্রুপ তৈরি করেন নবী হোসেন। তিনি আল ইয়াকিনের নেতা।

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অপরাধ দমনে কাজ করা গোয়েন্দা সংস্থার এক কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা ইতোমধ্যে নবী হোসেনের অপরাধ কর্মকা  নিয়ে তদন্ত প্রতিবেদন ঢাকায় পাঠিয়েছি। আমাদের তদন্তে মিয়ানমার থেকে মাদকের বড় চালান পাচারের সঙ্গে জড়িত পাঁচটি ‘রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী’ গ্রুপের নাম উঠে এসেছে। এর মধ্যে অন্যতম নবী হোসেন গ্রুপ। স্থল ও নদীপথ- উভয় পথেই বেশির ভাগ মাদক চালান নবী হোসেনের হাত ধরে বাংলাদেশে আসে। মিয়ানমারে অবস্থান করলেও মাদক বাংলাদেশে নিয়ে আসে নবী।

টেকনাফের নতুন গডফাদার হলেন এনামুল হক। আত্মস্বীকৃত ইয়াবা কারবারি ও তালিকাভুক্ত মাদক ব্যবসায়ী তিনি। মৃত মোজাহার মিয়ার ছেলে এই এনামুল হলেন আত্মসমর্পণকারী ১০২ মাদক মাফিয়ার একজন। তার বাড়ি নাজিরপাড়ায়। জেল থেকে বের হওয়ার পর ফের ৩৩ হাজার ইয়াবা নিয়ে বিজিবির হাতে আটক হয়েছিলেন এনামুল। পুলিশ জানায়, তার বিরুদ্ধে ৩৫টি মামলা রয়েছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ১০২ মাদক কারবারির মধ্যে অন্তত ৭৫ জন ফিরেছেন মাদক কারবারে। ‘রাজপ্রাসাদে’ ফিরতে শুরু করেছেন টেকনাফের ইয়াবা ‘রাজা’রা। আবারও আলো ঝলমল হয়ে উঠেছে এসব বাড়ি। ফিরেছে সেই জৌলুস। শুধু তাই নয়, এরাই গত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে প্রার্থী হয়ে নির্বাচিত হয়ে এসেছেন।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ১০২ জনের মধ্যে ডেইলপাড়ার আবদুল আমিন, নুরুল আমিন, এনামুল হক, সাহেদ কামাল, মোজাম্মেল হক, জুবায়ের হোসেন, নুরুল বশর, কামরুল হাসান, নুরুল কবি, মো. জামাল, হাবিবুর রহমান, শামসুল আলম, আবদুল গনি, মোহাম্মদ আলী, মো. সিরাজ, মো. তৈয়ব, আশ আজম, জাফর আহমেদ, নুরুল আলম, আবু তৈয়ব, আলী নেওয়াজ, জহুর আলম, হুসাইন, ছিদ্দিক, রবিউল আলম, মঞ্জুর আলী, হামিদ হোসেন, মো. আলম, আইয়ুব আলী, নুরুল আমিন, বোরহান উদ্দিন, ইমান হোসেন, রহিমউল্লাহ, মো. রফিক, মো. হেলাল, বদিউর রহমান, আবদুল কুদ্দুস, আলী আহম্মেদসহ ৭৫ জন মাদক কারবারে ফিরে গেছেন।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর