রবিবার, ১৬ জুলাই, ২০২৩ ০০:০০ টা

রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সিরিজ বৈঠকে ইইউ

আওয়ামী লীগ বিএনপি জাতীয় পার্টি জামায়াতের সঙ্গে আলোচনা ♦ তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে কোনো কথা বলেনি : কাদের ♦ আওয়ামী লীগের অধীনে মানুষ ভোট দিতে পারবে না : খসরু ♦ এক দফা, সুষ্ঠু নির্বাচন : চুন্নু

নিজস্ব প্রতিবেদক

আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের অনুসন্ধানী দল দিনভর বৈঠক করেছে দেশের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে। সকালে বিএনপির সঙ্গে বৈঠকের মাধ্যমে শুরু করে একে একে জাতীয় পার্টি, আওয়ামী লীগ, জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে বৈঠক করেন ইইউ প্রতিনিধিরা। এসব বৈঠকে আসন্ন নির্বাচন আয়োজনের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রত্যাশা জানতে চেয়েছেন ইইউ মিশনের কর্মকর্তারা। রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরাও নিজ নিজ অবস্থান থেকে তাদের বক্তব্য তুলে ধরেন।

গতকাল দুপুরে রাজধানীর হোটেল শেরাটনে ইইউ এর সঙ্গে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের বৈঠকে নেতৃত্বে দেন দলের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। দলের ৯ সদস্যের প্রতিনিধি দলে ছিলেন উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও সাবেক রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ জমির, প্রেসিডিয়াম সদস্য কর্নেল (অব.) মোহাম্মদ ফারুক খান, তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী এবং যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ, আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ড. শাম্মী আহমেদ, দফতর সম্পাদক ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া, তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক ড. সেলিম মাহমুদ, কার্যনির্বাহী সদস্য মোহাম্মদ এ আরাফাত ও তারানা হালিম। বৈঠকের পর ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ইইউ প্রতিনিধি দলের সঙ্গে ইতিবাচক আলোচনা হয়েছে। তারা একটি সুষ্ঠু নির্বাচন দেখতে চেয়েছে। আমরা বলেছি এটি আমাদের অঙ্গীকার। সংবিধানের ওপর ভিত্তি করেই নির্বাচন হবে। এতে তারা আশ্বস্ত হয়েছেন। তিনি বলেন, ইইউ প্রতিনিধি দল তত্ত্বাবধায়ক গঠন বা সরকারের পদত্যাগের বিষয়ে কোনো আলোচনা করেনি। জানতেও চায়নি। তারা কথা বলেছে নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে। বাংলাদেশের সংবিধান, সার্বভৌমত্ব ও আইনি কাঠামোর ওপর নির্ভর করে নির্বাচন চেয়েছে তারা। আমরাও বলেছি অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন আওয়ামী লীগ সরকার করবে। সংলাপ নিয়ে প্রতিনিধি দল কোনো কথা বলেননি। এমনকি তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন কিংবা সংসদ বিলুপ্তির বিষয় নিয়েও প্রতিনিধি দল কোনো কথা বলেননি। আসন্ন নির্বাচনের জন্য পর্যবেক্ষক পাঠানোর বিষয়ে কোনো আলোচনা তাদের সঙ্গে হয়নি। আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক বলেন, পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও শেখ হাসিনার নেতৃত্বে নির্বাচনকালীন সরকার গঠিত হবে। এখানে পার্লামেন্ট বিলুপ্তি, সরকারের পদত্যাগ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের প্রশ্নই ওঠে না।

সরকারের অধীন নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয় বলল বিএনপি : সকাল ৯টায় অনুষ্ঠিত ইইউ-এর সঙ্গে বিএনপির বৈঠকে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মোহাম্মদ ইসমাঈল জবিউল্লাহ, দলের সাংগঠনিক সম্পাদক শামা ওবায়েদ ও মানবাধিকার বিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট আসাদুজ্জামান আসাদ অংশ নেন। বৈঠক শেষে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, পর্যবেক্ষক প্রতিনিধি দলের আজকের বৈঠকে আমাদের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, আওয়ামী লীগের অধীনে নির্বাচন হলে মানুষ ভোট দিতে পারবে না। বিগত ২০১৪ ও ২০১৮ সালের দুটি নির্বাচনে দেশের মানুষ ভোট দিতে পারেনি। এবারও তারা চাচ্ছে আরেকটা যেনতেন নির্বাচনের মাধ্যমে আবারও বিজয়ী হয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা ধরে রাখতে। কিন্তু ক্ষমতাসীন এই আওয়ামী লীগকে এখন আর বাংলাদেশের মানুষ বিশ্বাস করে না। তারা আওয়ামী লীগকে আর ক্ষমতায় দেখতে চায় না। এ জন্য জনগণ এখন রাজপথে আন্দোলন করছে। কারণ তারা বুঝতে পেরেছেন যে, আওয়ামী লীগের অধীনে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হলে দেশের মানুষ ভোট দিতে পারবে না। জবাবে ইইউ-র প্রাক-নির্বাচন পর্যবেক্ষক দলের প্রতিনিধিরা বলেছেন, তারা চান বাংলাদেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হোক। যাতে এ দেশের মানুষ তাদের ইচ্ছামতো ভোট দিয়ে নিজেদের পছন্দ মতো প্রতিনিধি নির্বাচন করতে পারেন।

গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের কথা জানাল জাতীয় পার্টি : গতকাল সকাল সাড়ে ১০টার দিকে ইইউ প্রতিনিধি দলের সদস্যরা জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের বিশেষ দূত মশরুর মাওলার গুলশানের বাসায় পৌঁছান। পরে সেখানে জাতীয় পার্টির নেতাদের সঙ্গে প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা বৈঠক করেন তারা। বৈঠকে নেতৃত্ব দেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের, উপস্থিত ছিলেন পার্টির মহাসচিব মো. মুজিবুল হক চুন্নু ছাড়াও চেয়ারম্যানের বিশেষ দূত মশরুর মাওলা। ইইউ প্রতিনিধি দলটি জাতীয় পার্টির কাছে কী জানতে চেয়েছে প্রশ্নের জবাবে জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক বলেন, ‘আমরা বলেছি, নির্বাচন আমরা চাই, দেশের মানুষ চায় একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন। সে নির্বাচনটা যদি করতে হয়, তাহলে নির্বাচন কমিশন এবং সরকারের সবচেয়ে বড় ভূমিকা দরকার। এখন যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, এটা আলোচনার মাধ্যমে সম্ভব। আসলে মূল পদক্ষেপটা সরকারের পক্ষ থেকে নেওয়া প্রয়োজন। তিনি বলেন, ‘উনারা (ইইউ প্রতিনিধিরা) এসেছেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের আরেকটি টিম (প্রতিনিধি দল) আসবে ২৩ জুলাই। তারা বিভিন্ন দল ও পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করছেন আগামী নির্বাচনটা যাতে সুষ্ঠু হয়, ভালোভাবে হয়, নিরপেক্ষভাবে হয়- এ বিষয়ে তারা কথা বলছেন। দুটি টিম তাদের মূল্যায়ন প্রতিবেদন দেওয়ার পর তারা সিদ্ধান্ত নেবেন পর্যবেক্ষক পাঠাবেন কি না।

সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয় বলল জামায়াত : বিকালে রাজধানীর গুলশানে ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠক করে জামায়াতে ইসলামী। জামায়াতের নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহেরের নেতৃত্বে বৈঠকে অংশ নেন দলের ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা এ টি এম মা’ছুম, প্রচার সম্পাদক অ্যাডভোকেট মতিউর রহমান আকন্দ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক ড. আ. রব। পরে ড. আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের বলেন, দলীয় সরকারের একদলীয় ভোটে ইইউ পর্যবেক্ষক পাঠাবে কি না সেটা তাদের বিষয়। অতীতে সংলাপের কোনো ফল আসেনি। বৈঠকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও জামায়াতের নিবন্ধন নিয়েও কথা হয়েছে বলে জানিয়ে তিনি বলেন, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচন প্রমাণ করে বর্তমান সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে না। দেশ বাঁচাতে হলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বা নির্দলীয় সরকারের মাধ্যমে ভোট হতে হবে। কেয়ারটেকার সরকার কিংবা নির্দলীয় সরকার, যে নামেই হোক না কেন, একটি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন হতে হবে। এর বাইরে বাংলাদেশের মানুষ দলীয় সরকারের অধীনে, এই সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাবে না।

সাক্ষাৎ করল এবি পার্টি : গতকাল বিকালে রাজধানীর গুলশানস্থ ইউরোপীয় ইউনিয়নের স্থানীয় দফতরে ইইউ পর্যবেক্ষক প্রতিনিধিদলের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন আমার বাংলাদেশ পার্টি (এবি পার্টি) নেতৃবৃন্দ। এবি পার্টির প্রতিনিধি দলে ছিলেন দলের যুগ্ম আহ্বায়ক ও আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপ-কমিটির সমন্বয়ক অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম, যুগ্ম সদস্য সচিব ব্যারিষ্টার আসাদুজ্জামান ফুয়াদ ও ব্যারিষ্টার যুবায়ের আহমেদ ভূইয়া, সিনিয়র সহকারী সদস্য সচিব আমিনুল ইসলাম এফসিএ এবং সহকারী সদস্য সচিব  ব্যারিষ্টার নাসরীন সুলতানা মিলি। ইইউ প্রতিনিধি দল এবি পার্টি নেতৃবৃন্দের নিকট আগামী নির্বাচনে ইউরোপীয় ইউনিয়নের নির্বাচন পর্যবেক্ষক মিশন পাঠানোর বাস্তবতা, উপকারিতা এবং  সুপারিশ সম্পর্কে জানতে চান। লিখিত ব্রিফিং-এ এবি পার্টি প্রতিনিধিগণ দেশের নির্বাচনী ইতিহাস তুলে ধরেন। এতে তারা বলেন, রাষ্ট্রের মৌলিক কাঠামো গণতন্ত্র, আইনের শাসন, মানবাধিকার ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। এ থেকে পরিত্রাণের জন্য গায়ের জোরে বাতিল করা তত্ত্বাবধায়ক  সরকার ব্যবস্থা আবার ফিরিয়ে এনে বাংলাদেশের গণআকাক্সক্ষার বাস্তবায়ন করতে হবে।

সর্বশেষ খবর