শুক্রবার, ১৪ জুলাই, ২০২৩ ০০:০০ টা
হঠাৎ খোকার চুক্তি বাস্তবায়নে সিটির তৎপরতা

গুলশান রণক্ষেত্র, ব্যবসায়ীদের অবরোধ বিক্ষোভ ভোগান্তি

নিজস্ব প্রতিবেদক

গুলশান রণক্ষেত্র, ব্যবসায়ীদের অবরোধ বিক্ষোভ ভোগান্তি

গুলশানে গতকাল ব্যবসায়ীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ -বাংলাদেশ প্রতিদিন

গুলশান-১ ডিএনসিসি মার্কেটের ব্যবসায়ীদের বিক্ষোভ ও পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে রাজধানীর বিস্তীর্ণ এলাকা অচল হয়ে পড়ে। বিএনপি নেতা সাদেক হোসেন খোকা মেয়র থাকাকালে বিএনপি সমর্থিত একজন ব্যবসায়ীর সঙ্গে করা বৈষম্যমূলক চুক্তি বাস্তবায়ন করতে গেলে গতকাল এই ভয়াবহ সংকটের সৃষ্টি হয়। আওয়ামী লীগ ক্ষামতায় আসার পর অতীতের সব মেয়র বৈষম্যমূলক চুক্তিটি বাস্তবায়নের বিষয়টি এড়িয়ে গেছেন। কিন্তু সম্প্রতি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলামের অতি উৎসাহে খোকার করা সেই চুক্তি বাস্তবায়নে হঠাৎ তৎপর হয়ে উঠে ডিএনসিসি। আমেরিকার গুরুত্বপূর্ণ প্রতিনিধি দল যখন গুলশানে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছিলেন এবং তিন দিন পর গুলশানের নির্বাচন নিয়ে সবাই যখন প্রচার-প্রচারণায় ব্যস্ত, ঠিক তখনই সেই বৈষম্যমূলক চুক্তি বাস্তবায়নে সিটি করপোরেশনের অতি উৎসাহী তৎপরতা বিস্ময়কর বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

জানা গেছে, ডিএনসিসির নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট জুলকার নায়ন এবং মাহবুব হাসান গতকাল বেলা সাড়ে ১১টার দিকে গুলশান

শপিং সেন্টার গিয়ে সিলগালা করে দেন। এ সময় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে তাদের বাগবিতন্ডাও হয়। ছয় তলাবিশিষ্ট ওই ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় সবাইকে দোকান থেকে বের করে দেন। এরপর তিনি মার্কেটের দুই ফটক খোলা রেখে বাইরের সব ফটক সিলগালা করেন। ওই মার্কেটে ৫ শতাধিক দোকান আছে।

সিটি করপোরেশনের সঙ্গে গোপন সমঝোতার ভিত্তিতে পারসেন্টেজ ভাগাভাগি করে বৈষম্যমূলক চুক্তিটি বাস্তবায়নের খবর ছড়িয়ে পড়লে বিক্ষোভে ফেটে পড়েন ব্যবসায়ীরা। তারা রাস্তায় নেমে পড়েন। ব্যারিকেড দিয়ে রাস্তা অবরোধ করে রাখেন। এ সময় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়। সড়ক থেকে ব্যবসায়ীদের সরাতে গেলে পুলিশের সঙ্গে তাদের বাগবিতন্ডা শুরু হয়। এক পর্যায়ে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও সংঘর্ষে রণক্ষেত্রে পরিণত হয় গুলশান-১ নম্বর চত্বর। এ সময় বৃষ্টির মতো ঢিল ছুড়তে থাকেন বিক্ষোভকারীরা। ভাঙচুর করেন অসংখ্য যানবাহন। এমন পরিস্থিতিতে আশপাশের এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিতে পুলিশও তাদের বেধড়ক লাঠিপেটা করে। প্রায় চার ঘণ্টা অবরুদ্ধ হয়ে থাকে গুরুত্বপূর্ণ অভিজাত এলাকাটি। গুলশান-১ নম্বর মোড় সিমেন্টের ব্লক দিয়ে বন্ধ করে দিলে গুরুত্বপূর্ণ এই মোড় দিয়ে যানবাহন চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়। এ সময় চারদিকের রাস্তায় আটকা পড়ে শত শত যানবাহন। এর প্রভাবে অন্যান্য সড়কেও। এতে হাতিরঝিল, মহাখালী, বনানী, গুলশান-২ এবং বাড্ডায় তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। সংঘর্ষে পুলিশসহ অন্তত ১৫ জন আহত হন।

সরেজমিনে দেখা যায়, যান চলাচল বন্ধ থাকায় বিভিন্ন পরিবহনের যাত্রীরা পড়েন চরম বিপাকে। মোটরসাইকেল নিয়ে যেতে চাইলেও আটকে দেন আন্দোলনকারীরা। বিস্তীর্ণ এলাকার সড়কগুলোতে যানবাহন আটকা পড়ে যায়। অচল হয়ে পড়ে রাজধানীর একটা বড় অংশ। এতে ভয়াবহ ভোগান্তিতে পড়ে নারী-শিশুসহ কর্মজীবী নানা শ্রেণির মানুষ।

ব্যবসায়ীদের দাবি, কোনো ধরনের সময় না দিয়ে শপিং সেন্টার সিলগালা করে দেওয়া হয়েছে। গুলশান শপিং সেন্টারের দোকান মালিক সমিতির চক্রান্তের শিকার ব্যবসায়ীরা। সেই সঙ্গে ঘটনাস্থলে দ্রুত ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়রকে এসে তাদের সঙ্গে কথা বলার অনুরোধ জানান ব্যবসায়ীরা। সে সময় ‘মার্কেটের তালা খুলতে হবে, মেয়র সাহেবকে আসতে হবে’, আন্দোলনকারীদের মুখে এমন স্লোগানও শোনা যায়। তবে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট জুলকার নায়ন বলেন, এই মার্কেট এরই মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করেছে ফায়ার সার্ভিস। পরবর্তীতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকেও বলা হয়েছে ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ। ভবনটি থেকে লোকজন সরিয়ে নেওয়ার জন্য সিটি করপোরেশনকে নির্দেশনা দেওয়া হয়। গত মাসেও ভবন বন্ধ করতে গেলে ব্যবসায়ীরা এক মাসের সময় নিয়েছিলেন। কিন্তু তারা সরেননি।

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গুলশান জোনের সরকারী কমিশনার (এসি) আবদুল্লাহ আল মাসুম বলেন, প্রায় ৪ ঘণ্টা অবরোধের পর ব্যবসায়ীদের সড়ক থেকে সরে যাওয়ার কথা বললে তারা পুলিশের ওপর চড়াও হন। এক পর্যায়ে পুলিশের ওপর ইটপাটকেল ছুড়তে থাকেন। এরপর তাদের ধাওয়া দিয়ে সড়ক থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। এ ঘটনায় গুলশান থানার পরিদর্শক (অপারেশন্স) আমিনুল ইসলামসহ পুলিশের বেশ কয়েকজন আহত হয়েছেন। 

গুলশান ট্রাফিক বিভাগের সহকারী কমিশনার (এসি) মোস্তাফিজুর রহমান বিকাল সাড়ে ৪টায় জানান, পুলিশ বিক্ষোভকারীদের সরিয়ে দিলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করে। যান চলাচল এখন স্বাভাবিক। আর কোনো সমস্যা নেই।

গুলশান থানার পরিদর্শক (প্যাট্রল) সেলিম রেজা বলেন, অনেকবার বোঝানোর পরও ব্যবসায়ীরা রাজি হননি। এক পর্যায়ে তাদের রাস্তা থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। পুলিশ যখন তাদের রাস্তা থেকে সরিয়ে দিচ্ছিল তখন তারা পুলিশকে উদ্দেশ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। এতে একজন পুলিশ সদস্য আহত হন। পরিস্থিতি এখন স্বাভাবিক রয়েছে। রাস্তায় আবারও যান চলাচল শুরু হয়েছে।

চুক্তিপত্র : ডিএনসিসি কর্তৃপক্ষ বহুতল শপিং এবং কমার্শিয়াল কমপ্লেক্স ‘সিটি ট্রেড সেন্টার’ নির্মাণের জন্য ২০০৬ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর আমিন অ্যাসোসিয়েটস ওভারসিস কোম্পানি লিমিটেডের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করে। ডেভেলপার কোম্পানি নির্ধারিত সময়ে নির্মাণকাজ শুরু করতে না পারায় পরে ২০১০ সালের ১৫ নভেম্বর সংশোধিত চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তি অনুযায়ী ডেভেলপার কোম্পানি প্রায় ৭.৪৭ বিঘা জমিতে দুটি বেজমেন্ট এবং ১টি সেমি বেজমেন্টসহ ১৯ তলাবিশিষ্ট ‘সিটি ট্রেড সেন্টার’ নির্মাণ করবে। ওই ৭.৪৭ বিঘা জমির মধ্যে ১.৬৫ বিঘা জমির ওপর কাঁচা বাজারসহ একটি দ্বিতীয় তলা এবং আংশিক চতুর্থ তলা মার্কেট এবং ৩.১২ বিঘা জমির ওপর ১টি ২য় তলাবিশিষ্ট সুপার মার্কেট রয়েছে। শর্তানুযায়ী  ডেভেলপার কোম্পানির হিসসা ৬৩ শতাংশ এবং ডিএনসিসির হিসসা ৩৭ শতাংশ।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গুলশান ১-এর মতো বাণিজ্যিক এলাকার জমির মালিককে মাত্র ৩৭ শতাংশ শেয়ার প্রদান মোটেই যুক্তিসংগত নয়। উপরন্তু ওই জমিতে ১.৬৫ বিঘা জমির ওপর কাঁচা বাজারসহ একটি ২য় তলা এবং আংশিক চতুর্থ তলা মার্কেট ও প্রায় ৩.১২ বিঘা জমির ওপর একটি দ্বিতীয় তলাবিশিষ্ট সুপার মার্কেট রয়েছে। এ ২টি মার্কেটে প্রায় ৬০০টি দোকান আছে। যার আয়তন প্রায় ৭৫ হাজার ৫৬ বর্গফুট। এ মার্কেটগুলোর আর্থিক মূল্য বিবেচনা করলে দেখা যায়, ডিএনসিসির স্বার্থ উপেক্ষা করে চুক্তিটি করা হয়েছে। সংশোধিত চুক্তিতে ওই জমির মূল্য হিসাব করা হয় ১৯৪ কোটি ২২ লাখ টাকা। এর সঙ্গে চুক্তির আওতাবদ্ধ জমিতে থাকা দুটি বহুতল মার্কেটের মূল্যই ধরা হয়নি।

সর্বশেষ খবর