বুধবার, ১২ জুলাই, ২০২৩ ০০:০০ টা

নির্বাচন কমিশনের সক্ষমতা জানতে চায় ইইউ

নিজস্ব প্রতিবেদক

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি, সক্ষমতা, আইনি কাঠামো নিয়ে নির্বাচন কমিশনের কাছে জানতে চেয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) অনুসন্ধানী দল। গতকাল সকালে প্রায় ঘণ্টাব্যাপী বৈঠকে নির্বাচন সংশ্লিষ্ট খুঁটিনাটি বিষয় নিয়েও প্রশ্ন করেছে দলটি। নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার তাদের সব প্রশ্নে জবাব দেন। নির্বাচন কমিশন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনে নিজেদের সক্ষমতা ইউরোপীয় প্রতিনিধিদের সামনে তুলে ধরেছে। পাশাপাশি এটাও জানিয়েছে, ভোট দেখতে ইইউ ‘নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষক’ পাঠালে তাতে কমিশনের কোনো আপত্তি নেই। নির্বাচন কমিশন ছাড়াও সফরের তৃতীয় দিনে স্বারষ্ট্র মন্ত্রণালয়, আটর্নি জেনারেলের কার্যালয় ও দেশীয় পর্যবেক্ষকদের একটি দলের সঙ্গেও তারা আলাদা আলাদাভাবে দিনভর বৈঠক করেছেন। 

গতকাল বেলা ১১টায় নির্বাচন ভবনের সম্মেলন কক্ষে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বে নির্বাচন কমিশনার রাশেদা সুলতানা ও আনিছুর রহমান এবং ইসির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে রিকার্ডো শেলেরির নেতৃত্বে ইইউ প্রতিনিধিদলে ছিলেন পাঁচজন। বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, বৈঠকে সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি, বর্তমান কমিশনের অধীনে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন নির্বাচনের তথ্য তুলে ধরেন। সিইসি বলেন, ইসি ৯১১টি নির্বাচন অনুষ্ঠান করেছে। সব নির্বাচন সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হয়েছে। গণমাধ্যম নির্বাচনে স্বাধীনভাবে কাজ করেছে। অনেকগুলো নির্বাচনে সিসি ক্যামেরা ব্যবহার করা হয়েছে। তখন ইইউর প্রতিনিধি দল জানতে চায়, সিসি ক্যামেরা ব্যবহারের ফলে ভোটারের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা লঙ্ঘিত হয় কি না। তখন ইসি জানায়, সিসি ক্যামেরা ভোট কক্ষে থাকে। ভোট দেওয়ার গোপন বুথ সিসি ক্যামেরার আওতায় থাকে না। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সিসি ক্যামেরা থাকবে কি না, সেটাও জানতে চেয়েছিলেন ইইউ প্রতিনিধিরা। জবাবে সিইসি জানান, এখনো এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। এ ছাড়া তারা নির্বাচনের আইনি কাঠামো সম্পর্কেও জানতে চেয়েছিলেন। তখন সিইসি নির্বাচন সংক্রান্ত বিধিবিধান সম্পর্কে ধারণা দেন এবং সংসদ নির্বাচনে অনলাইনের মনোনয়নপত্র দাখিলের সুযোগ দেওয়া ও গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও)-কে আরও নির্বাচন উপযোগী করা হয়েছে বলেও জানান। অপর একটি সূত্র জানিয়েছে, বৈঠকে সিইসি স্বাগত বক্তব্যে বলেন- ইসি একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন চায়; তবে কোনো দলকে নির্বাচনে আনা ইসির এখতিয়ারের মধ্যে পড়ে না। বৈঠক শেষে রিকার্ডো শেলেরি সাংবাদিকদের বলেন, নির্বাচনপূর্ব পরিস্থিতি মূল্যায়ন করতে তারা দুই সপ্তাহের জন্য এসেছেন। মূল্যায়ন শেষে তারা ইইউর উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদের কাছে একটি প্রতিবেদন দেবেন। এর আলোকে ইইউর উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তারা আগামী জাতীয় নির্বাচনে জোটের পর্যবেক্ষক দল পাঠানোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন। পরে বৈঠকের বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য সাংবাদিকদের সামনে তুলে ধরেন ইসির অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ। তিনি বলেন, ইইউর প্রতিনিধিদল প্রধানত নির্বাচনী প্রস্তুতি সম্পর্কে ইসির কাছে জানতে চেয়েছে। বিশেষ করে ভোটার, ভোট কেন্দ্র, পর্যবেক্ষক, সিসি ক্যামেরা নিয়ে তারা জানতে চেয়েছে। নির্বাচন কমিশন সুষ্ঠু নির্বাচন করতে সক্ষম কি না, সে বিষয়ে জানতে চেয়েছে। ইসি বিষয়গুলো ব্যাখ্যা করেছে। ইইউর প্রতিনিধিদল সন্তুষ্ট। অতিরিক্ত সচিব বলেন, পর্যবেক্ষক পাঠানোর বিষয়ে কী কী প্রস্তুতি নিতে হয়, ইসি কী করবে, তা জানতে চেয়েছে ইইউর প্রতিনিধিদল। কমিশন বলেছে, তারা যত সংখ্যক ইচ্ছে পর্যবেক্ষক পাঠাতে পারে, এর কোনো সীমাবদ্ধতা নেই। আবেদনের জন্য সময়সীমা আছে কি না, তা জানতে চেয়েছে তারা। ইসি বলেছে, সেপ্টেম্বরের মধ্যে আবেদন এলে সুবিধা হয়। কারণ, আরও কিছু আনুষ্ঠানিকতা আছে। স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ছাড়পত্রের বিষয়ও রয়েছে। তারা (ইইউ) যদি নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষক পাঠায়, যত সংখ্যক চায় পাঠাক, কোনো আপত্তি নেই নির্বাচন কমিশনের। ইইউর প্রতিনিধিদলের কারিগরি সদস্যরা ইসির আইনি বিষয়গুলো নিয়ে কমিশনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আবার বৈঠক করবেন বলে জানান অশোক কুমার দেবনাথ। এক প্রশ্নের জবাবে ইসির অতিরিক্ত সচিব বলেন, বর্তমান কমিশনের অধীন এখন পর্যন্ত ৯১১টি নির্বাচন হয়েছে। এতে সন্তোষ রয়েছে ইইউর প্রতিনিধিদলের। পরিবেশ নিয়ে এখন পর্যন্ত ইইউর প্রতিনিধিদল সন্তুষ্ট। তবে তারা আরও আলোচনা করবে। ১৮ থেকে ২২ জুলাইয়ের মধ্যে তারা আবার ইসির কারিগরি দলের সঙ্গে বসবে। অপর এক প্রশ্নের জবাবে অশোক কুমার দেবনাথ বলেন, নির্বাচনকালীন সরকার ইসির বিষয় নয়। এ নিয়ে বৈঠকে আলোচনা হয়নি। রাজনৈতিক দলগুলোকে ভোটে আনার বিষয়ে ইইউর প্রতিনিধিদল কিছু জানতে চায়নি। নির্বাচনকালীন সরকার ও কোনো দলকে ভোটে আনার বিষয় বৈঠকের আলোচনায় আসেনি। ইসির অতিরিক্ত সচিব জানান, ইসির সক্ষমতা নিয়ে ইইউর প্রতিনিধিদল সন্তুষ্টি বা অসন্তুষ্টি কিছুই প্রকাশ করেনি। নির্বাচনে সব দল অংশগ্রহণ করবে কি না, তা নিয়েও তারা জানতে চায়নি। বাংলাদেশ সরকারের আমন্ত্রণে জাতীয় নির্বাচনের পরিবেশ ও নির্বাচনপূর্ব রাজনৈতিক পরিস্থিতি পর্যালোচনায় ইইউর নির্বাচনসংক্রান্ত তথ্যানুসন্ধানী দলটি গত শনিবার ১৬ দিনের সফরে ঢাকায় আসে।

অ্যাটর্নি জেনারেলের সঙ্গে বৈঠক, বিএনপিপন্থি আইনজীবীদের বিক্ষোভ : রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা (অ্যাটর্নি জেনারেল) এ এম আমিন উদ্দিনের সঙ্গে বৈঠক করেছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) প্রতিনিধিদল। গতকাল সুপ্রিম কোর্ট এলাকায় অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয়ে দুপুর ২টা থেকে ঘণ্টাব্যাপী এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে প্রতিনিধি দলের সঙ্গে আলোচনার বিষয়ে জানতে চাইলে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, আরপিও, ফৌজদারি-দেওয়ানি আইন এবং নাগরিকের অধিকার সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলেন তারা। এসব আইনের প্রয়োগ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, আলোচনায় সুনির্দিষ্ট কিছু ছিল না। সাধারণত বাংলাদেশের আইন সম্পর্কেই তারা জানতে চেয়েছেন। আইনগুলোতে কী আছে না আছে, তা আমি বলেছি। এদিকে বৈঠক চলাকালে ও বৈঠক শেষে অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ করেছেন বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা। বিক্ষোভে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সরকারকে চাপ দিতে ইইউ প্রতিনিধি দলের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেন তারা। বিক্ষোভে তারা ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস, উই ওয়ান্ট কেয়ারটেকার, নো মোর হাসিনা, উই ওয়ান্ট ফ্রি ফেয়ার ইলেকশন, ডিএসএ ইজ এ ব্ল্যাক ল’ ইত্যাদি স্লোগান দেন। বেলা ৩টার দিকে বৈঠক শেষে ইইউ প্রতিনিধিদল বের হওয়ার সময় বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা তাদের ঘিরে এসব স্লোগান দেন। কাগজে লেখা স্লোগান প্রদর্শন করেন। বিক্ষোভে নেতৃত্ব দেন ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন, ব্যারিস্টার কায়সার কামাল, ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল, অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম সজল প্রমুখ।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে বৈঠকে চাইল নিরাপত্তা : নিরাপত্তা চাইল দুই সপ্তাহের জন্য বাংলাদেশে আসা ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) নির্বাচনী অনুসন্ধানী দল। গতকাল তিন সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের যুগ্ম সচিব আবু হেনা মোস্তফা জামানের সঙ্গে দেখা করে নিরাপত্তার বিষয়ে সহযোগিতা চেয়েছেন। বৈঠকের একটি সূত্র জানায়, বেলা পৌনে ১২টার দিকে ইইউ প্রতিনিধি দলের সদস্যরা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আসেন। দুপুর ১২টার দিকে তাদের এ বৈঠক শুরু হয়। সংক্ষিপ্ত বৈঠকে ইইউ প্রতিনিধি দলের সদস্যরা তাদের দুই সপ্তাহের বিভিন্ন কর্মসূচি সম্পর্কে অবহিত করেন। বলেন, এ নির্ধারিত সফরে তারা দেশের বিভিন্ন স্থানে যাবেন এবং সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলবেন। এ জন্য তারা নিরাপত্তা চান। বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের যুগ্ম সচিব আবু হেনা মোস্তফা জামান জানান, ইইউ প্রতিনিধি দলের তিন সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল এসেছিলেন। তারা তাদের চলাচলে নিরাপত্তা চেয়েছেন। আমরা তাদের নিরাপত্তার বিষয়ে আশ্বস্ত করেছি। এ সময় মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন শাখাপ্রধানরাও উপস্থিত ছিলেন।

ইলেকশন মনিটরিং ফোরামের সঙ্গে বৈঠক : রাজধানীর গুলশানে ইইউ রাষ্ট্রদূতের বাসায় ইলেকশন মনিটরিং ফোরাম (ইএমএফ) নামের একটি বেসরকারি পর্যবেক্ষক সংস্থার সঙ্গে বৈঠক করেছেন ইইউ নির্বাচনী অনুসন্ধানী দল। বৈঠক শেষে ইএমএফের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মোহাম্মদ আবেদ আলী সাংবাদিকদের বলেন, নির্বাচন কমিশনের সক্ষমতা, সরকারের যে সহযোগিতা সেটি তাদের সামনে আমরা তুলে ধরেছি। তারা আমাদের কথা নোট করেছেন। আগামী নির্বাচনে ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধিদল আসবে বলে জানিয়েছেন। পাশাপাশি তারা প্রত্যাশা করেন বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক দল আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেবে। প্রতিনিধি দলটি শুধু ২০১৮ নয়, ১৯৯৬ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত সবগুলো নির্বাচন নিয়ে কথা বলেছেন। আমরা উনাদের সামনে সবগুলো নির্বাচনের চিত্র তুলে ধরেছি। তারা এ বিষয়ে আগে থেকেই অবগত। দলে একজন প্রতিনিধি আছেন, যিনি এর আগে নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করেছেন। তিনি বলেন, প্রতিনিধিরা সংবিধানে নেই এমন কোনো কথা বলেননি। তত্ত্বাবধায়ক বিষয়েও কোনো কিছু জানতে চাননি। এ বিষয়ে তারা কোনো আগ্রহ দেখাননি। ইএমএফের পক্ষে উপস্থিত ছিলেন ফোরামের উপদেষ্টা সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) শাহাদাত হোসেন চৌধুরীসহ অন্যরা।

 

সর্বশেষ খবর