সোমবার, ১৭ জুলাই, ২০২৩ ০০:০০ টা

নতুন হিসাব কষছে বিএনপি

মার্কিন প্রতিনিধিদের সফর ও ইইউ পর্যবেক্ষক দলের বৈঠক নিয়ে নীতিনির্ধারণী ফোরামে আলোচনা ♦ ঘোষিত এক দফা আন্দোলনের দ্বিতীয় ধাপের কর্মসূচি আসছে বুধবার

শফিউল আলম দোলন ও শফিকুল ইসলাম সোহাগ

নতুন হিসাব কষছে বিএনপি

উচ্চপর্যায়ের মার্কিন প্রতিনিধি দলের ঢাকা সফর এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) প্রাক-নির্বাচনী পর্যবেক্ষক দলের সঙ্গে বৈঠকের পর নতুন করে হিসাব কষছে বিএনপি। দলীয় নীতিনির্ধারকদের মতে, সাত সমুদ্র তেরো নদী পার হয়ে ঢাকায় উড়ে এসে মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জেয়া আর ডোনাল্ড লু খোদ প্রধানমন্ত্রীর অফিসে বসে পরিষ্কার বার্তা দিয়ে গেছেন। সেখানে তারা অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য ও অংশীদারত্বমূলক নির্বাচনের কথা বলেছেন। দেশের মানবাধিকার ঠিক রাখার কথা বলেছেন, গণমাধ্যম ও বাকস্বাধীনতাসহ অবাধ সভা-সমাবেশের তাগিদ দিয়ে গেছেন অত্যন্ত শ্রুতিমধুর ও কূটনৈতিক শিষ্টাচার-সংবলিত ভাষায়। এর পর আর কী বাকি থাকে! নীতিনির্ধারকরা বলছেন, তবে বিদেশিদের এসব উদ্যোগ আমাদের দেশের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে। কিন্তু আমাদের দাবি আমাদের নিজেদেরই আদায় করতে হবে। বাংলাদেশের জনগণ এবার জেগে উঠেছে। তাদের দাবি আদায়ে যা যা করা দরকার, এর সবই করবে। ঘোষিত কর্মসূচি ছাড়াও এক দফা আদায়ে ধারাবাহিক কর্মসূচিতে যাবে দলটি। দলের পরবর্তী কর্মসূচি এবং আশু পদক্ষেপগুলোর মাধ্যমে রাজনীতির পুরো হিসাব-নিকাশ ও চালচিত্রই পাল্টে যাবে বলে মনে করছেন তারা। দলের স্থায়ী কমিটির একাধিক সদস্যসহ আন্তর্জাতিক বিষয়ক কমিটির প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলাপ করে এসব তথ্য জানা গেছে।

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এ প্রসঙ্গে বলেন, “এখন আর এসব ‘ভিসানীতি কিংবা স্যাংশনে’ কী আছে না আছে ওগুলো আমরা দেখতে চাই না। ওই সব তারাই দেখবেন, এগুলো তাদেরই দেখার দায়িত্ব। আমরা খুব পরিষ্কার করে বলেছি যে, আমাদের নিজেদের জনগণের শক্তি দিয়ে আমরা আন্দোলন করছি। এ আন্দোলন কোনো ব্যক্তি বা দলের নয়, এ আন্দোলন দেশকে রক্ষা করার আন্দোলন, এ আন্দোলন দেশের মানুষের মুক্তির আন্দোলন। দেশের সংবিধানকে আবার জনগণের সত্যিকারের সংবিধানে পরিণত করার আন্দোলন এটি।” সংলাপ প্রসঙ্গে এক প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘এ সরকারের সঙ্গে আপস! এদের অধীনে নির্বাচন? আমি এ কথাগুলো বারবার বলতে চাই না। আমাদের সামনে আর কোনো পথ খোলা নেই। আন্দোলন, আন্দোলন আর আন্দোলন। আন্দোলনের মাধ্যমেই এ সরকারের পতন ঘটিয়ে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন আদায় করব ইনশা আল্লাহ।’

জানা গেছে, মার্কিন প্রতিনিধি দলের ঢাকা সফরকালে যুগপৎভাবে সরকার পতনের ‘এক দফা’ ঘোষণা করেছে বিএনপি। পাশাপাশি রাজধানীর নয়াপল্টনে তাদের নির্দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনের দাবিতে ব্যাপক শো-ডাউনের মধ্য দিয়ে নিজেদের পক্ষে জনসমর্থনের বিষয়টি তুলে ধরার চেষ্টা করেছে। এসব বিষয়ে ভিডিও ফুটেজসহ দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমের নিউজ পাঠানোর মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণেরও চেষ্টা করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে দলের মিডিয়া সেলের পক্ষ থেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করা হচ্ছে বলে জানা যায়। এ ছাড়া ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠকে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে বিএনপির অবস্থান, দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি, তাদের এক দফা দাবিসহ সার্বিক বিষয় তুলে ধরা হয়েছে। বিশেষ করে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি তুলে ধরে বিএনপি নেতারা বলেছেন, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে দেশের জনগণ ভোট দিতে পারবে না। এদের অধীনে কখনোই নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়। কারণ বিগত ২০১৪ সালের নির্বাচনে সব রাজনৈতিক দলকে বাইরে রেখে একতরফা নির্বাচন করে আওয়ামী লীগ সংসদের বেশির ভাগ আসনেই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠন করেছে। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের আগে ২৯ ডিসেম্বরের রাতেই ‘ব্যালট পেপারে সিল মেরে’ বাক্স ভর্তি করে পরদিন ফলাফল ঘোষণার মাধ্যমে নিজেদের জয়ী ঘোষণা করে আরও পাঁচ বছর কাটিয়ে দিয়েছে। এ সম্পর্কে দেশ-বিদেশসহ সারা বিশ্ব অবহিত রয়েছে। কাজেই বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে সে নির্বাচনে ইইউ কিংবা অন্য কোনো দেশের পর্যবেক্ষক এসে কোনো লাভ হবে না বলেও বৈঠকে অভিমত প্রকাশ করেছে বিএনপি।

এসব বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও দলের আন্তর্জাতিক বিষয়ক কমিটির প্রধান আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, কোন সরকারের অধীনে বাংলাদেশে নির্বাচন হবে সেটি ঠিক করে দেওয়াটা তো মার্কিনিদের কাজ নয়। তবে তারা ২০ ঘণ্টা প্লেন জার্নি করে সাত সমুদ্র তেরো নদী পার হয়ে ঢাকায় এসে খোদ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে বসে বাংলাদেশের অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশীদারিত্বমূলক জাতীয় নির্বাচনের কথা বলেছেন। অত্যন্ত শ্রুতিমধুর ও কূটনৈতিক শিষ্টাচার-সংবলিত ভাষায় দেশের মানবাধিকার, গণমাধ্যম ও বাকস্বাধীনতা, শ্রম অধিকার ও রোহিঙ্গাসহ রাজনৈতিক দলের অবাধ সভা-সমাবেশের তাগিদ দিয়ে গেছেন। সেখানে তো ব্যবসা-বাণিজ্য কিংবা দুই দেশের অন্য কোনো বিষয় বা সম্পর্ক নিয়ে কথা হয়নি। এর চেয়ে আর পরিষ্কার বার্তা কী হতে পারে। এর পরে আর কী বাকি থাকে! এ ঘটনার পর সরকারের উচিত ‘হয় পদত্যাগ করে চলে যাওয়া, না হয় সুইসাইড করা’। এখন কেউ যদি মনে করেন, মার্কিনিরা এসে সরকারকে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য গালিগালাজ করবেন, কিংবা হুমকি-ধমকি দেবেন, সেটি তো তারা করবেন না। এর আগে যেমন ডোনাল্ড লু তার পূর্ববর্তী সফরের সময়ও সুন্দর সাবলীল ভাষায় ইতিবাচক আলোচনা করেছিলেন। তখনো তো সরকারের মন্ত্রীরা অত্যন্ত ফুরফুরে মেজাজে বক্তব্য দিয়েছিলেন। কিন্তু ডোনাল্ড লু তার দেশে ফিরে যাওয়ার পরই তার সরকার বাংলাদেশের জন্য নতুন ভিসানীতি ঘোষণা করেছিল।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির এই সদস্য আরও বলেন, ‘বিদেশিদের এসব উদ্যোগ আমাদের দেশের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে। কিন্তু আমাদের দাবি আমাদের নিজেদেরই আদায় করতে হবে। আমাদের গণতন্ত্র আমাদেরই পুনরুদ্ধার করতে হবে। জনগণের দাবি জনগণের নিজেদেরই আদায় করতে হবে। আর এ জন্যই আজ আমরা সব বিরোধী দল একমত হয়ে রাজপথে আন্দোলন করছি। জনগণ জেগে উঠেছে। তারা এ গণ আন্দোলনে অংশ নিচ্ছেন। জণগণের আন্দোলন কখনো বিফল হয় না। সামনে বিজয় আমাদের সুনিশ্চিত ইনশা আল্লাহ।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য বলেন, মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের বেসামরিক নিরাপত্তা, গণতন্ত্র ও মানবাধিকারবিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জেয়া প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে প্রথম যে কথাটি বলেছেন, সেটি ছিল বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন। তারা চান বাংলাদেশে আগামীতে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও অংশীদারত্বমূলক নির্বাচন, যে নির্বাচনে জনগণ তাদের ইচ্ছা অনুযায়ী ভোট দিয়ে নিজেদের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে পারবেন। এর পাশাপাশি রয়েছে বাংলাদেশের মানবাধিকার ঠিক রাখা, রাজনৈতিক দলগুলোকে অবাধে সভা-সমাবেশ করতে দেওয়া, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং বাকস্বাধীনতা প্রদান। এর মানে এগুলো বাংলাদেশে নেই। তা না হলে এত দূর থেকে বাংলাদেশে এসে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে বৈঠকে বসে প্রথমেই এসব বিষয়ে তারা নিশ্চয়ই কথা বলতেন না। সুতরাং এটা বুঝতে হবে যে, তারা কী জন্য ঢাকা সফরে এসেছেন। আর কী মেসেজ দিয়ে গেছেন। সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ও বীর মুক্তিযোদ্ধা শমসের মবিন চৌধুরী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, মার্কিন প্রতিনিধি উজরা জেয়া ও ডোনাল্ড লুর সফর দেশের জন্য ইতিবাচক হয়েছে। বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক আরও জোরদার করার কথা বলেছেন তারা। শ্রম অধিকার ও নারীর অধিকার নিয়ে কথা বলেছেন। আসন্ন জাতীয় নির্বাচন নিয়েও কথা বলেছেন। আমাদের প্রধানমন্ত্রী তাদের আগামী নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু হবে বলে আশ্বস্ত করেছেন। তবে সংলাপের ওপরও তারা যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েছেন। এদিকে ১২ জুলাই মাত্র দুই দিনের নোটিশে রাজধানীর নয়াপল্টনে ব্যাপক লোকসমাগমের পর নতুন করে উজ্জীবিত হয়েছেন বিএনপি নেতা-কর্মীরা। নিজেদের ওপর নতুন করে আস্থা ও বিশ্বাস ফিরে এসেছে তাদের মধ্যে। ঢাকাসহ সারা দেশে আগামীকাল ১৮ ও পরদিন ১৯ জুলাইয়ের পদযাত্রা কর্মসূচি যে কোনো মূল্যে সফল করে তোলার প্রস্তুতি নিচ্ছেন তারা। বিএনপির পাশাপাশি সমমনা ৩৬ দলসহ এক দফা আন্দোলনের সঙ্গে সদ্য যুক্ত হওয়া ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশও যুগপৎভাবে এ কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দিয়েছে। এদিন পদযাত্রা কর্মসূচি শেষে নতুন করে এক দফা আন্দোলনের দ্বিতীয় ধাপের কর্মসূচি ঘোষণা করবে তারা। এ ছাড়া আগামী ২২ জুলাই রাজধানীর নয়াপল্টনে ঢাকা বিভাগীয় ‘তারুণ্যের সমাবেশ’ কর্মসূচি পালন করবে বিএনপির অঙ্গসংগঠন ছাত্রদল, যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দল। সেদিনও ঢাকায় ব্যাপক শোডাউনের প্রস্তুতি নিচ্ছে তারা।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর