শনিবার, ৮ জুলাই, ২০২৩ ০০:০০ টা

ডেঙ্গুঝুঁকিতে শিশুরা

বাড়ি ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সতর্কতার পরামর্শ

জয়শ্রী ভাদুড়ী

ডেঙ্গুঝুঁকিতে শিশুরা

রাজধানীসহ সারা দেশে ভয়ংকর রূপ নিচ্ছে ডেঙ্গু পরিস্থিতি। রোগীর চাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসক, নার্স ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। ছবিটি গতকাল মুগদা হাসপাতাল থেকে তোলা -বাংলাদেশ প্রতিদিন

হাতে ক্যানোলা লাগানো ছোট্ট হুমাইরার (২)। জ্বর, বমি, পেটে ব্যথায় কাহিল শরীর। মোবাইলে কার্টুন দেখিয়ে স্যুপ খাওয়ানোর চেষ্টা করছেন হুমাইরার মা মায়মুনা বেগম। তিনি বলেন, ‘১ জুলাই মেয়ের প্রচ- জ্বর হয়। ডেঙ্গুজ্বর কি না সন্দেহ করে টেস্ট করালে পজিটিভ আসে। চিকিৎসকের পরামর্শে বাসায় রেখেই চিকিৎসা করছিলাম। কিন্তু বমি আর শ্বাসকষ্ট শুরু হলে দ্রুত যাত্রাবাড়ী থেকে শিশু হাসপাতালে নিয়ে আসি। দ্রুত না আনলে বিপদের শঙ্কা ছিল বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। এখন মেয়ে অনেকটাই ভালো আছে। দু-এক দিনের মধ্যে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেবে বলে জানিয়েছেন।’ সারা দেশে বাড়ছে ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্তের সংখ্যা। রাজধানীর সরকারি বেসরকারি হাসপাতালগুলোয় ডেঙ্গু রোগীর চাপ বাড়ছে। আক্রান্তের বড় অংশ শিশু। অল্পতেই নাজুক হয়ে পড়ছে তারা। এর মধ্যে ডেঙ্গুর থাবায় শিশুমৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে। তাই শিশুদের ডেঙ্গুর প্রকোপ থেকে বাঁচাতে সচেতন থাকার পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসকরা। জ্বর এলে দ্রুত টেস্ট করাতে হবে। আক্রান্ত হলে চিকিৎসকের পরামর্শে ওষুধ এবং তরল খাবারে জোর দিতে হবে। পেটে ব্যথা, প্রচ- বমি, শ্বাসকষ্ট হলে দেরি না করে হাসপাতালে নিতে হবে। এ সময় শিশুদের পুষ্টিকর ও ভিটামিন সি-জাতীয় খাবার খাওয়াতে পরামর্শ দিচ্ছেন চিকিৎসকরা; যাতে শিশুদের শারীরিক অবস্থা ভালো থাকে। ইমেরিটাস অধ্যাপক ও প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ বলেন, ‘শিশুরা ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে বিপদ বেড়ে যায়। শিশুরা অল্পতেই শকে চলে যায়। কিডনি, লিভার ফেইলিওর শিশুদের খুব দ্রুত হয়। সে কারণে ডেঙ্গুতে শিশুদের মধ্যে মৃত্যুহার বেশি।’ তিনি আরও বলেন, ‘দিনের বেলা শিশুরা ঘুমালে মশারি টানাতে হবে, ফুল প্যান্ট পরিয়ে রাখতে হবে। জ্বর এলে অবহেলা না করে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। কোথাও স্বচ্ছ পানি জমিয়ে রাখা যাবে না। সচেতন থেকে ডেঙ্গু রুখতে হবে।’

স্বাস্থ্য অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, গতকাল ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১৮২ জন। এ সময় মারা গেছেন একজন। তবে শুক্রবার সব হাসপাতালের হিসাব না আসায় রোগীর সংখ্যা কম হয়েছে। এ বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন ১১ হাজার ২৯৮ জন। এ পর্যন্ত মারা গেছেন ৬৫ জন। বর্তমানে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন ২ হাজার ১৬৫ জন। এর মধ্যে ঢাকার হাসপাতালে ভর্তি আছেন ১ হাজার ৫২৮ জন। সবচেয়ে বেশি রোগী ভর্তি আছেন রাজধানীর মুগদা জেনারেল হাসপাতালে। ভর্তি ২ হাজার ৫২০ জনের মধ্যে শিশু এক চতুর্থাংশ। বাংলাদেশ শিশু হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ৪৩ শিশু ভর্তি আছে। এর মধ্যে এক শিশু আইসিইউতে, দুটি শিশু এইচডিইউতে চিকিৎসাধীন আছে। হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. জাহাঙ্গীর আলম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘হাসপাতালে অধিকাংশ শিশু খারাপ অবস্থায় আসছে। দেরিতে আসায় জটিলতা বাড়ে। তাই পেটে ব্যথা, বমি, কিছু খেতে না পারা, প্রচ- মাথাব্যথা, শ্বাসকষ্ট হলে দ্রুত হাসপাতালে আসতে হবে। জ্বর এলে তিন দিনের মধ্যে ডেঙ্গু টেস্ট করাতে হবে। আক্রান্ত হলে পর্যাপ্ত পানি, তরল খাবার, স্যুপ খেতে হবে।’ ডেঙ্গুজ্বর হলে খাবার ও পুষ্টির দিকে খেয়াল রাখার পরামর্শ দিয়েছেন পুষ্টিবিদরা। চট্টগ্রামের অ্যাপোলো ইমপেরিয়াল হসপিটালের প্রধান পুষ্টিবিদ মাহফুজা আফরোজ সাথী বলেন, ‘ডেঙ্গু রোগীর খাদ্য ও পুষ্টির প্রতিও রাখতে হবে বিশেষ নজর। যারা হাসপাতালে থাকবেন তাদের আইভি ফ্লুইডের পাশাপাশি মুখে তরল খাবার দিয়ে ফ্লুইড ব্যালান্স করতে হবে। যারা বাসায় আছেন তাদের পানিসহ অন্যান্য তরল মিলে ৩ লিটার সারা দিনে মুখে খাওয়া নিশ্চিত করতে হবে। তা ছাড়া জ্বরে ক্যালোরি চাহিদা বেড়ে যায়। তাই ক্যালোরিযুক্ত খাবার বেশি খেতে হবে। এ সময় মুখে রুচিও থাকে না। তাই এমন খাবার দিতে হবে যা অল্প খেলেও চাহিদা মেটাতে সক্ষম হবে। যেমন ভাতের পরিবর্তে খিচুড়ি, পায়েস, ফিরনি বা পুডিং দেওয়া যেতে পারে। ফলে একটা খাবার থেকেই সব উপাদান পাওয়া যাবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘মুখে ফলের রস, ডাবের পানি, স্যুপ ইত্যাদি পর্যাপ্ত পরিমাণে দিতে হবে। যদি জ্বরের সঙ্গে পাতলা পায়খানা বা ডায়রিয়া ও বমি হয় তবে শাকসবজি, ডাল, দুধ ও দুধে তৈরি খাবার বাদ দিতে হবে। এ অবস্থায় ডাবের পানি, মুরগির স্যুপ, চালের স্যুপ বা ভাতের মাড়, আপেলের জুস খুব ভালো কাজ করে।’

ঈদের ছুটি শেষে আগামী রবিবার সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলবে। দীর্ঘ ছুটিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ ছিল, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কোনো কার্যক্রম ছিল না। ঈদের সময়ে দেশে পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত হয়েছে। এতে এডিস মশা বেড়েছে এবং ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বৃদ্ধি পেয়েছে। অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভিতর বা বাইরে নানা ধরনের পাত্রে পানি জমা হয়ে এডিস মশার প্রজনন ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কীটতত্ত্ববিদ ড. কবিরুল বাশার বলেন, ‘অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভিতর বা বাইরে নানা ধরনের পাত্রে পানি জমা হয়ে এডিস মশার প্রজনন ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় মাঠ পর্যায়ের গবেষণায় আমরা এডিস মশার ঘনত্ব বিপজ্জনক মাত্রায় পাচ্ছি। ডেঙ্গু রোগের সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকেন শিশু ও বয়স্করা। তাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার আগে ডেঙ্গু প্রতিরোধে কর্তৃপক্ষের ও অভিভাবকদের বিশেষ কিছু কার্যক্রম গ্রহণ করা উচিত।’ তিনি আরও বলেন, ‘প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভিতর ও বাইরে ভালো করে পরিষ্কার করে নিতে হবে। বিশেষ করে টয়লেটের কমোড, প্যান পরীক্ষা করে দেখতে হবে কারণ এখানেও আমরা মশার লার্ভার অস্তিত্ব পেয়েছি। পানির ট্যাংকি, ওয়াসার মিটার, ছাদ এবং নিচতলার ফ্লোরগুলো ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে দেখতে হবে কোথাও কোনো জায়গায় পানি জমা আছে কি না। যদি কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নির্মাণাধীন ভবন থাকে তাহলে সেটি বেশ ঝুঁকির।’

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর