সোমবার, ১০ জুলাই, ২০২৩ ০০:০০ টা

উৎসে করে সর্বনাশ আবাসনে

জমি ফ্ল্যাট নিবন্ধনে বাড়ছে ২৪ থেকে ৬০ গুণ কর, বিনিয়োগ হারানোর শঙ্কা, ক্ষতিগ্রস্ত হবে সংশ্লিষ্ট ২০ হাজার কারখানা, বেকার হতে পারেন ১ কোটি কর্মী, বাড়বে বিদেশে অর্থ পাচার

নিজস্ব প্রতিবেদক

উৎসে করে সর্বনাশ আবাসনে

নির্বাচনের বছরে জমি ও ফ্ল্যাট নিবন্ধনে উৎসে কর ২৪ গুণ একসঙ্গে বাড়ায় সর্বনাশা পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে দেশের আবাসন শিল্পে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই কর ক্ষেত্রবিশেষে ৫০ থেকে ৬০ গুণ বেড়ে যেতে পারে। এতে আবাসন শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ২০ হাজার শিল্প কারখানা বন্ধ ও ১ কোটি মানুষ বেকার হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ পরিস্থিতিকে সরকারের বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখছেন সংশ্লিষ্টরা।

অতিরিক্ত এই কর আরোপ আবাসন খাতের জন্য ভয়াবহ হুমকি বলেও মনে করছে বাংলাদেশ ল্যান্ড ডেভেলপার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএলডিএ)। গত ৬ জুলাই সংগঠনের সভাপতি ও বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান এক চিঠিতে প্রধানমন্ত্রীর কাছেও এমন আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। ভূমি উন্নয়ন সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের মালিকদের এই সংগঠনটি মনে করে, জমি নিবন্ধনে অতিরিক্ত কর আরোপের কারণে দেশের আবাসন খাতে বিনিয়োগ কমবে। পাশাপাশি অনেকেই দেশের বাইরে বাড়িঘর করতে আগ্রহী হবেন, বাড়বে বিদেশে অর্থ পাচার।

নিবন্ধনে উৎসে কর অতিরিক্ত বৃদ্ধিকে নজিরবিহীন বলে মনে করেন এ খাতের ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, আগে মানুষ জমিতে বিনিয়োগ লাভজনক ও নিরাপদ মনে করতেন। এখন এই অতিরিক্ত কর বৃদ্ধিতে ঢাকা বা বড় শহরে জমিতে বিনিয়োগ করা অলাভজনক মনে করবে। এ অবস্থায় জমি বেচাকেনা কমবে। এতে সরকার হারাবে বিপুল অঙ্কের রাজস্ব। তারা বলেন, নির্বাচনের আগে হঠাৎ এমন সিদ্ধান্ত আবাসন খাতের জন্য বড় ধরনের হুমকি। এটি সরকারের বিরুদ্ধেও গভীর ষড়যন্ত্র।

সংশ্লিষ্টরা আরও জানান, জমি-ফ্ল্যাট ছাড়াও আবাসন খাতের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে প্রায় ২০ হাজার শিল্প কারখানা। একটি বাড়ি বা ভবন তৈরিতে ইট, বালি, সিমেন্ট, রড, টাইলস ও বৈদ্যুতিক সামগ্রীসহ পাঁচ শতাধিক পণ্য ব্যবহার হয়। রেজিস্ট্রেশনের কারণে জমি ক্রয় খরচ বাড়লে বাড়ি নির্মাণও কমে যাবে। আর বাড়ি নির্মাণ কমে গেলে সংযুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলো সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আর এতে বেকার হতে পারেন এসব প্রতিষ্ঠানে কাজ করা প্রায় ১ কোটি মানুষ। জানা গেছে, আয়কর আইন ২০২৩-এর আওতায় উৎসে কর বিধিমালায় নতুন ওই কর নির্ধারণ করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। গত ২৬ জুন এ সংক্রন্ত বিধিমালা গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়েছে। বিধিমালা অনুযায়ী, দেশের যে কোনো এলাকায় স্থাবর সম্পত্তি বা জমি ও ফ্ল্যাটের মালিকানা হস্তান্তর এলাকাভিত্তিক ২৪ গুণ বা কোথাও এর চেয়েও বেশি কর গুনতে হবে। ক্রেতাকে জমি, ফ্ল্যাট বা যে কোনো স্থাপনা নিবন্ধনের জন্য শুধু উৎসে কর হিসেবে কাঠাপ্রতি ৩ লাখ টাকা থেকে ২০ লাখ টাকা দিতে হবে। যা ইতিপূর্বে ছিল ১ লাখ ৬ হাজার ৫০০ থেকে সর্বোচ্চ ২ লাখ টাকা। আয়কর বিধিমালার সম্পত্তি হস্তান্তর থেকে কর আদায় শীর্ষক ৬ নম্বর ধারা অনুসারে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় সম্পত্তি নিবন্ধন কর ৪ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৮ শতাংশ করা হয়েছে। গাজীপুর, মুন্সীগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, নরসিংদী এবং ঢাকা ও চট্টগ্রাম এলাকায় সিটি করপোরেশনের বাইরের এলাকা ও জেলা সদরে অবস্থিত পৌরসভা এলাকায় উৎসে কর ৩ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৬ শতাংশ করা হয়েছে। এর পাশাপাশি দেশের যে কোনো পৌরসভার আওতাধীন সম্পত্তি কর ২ শতাংশ থেকে ৪ শতাংশ এবং বাকি এলাকাগুলোয় ১ শতাংশ থেকে কর বাড়িয়ে ২ শতাংশ করা হয়েছে। গত ১ জুন অর্থমন্ত্রী তাঁর বাজেট বক্তৃতায় এ বিষয়ে প্রস্তাবনা দেন। আর ওই প্রস্তাব বিধিমালায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

কর পুনর্নির্ধারণের অনুরোধ বিএলডিএর : প্রধানমন্ত্রীকে দেওয়া চিঠিতে বিএলডিএ বলেছে, গত ২০২২-২৩ অর্থ বছরের বাজেটে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও চট্টগ্রাম শহরের বিভিন্ন এলাকার অবস্থিত জমি, জমিসহ বাড়ি, যে কোনো স্থাপনা বাড়ি, ফ্ল্যাট, অ্যাপার্টমেন্ট অথবা ফ্লোর স্পেস হস্তান্তরের ক্ষেত্রে শুধু উৎসে কর হার ছিল দলিল মূল্যের ওপর ৪ শতাংশ। কিন্তু ২০২৩-২৪ অর্থ বছরের বাজেটে ৪ শতাংশের পরিবর্তে দলিল মূল্যের ওপর ৮ শতাংশ অথবা বিভিন্ন এলাকার ওপর ভিত্তি করে কাঠাপ্রতি ২০ লাখ, ১২ লাখ, ১০ লাখ, ৮ লাখ, ৬ লাখ ও ৩ লাখ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। ফলে এলাকাভেদে কর হার ২৪ থেকে ৬০ গুণ বৃদ্ধি করা হয়েছে।

চিঠিতে আরও বলা হয়, এত বেশি কর নির্ধারণের কারণে জনগণ জমি, বাড়ি, ফ্ল্যাট ইত্যাদিতে বিনিয়োগ করতে নিরুৎসাহিত হবে। এ ছাড়া দেশের বাহিরে বিনিয়োগে আগ্রহী হবে তারা। এসব কারণে বিদেশে অর্থ পাচারেরও সম্ভাবনা রয়েছে। এতে সরকারের রাজস্ব হারানোর পাশাপাশি দেশের আবাসন খাতে চরম অস্থিরতা দেখা দেবে। উচ্চ কর হার অযৌক্তিক, অমানবিক, স্বেচ্ছাচারী এবং বাস্তবায়নের অযোগ্য উল্লেখ করে বাড়ি, ফ্ল্যাট ও জমি রেজিস্ট্রেশন কর সহনীয় পর্যায়ে আনার লক্ষ্যে উৎসে কর পুনর্নির্ধারণের অনুরোধ জানানো হয়েছে চিঠিতে। উক্ত কর বৃদ্ধির কারণে জমি বেচাকেনা কম হবে, ফলে সরকারের রাজস্ব আদায় কমে যাবে। এ ছাড়াও আবাসন ব্যবসার সঙ্গে প্রায় ১০ হাজার শিল্পপ্রতিষ্ঠান প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত এবং ১ (এক) কোটি লোকের কর্মসংস্থান। উৎসে করসহ অন্যান্য কর কমানো না হলে ১০ হাজার শিল্পপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাবে এবং ১ কোটি লোক বেকার হয়ে যাবে। যার ফলে দেশে সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা দেবে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর