মঙ্গলবার, ১৮ জুলাই, ২০২৩ ০০:০০ টা

ছয় সংকটে নাকাল ঢাকা

বিশৃঙ্খল গণপরিবহন, মশার বিস্তার, জলাবদ্ধতা, দূষণ, গ্যাস-পানি সংকট ও অপরিকল্পিত খোঁড়াখুঁড়ি

জয়শ্রী ভাদুড়ী ও হাসান ইমন

ছয় সংকটে নাকাল ঢাকা

ঘর থেকে বের হলে গণপরিবহনের সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। একদিকে সংকট অন্যদিকে কে কার আগে যাবে গণপরিবহনের এমন প্রতিযোগিতা প্রতিদিনই অহরহ চোখে পড়ছে। একই সঙ্গে রাস্তায় বের হলে বায়ু আর শব্দদূষণে বিপর্যস্ত হতে হয়। আর ঘরে ফিরলে পানি বা গ্যাস সংকটে নাকাল হতে হয়। শুধু তাই নয়, অপরিকল্পিত খোঁড়াখুঁড়ি ও জলাবদ্ধতায় নাকাল রাজধানীবাসী। এ ছাড়া বর্তমানে সবচেয়ে বেশি বিপর্যস্ত এডিস বাহিত ডেঙ্গু মশা। নগরীর প্রতিটি ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। একই সঙ্গে ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রতিদিনই ঘটছে প্রাণহানি। এই নিয়ে সরকার ও সিটি করপোরেশন নানা উদ্যোগ নিলেও কোনো সুফল মিলছে না। এই ছয় সংকটে নাকাল ঢাকার বাসিন্দারা। যদিও সরকার ও বিভিন্ন সংস্থা থেকে এসব সমস্যা নিরসনে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হলেও তার সুফল মিলছে না; বরং দিনকে দিন নতুন নতুন জটিলতায় নগরজীবনের সংকট আরও ঘনীভূত হচ্ছে।

বিশৃঙ্খল রাজধানীর গণপরিবহন : ঢাকা মহানগরীর গণপরিবহনে শৃঙ্খলা আনতে বাস রুট রেশনালাইজেশনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল পাঁচ বছর আগে। এ উদ্যোগ বাস্তবায়নের জন্য যে কমিটি করা হয়েছে তারা এখন পর্যন্ত ২৭টি সভা করেছে। কিন্তু রুট মেনে বাস পরিচালনা ও কোম্পানি গঠনের কোনো কাজ সামান্যই এগিয়েছে। যাত্রী ছাউনি, বাস টার্মিনাল, বাস ডিপো নির্মাণ এবং নতুন বাস নামানোর কাজেও কাক্সিক্ষত অগ্রগতি নেই। তিনটি রুটে বাস চলাচল শুরু করলেও অবৈধ বাসের দৌরাত্ম্য থামছে না। একই সঙ্গে বাস মালিকরা গণপরিবহনে ই-টিকিটিং চালু করে শৃঙ্খলা ফেরানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু নানা অনিয়মের কারণে বিশৃঙ্খলা থামছে না। কাউকে মেশিন নষ্ট, মেশিনে ভাড়া বেশি দেখায়, সব গন্তব্যে মেশিনে নেই ইত্যাদি বলে একেকজনকে একেক রকমভাবে বুঝ দিতে দেখা যায়। এভাবে ই-টিকিংয়ের নামে যাত্রীদের হয়রানি করে পকেট কাটা হচ্ছে প্রতিনিয়ত। ভোগান্তি তো কমেইনি, উল্টো টিকিট, ভাংতি নিয়ে পড়তে হচ্ছে বিড়ম্বনায়। বাড়তি ভাড়া আদায় বন্ধ ও সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে ই-টিকিটিং ব্যবস্থা চালু করলেও যাত্রীরা এখনো এই সেবা পুরোপুরি পাচ্ছে না। যাত্রীদের ই-টিকিট না দিয়ে আদায় করা হচ্ছে বাড়তি ভাড়া। যাত্রী কল্যাণ সমিতির এক পর্যবেক্ষণেও এসব তথ্য উঠে আসে। এ ছাড়া নগরীর অধিকাংশ স্থানেই নির্দিষ্ট যাত্রীছাউনি থাকলেও হাতেগোনা দু-একজন ছাড়া যাত্রী সমাগম নেই। কারণ যে যেখানে পারছেন সেখানেই বাস থামিয়ে উঠছেন-নামছেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে যাত্রী ওঠানামার কাজটা সড়কের মাঝখানেই সারা হচ্ছে। গতকাল নগরীর ব্যস্ততম সড়ক ফার্মগেট-বাংলামোটরে দেখা যায়, পান্থকুঞ্জ পার্কের বাংলামোটর মোড়-সংলগ্ন কোনায় যে যাত্রী ছাউনিসহ বাস স্টপেজ চিহ্নিত করা আছে, সেখানে কোনো বাস দাঁড়াচ্ছে না। অন্যদিকে বাংলামোটর মোড় ও সড়কের মাঝপথ থেকেই যাত্রী তোলা হচ্ছে। একই চিত্র মালিবাগ-রামপুরা সড়কের। এই সড়কে দৌড়ে গিয়ে সড়কের মাঝখানে যাত্রীদের চলন্ত গাড়িতে উঠতে দেখা গেছে। পুরুষ যাত্রীদের পাশাপাশি নারীরাও রয়েছেন বাসে ওঠার এমন প্রতিযোগিতায়। পথচারীদের অনেকেই জানিয়েছেন, প্রতিদিনই সড়কে চোখে পড়ে এমন চিত্র। এ বিষয়ে সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েত উল্লাহ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, পরিবহনের ভাড়া শৃঙ্খলায় নিয়ে আসতে এরই মধ্যে আমরা গত বছর অধিকাংশ পরিবহনে ই-টিকিটিং চালু করেছি। সর্বমোট ৫৯টি পরিবহন কোম্পানির ৩ হাজার ৩০৭টি বাসে ই-টিকিটিং চালু হয়েছে। এই কার্যক্রম এখনো চলমান রয়েছে। একই সঙ্গে পরিবহনে শৃঙ্খলা আনতে আমরা কাজ করছি।

মশায় নাজেহাল নগরবাসী : রাজধানীতে ঘরে ঘরে ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। মশার কামড়ে প্রতিদিনই ঘটছে প্রাণহানির ঘটনা। হাসপাতালগুলো রোগীতে ঠাসা। এডিস মশার কামড়ে প্রতি বছর জুলাই-সেপ্টেম্বরে ডেঙ্গু হানা দিলেও সমস্যা সমাধানে কার্যকরী কোনো পদক্ষেপ নেয় না ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন। এ পর্যন্ত ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত রোগী ২২ হাজার ছাড়িয়েছে। গতকাল সোমবার পর্যন্ত মারা গেছেন ১১৪ জন। প্রতি বছরই মশা নিয়ন্ত্রণে বাজেটে বরাদ্দের পরিমাণ বাড়ছে ঢাকা উত্তর ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের। এ মশা নিয়ন্ত্রণেই গত ৬ অর্থবছরে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন ব্যয় করেছে প্রায় ৩৮৭ কোটি টাকা। ২০২২-২৩ অর্থবছরে মশক নিধনে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের বরাদ্দ ১০১ কোটি টাকা এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন রেখেছে ৪৫ দশমিক ৭৫ কোটি টাকা। বরাদ্দ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে মশার প্রকোপও। মশা নিয়ন্ত্রণে সম্প্রতি অভিযান শুরু করেছে দুই সিটি করপোরেশন। মশার লার্ভা মিললে মামলার সঙ্গে করা হচ্ছে জরিমানাও। যাত্রাবাড়ীর বাসিন্দা লুৎফুল কবিরের স্ত্রী ও মেয়ে ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি। তিনি বলেন, ‘পরিবারের দুজন সদস্য ডেঙ্গুতে আক্রান্ত। ভয়ে শঙ্কায় দিন কাটছে আমাদের। আমরা ডেঙ্গুর ভয়ে বাসা এবং চারপাশে যেন পানি জমে না থাকে তা সব সময় খেয়াল রাখি। কিন্তু তার পরেও আজ এ বিপদ। এত মানুষ আক্রান্ত হয়ে যখন পরিস্থিতি খারাপ হয়ে গেছে, তখন সিটি করপোরেশন লোকদেখানো অভিযান শুরু করেছে। অথচ মার্চ-এপ্রিল থেকে লার্ভিসাইডিং করে মশার বংশস্থল ধ্বংস করলে আজ আমরা এরকম বিপদে পড়তাম না।’ বাড্ডার বাসিন্দা সীমা বেগম বলেন, ‘শীতেও মশা কামড়ায়, গরমেও কামড়ায়। ছেলেমেয়ে নিয়ে এ শহরে থাকা দায় হয়ে গিয়েছে। সব সময় ভয়ে থাকি। বিকাল হতেই জানালা লাগিয়ে দেই। সারাক্ষণ মশা মারার স্প্রে, কয়েল লাগাই। ওডোমাস মাখিয়ে দিই ছেলেমেয়েদের। এটা আমার ট্রমায় পরিণত হয়েছে। সিটি করপোরেশনের মশা মারার যথেষ্ট বাজেট আছে কিন্তু কাজের কিছুই হচ্ছে না।’

জলজট, দূষণ, সংকটে নগরবাসী : বৃষ্টি হলেই জলজট ভোগান্তিতে পড়তে হয় রাজধানীবাসীকে। হাঁটু থেকে কোমর সমান পানি জমে যায় বেশ কিছু এলাকায়। গ্রিন রোড, ঝিগাতলা, পল্টন, বাড্ডা পোস্ট অফিস রোড, বনশ্রী, মোহাম্মদপুর, ধানমন্ডি, গুলশান, বনানী, বারিধারা, কুড়িল এলাকার বেশ কিছু সড়কে পানি জমে থাকায় ভোগান্তিতে পড়তে হয় নগরবাসীকে। গ্রিন রোড এলাকার বাসিন্দা সাইদুল আলম বলেন, বৃষ্টির কারণে এ বছর ঈদের নামাজে যেতে পারিনি। বৃষ্টি হলেই হাঁটু থেকে কোমর পর্যন্ত পানি জমে। মধুবাগ এলাকার বাসিন্দা মার্জিয়া ইসলাম বলেন, বৃষ্টি হলে জলজটে ঘর থেকে বের হতে পারি না। আর গরমে পানি সংকটে খাবার পানি পাই না। পানি আমাদের বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। গরম বাড়লেই পানির সংকট শুরু হয়। টানা ১৯ দিন পানি না আসার রেকর্ডও আছে। বৃষ্টি হলে ছাদ থেকে পানি ধরে রেখে খাওয়া, গোসল, রান্নার কাজ করি আমরা। গ্যাস সংকটও নগরীর বেশ কিছু এলাকার নিত্য চিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। আজমপুরের বাসিন্দা নাজনীন খাতুন বলেন, সকাল ৮টা ৪৫ বাজলেই গ্যাস চলে যায়, দুপুর ৩টার পরে আসে। দুপুরে রান্না করা সম্ভব হয় না। তাই রাতে রান্না করে রাখতে হয়। দুপুরে বাসায় অতিথি আসলে খাওয়ানো মুশকিল হয়ে যায়। এ জন্য আবার ইলেকট্রিক চুলা কিনতে হয়েছে। লাইনের গ্যাস হওয়ায় পুরো মাসের বিল দিতে হয়। এদিকে রান্না করায় বিদ্যুতের বিলও বেশি আসে। উন্নয়ন কাজের খোঁড়াখুঁড়ি, গাড়ির কালো ধোঁয়া দূষণে বিপর্যস্ত রাজধানীবাসী। প্রায়ই দূষণের তালিকায় শীর্ষে চলে আসে রাজধানী ঢাকার নাম। বায়ুদূষণের কারণে রাজধানীর বাসিন্দারা বিভিন্ন কাশি, অ্যাজমাসহ শ্বাসতন্ত্রের রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। পানিদূষণে ডায়রিয়া, জন্ডিসসহ বিভিন্ন পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হয় রাজধানীর মানুষ।

সড়কে খোঁড়াখুঁড়ি : রাজধানীর বিভিন্ন সড়ক ও অলিগলিতে চলছে খোঁড়াখুঁড়ির কাজ। কোথাও বিদ্যুৎলাইন, কোথাও মাটির নিচে নেওয়া হচ্ছে ঝুলন্ত তার, আবার কোথাও সুয়েজ লাইন, কখনো ওয়াসার পানির লাইন সংস্কারে চলছে এই খোঁড়াখুঁড়ি। দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন সড়কে সমন্বয়হীন খোঁড়াখুঁড়িতে ভোগান্তিতে পড়েছে নগরবাসী। রাজধানীর পরিকল্পিত গণপরিসর হাতিরঝিল। সেখানেও চলছে খোঁড়াখুঁড়ি। শত শত কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত সড়কগুলো ক্ষতবিক্ষত করে মাটির নিচ দিয়ে বিদ্যুতের উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন তার নেওয়ার কাজ চলছে। এ জন্য হাতিরঝিলের মগবাজার অংশ থেকে রামপুরা পর্যন্ত সড়কের একপাশ খোঁড়া হয়েছে। একই সঙ্গে মধুবাগ থেকে রামপুরা অংশেও কাজ চলছে। এ ছাড়া বনশ্রী ই, এফ, জি, এইচ, আই ও জে ব্লকেও চলছে খোঁড়াখুঁড়ি। সরেজমিন দেখা গেছে, হাতিরঝিল প্রকল্পের মগবাজার অংশ থেকে ফুটপাতের পাশ ধরে সড়কে খননকাজ চলেছে। ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ডিপিডিসি) তার বসাচ্ছে। ঢিমেতালে চলছে কাজ। খোঁড়াখুঁড়ি মধুবাগ পার হয়ে মহানগর প্রকল্প পর্যন্ত পৌঁছেছে। একই সঙ্গে রামপুরা থেকে মধুবাগ অংশেও খোঁড়াখুঁড়ির কাজ চলছে।

চক্রাকার বাস শৃঙ্খলার একটি উদাহরণ

সারা বছর সমন্বিত মশক ব্যবস্থাপনা জরুরি

খাতভিত্তিক উদ্যোগ নিলে সমস্যা সমাধান সম্ভব

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর