মঙ্গলবার, ১৮ জুলাই, ২০২৩ ০০:০০ টা
ঢাকা-১৭ উপনির্বাচন

হিরো আলমকে মারধর চারজন গ্রেফতার

নিজস্ব প্রতিবেদক

হিরো আলমকে মারধর চারজন গ্রেফতার

ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী আশরাফুল আলম ওরফে হিরো আলমকে গতকাল রাস্তায় ফেলে মারধর করা হয় -বাংলাদেশ প্রতিদিন

তুলনামূলক কম ভোটারের উপস্থিতির মধ্যে শেষ মুহূর্তে এক স্বতন্ত্র প্রার্থীর ওপর হামলার মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচন। আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির প্রার্থী ভোটের পরিবেশে সন্তুষ্ট থাকলেও দুই স্বতন্ত্র প্রার্থী তাঁদের এজেন্ট বের করে দেওয়ার অভিযোগ করেছেন। একজন স্বতন্ত্র প্রার্থী ভোট বর্জনও করেছেন। দিনভর শান্তিপূর্ণ ভোট চললেও বিকালে ভোট শেষের ঘণ্টাখানেক আগে এক কেন্দ্র পরিদর্শনে গিয়ে ক্ষমতাসীন দলের কর্মীদের হামলার শিকার হন স্বতন্ত্র প্রার্থী আশরাফুল আলম ওরফে হিরো আলম। নির্বাচন কমিশন অবশ্য ভোটের পরিবেশ নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছে।

ঢাকা-১৭ আসনের এ উপনির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী আশরাফুল আলম ওরফে হিরো আলমকে রাস্তায় ফেলে পেটানো হয়েছে। গতকাল বিকাল সোয়া ৩টায় রাজধানীর বনানী বিদ্যানিকেতন স্কুল অ্যান্ড কলেজ কেন্দ্র পরিদর্শনে গেলে তাকে পেটানোর এ ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে চারজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে গত রাতে জানান ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত উপকমিশনার (মিডিয়া) কে এন রায় নিয়তি। এ ঘটনার পর ভিডিও ফুটেজ দেখে দুজনকে আটক করেছে পুলিশ। এর আগে হামলাকারীদের মারধর থেকে বাঁচতে একপর্যায়ে হিরো আলম দৌড়ে পালান। তারা এ সময় তাকে পেছন থেকে ধাওয়া দেন। হিরো আলম একপর্যায়ে বনানীর ২৩ নম্বর সড়কে গিয়ে একটি রিকশায় ওঠেন। পরে গাড়িতে করে চলে যান।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, গতকাল বিকাল ৩টায় বনানী বিদ্যানিকেতন স্কুল অ্যান্ড কলেজ কেন্দ্র পরিদর্শনে যান হিরো আলম। সেখানে তিনি একটি নারী ভোট কেন্দ্রে যান। এ সময় নৌকা প্রতীকের কর্মী ও সমর্থকরা পেছন থেকে হিরো আলমকে গালমন্দ করতে থাকেন এবং কেন্দ্র থেকে বেরিয়ে চলে যেতে বলেন। তিনি গেট দিয়ে ঢোকার সময় কয়েকজন ‘ভুয়া ভুয়া’ বলে আওয়াজ করছিলেন। এর মধ্যেই হিরো আলম তাঁর নেতা-কর্মীদের সঙ্গে নিয়ে কেন্দ্রের দিকে হাঁটা শুরু করেন। এ সময় তাঁকে চড়-থাপ্পড়, কিল-ঘুসি ও গলাধাক্কা দিতে দিতে কেন্দ্র থেকে বের করে দেওয়া হয়। পরিস্থিতি উত্তপ্ত হলে কেন্দ্রটির দায়িত্বে থাকা পুলিশ সদস্যরা হিরো আলমকে ঘিরে রেখে স্কুলের ফটকের দিকে নিয়ে যান। স্কুলের প্রাঙ্গণ থেকে বের হওয়ার পর হিরো আলমের পাশ থেকে সরে যান পুলিশ সদস্যরা। স্কুল থেকে বের হয়ে ফটকের সামনে দিয়ে সোজা ১৬ নম্বর সড়কের দিকে দ্রুত এগোতে থাকেন হিরো আলম। একপর্যায়ে হামলাকারীরা তাঁকে ধাক্কা দিয়ে রাস্তায় ফেলে দেন, তখন তাঁকে এলোপাতাড়ি মারধর করেন তাঁরা। হিরো আলমের সঙ্গীরা তাঁকে রক্ষা করে সামনের দিকে নিয়ে যান। ২৩ নম্বর সড়কের এ ব্লক পর্যন্ত তাঁকে পেছন থেকে ধাওয়া করেন হামলাকারীরা। এদিকে হিরো আলমকে মারধরের ঘটনার পর ওই এলাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের উপস্থিতি বেড়ে যায়। স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা দাবি করেছেন, তাঁরা হিরো আলমকে মারধরের ঘটনায় জড়িত নন। যাঁরা হিরো আলমের ওপর হামলা চালিয়েছেন তাঁরা অতি উৎসাহী। ওই কেন্দ্রে দায়িত্বে থাকা পুলিশ পরিদর্শক মিয়াজী বলেন, ‘আমরা হিরো আলমকে উদ্ধার করে তাঁকে ঘটনাস্থল থেকে বের হতে সহায়তা করেছি।’ মারধরের ঘটনার পর রাজধানীর রামপুরায় একটি বেসরকারি হাসপাতালে হিরো আলমকে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন তাঁর ব্যক্তিগত সহকারী শুভ। সকালে বনানী মডেল স্কুল কেন্দ্র পরিদর্শনে গিয়ে হিরো আলম অভিযোগ করেছিলেন, আওয়ামী লীগের লোকজন তাঁর এজেন্টদের কেন্দ্র থেকে বের করে দিচ্ছেন। তিনি বলেন, ‘যখনই বলতেছে একতারার লোক, হিরো আলমের লোক তখনই কিন্তু বের করে দিতেছে। তাহলে এ রকম করে এজেন্ট বের করে দেওয়ার মানে হইল! তাঁরা একতরফা তাঁদের এজেন্ট দিয়ে সিল মারার চেষ্টা করতেছে।’ অন্যদিকে ঢাকা-১৭ উপনির্বাচনে ভোট দিয়ে জাতীয় পার্টির প্রার্থী সিকদার আনিসুর রহমান বলেছেন, ভোটার উপস্থিতি কম হলেও ভোটের পরিবেশ ‘ভালো’ রয়েছে। সকাল সাড়ে ৮টার দিকে ক্যান্টনমেন্ট এলাকার শিশুমঙ্গল বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোট দিয়ে তিনি এ কথা বলেন।

ভোট শান্তিপূর্ণ, হিরো আলমের ওপর হামলা কেন্দ্রের বাইরে : প্রার্থী হিরো আলমের ওপর হামলার ঘটনাটি ভোট কেন্দ্রের বাইরে হয়েছে দাবি করে নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর বলেছেন, ঢাকা-১৭ উপনির্বাচনে ভোটগ্রহণ শান্তিপূর্ণই ছিল। রাজধানীর এই সংসদীয় আসনে ভোটগ্রহণ শেষের পর নির্বাচন ভবনে সাংবাদিকদের সামনে এসে এ প্রতিক্রিয়া জানান তিনি। নিরুত্তাপ এ উপনির্বাচনে ভোটের হার ১২-১৫ শতাংশ হতে পারে বলে ধারণা করছেন এই নির্বাচন কমিশনার। গতকাল ঢাকায় উপনির্বাচনের পাশাপাশি বিভিন্ন পৌরসভা ও ইউনিয়নেও ভোট হয়েছে। তবে পৌরসভায় ৫০-৮০ শতাংশ ভোট পড়েছে বলে জানান তিনি। আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য আকবর হোসেন খান পাঠান ফারুকের মৃত্যুতে পরবর্তী সংসদ নির্বাচনের কয়েক মাস আগে ঢাকা-১৭ আসনে উপনির্বাচন হলো। ভোট শেষে নির্বাচন কমিশনার আলমগীর বলেন, ‘নির্বাচন সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হয়েছে। আমি নিজেও সকালে ৮-১০টি কেন্দ্র পরিদর্শন করেছি, শান্তিপূর্ণ দেখেছি। আমাদের আরেক নির্বাচন কমিশনারও গেছেন। প্রতিটি কেন্দ্রে শান্তিপূর্ণ হয়েছে। সিসি ক্যামেরাও দেখেছি আমরা। ঢাকার বাইরেও পৌরসভাসহ কিছু নির্বাচন হয়েছে। প্রতিটি নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে।’ হিরো আলমের আক্রান্ত হওয়ার বিষয়টি সাংবাদিকরা তুলে ধরলে এই নির্বাচন কমিশনার বলেন, ‘১২৪টি কেন্দ্র রয়েছে, একটি কেন্দ্রে বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটলে তো বলা যায় না অসুষ্ঠু হয়েছে। স্বতন্ত্র প্রার্থীর ওপর হামলার বিষয়ে কিছু তথ্য আমরা জেনেছি, প্রকৃত চিত্র পাইনি। যতটুকু জেনেছি, স্বতন্ত্র প্রার্থী অনেক সমর্থক নিয়ে কেন্দ্রে প্রবেশের চেষ্টা করেছেন, সঙ্গে ইউটিউবার ছিল প্রায় ৭০ জনের মতো।’ পুলিশ সেজন্য হিরো আলমকে আটকে দিয়েছিল জানিয়ে তিনি বলেন, ‘পুলিশ তাদের বুঝিয়ে পাঠিয়ে দেয়। অর্থাৎ ভোট কেন্দ্রে কোনো ঘটনা ঘটেনি। কিন্তু রাস্তায় বের হয়ে এলে কে বা কারা তাকে ধাওয়া দিয়েছে, শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করেছে।’ তবে বাইরেও একজন প্রার্থী আক্রান্ত হওয়ায় দুঃখ প্রকাশ করে আলমগীর বলেন, ‘এটা আমরা কামনা করি না। অন্যায় কাজ করেছে।’

এক প্রার্থীর বর্জনে ইসির বিস্ময় : এক প্রার্থীর ভোট বর্জনের ঘোষণায় বিস্ময় প্রকাশ করে নির্বাচন কমিশনার রাশেদা সুলতানা জানান, ‘কেন এমন ঘোষণা এলো, তার কারণ বুঝতে পারছি না।’ সকাল ৮টায় ভোট শুরু হলে বনানী বিদ্যানিকেতন কেন্দ্র পরিদর্শনে যান রাশেদা। তিনি বলেন, ‘ভোটারদের বাধা দেওয়া, প্রতিবন্ধকতা ছিল না। সিসি ক্যামেরায়ও ভোটের কোনো অনিয়ম দেখিনি। কোনো অভিযোগও কেউ দেয়নি।’ উল্লেখ্য, দুপুরে অনিয়ম ও নির্বাচন কমিশনের অসহযোগিতার অভিযোগ তুলে ভোট বর্জনের ঘোষণা দেন স্বতন্ত্র প্রার্থী তারেকুল ইসলাম ভুঞা।

সাংবাদিক হেনস্তা : ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনে সংবাদ সংগ্রহের কাজে বাধা প্রদান ও সাংবাদিক হেনস্তার ঘটনা ঘটেছে। দুপুর সাড়ে ১২টায় ভাসানটেক এলাকার সরকারি হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজের সামনে এ ঘটনা ঘটে। জানা গেছে, মোহাম্মদ এ আরাফাতের সমর্থকরা বাংলাদেশ প্রতিদিনের এক ফটোসাংবাদিক এবং বাংলাদেশ প্রতিদিন ডিজিটালের দুজন ক্যামেরাপারসনকে হেনস্তা করেন। হেনস্তার শিকার সংবাদকর্মীরা হলেন ফটোসাংবাদিক জয়ীতা রায় এবং ক্যামেরাপারসন সাগর ও আজহারুল ইসলাম। হেনস্তার শিকার ফটোসাংবাদিক জয়ীতা রায় জানান, কলেজের সামনের রাস্তায় উপনির্বাচনের স্বতন্ত্র প্রার্থী হিরো আলমের ভিডিও ফুটেজ সংগ্রহকালে মোহাম্মদ এ আরাফাতের কিছু কর্মী-সমর্থক হিরো আলমের লোক ভেবে তাদের ওপর চড়াও হন। ফুটেজ সংগ্রহের কাজে বাধা দেন। গালাগালি করেন এবং গায়ে ধাক্কা দিয়ে ওই এলাকা ছেড়ে চলে যেতে বলেন। এ ছাড়া পরিচয় পাওয়ার পরও ভোট কেন্দ্র থেকে সাংবাদিকদের বের করে দেওয়া হয়েছে। ঘটনাটি ঘটেছে গতকাল ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড আদর্শ বিদ্যানিকেতনের একটি কেন্দ্রে।

এই সরকারের অধীনে আর নির্বাচন করব না : স্বতন্ত্র প্রার্থী আশরাফুল আলম ওরফে হিরো আলম বলেছেন, বর্তমান সরকারের অধীনে কখনোই সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। যে কারণে এই সরকারের অধীনে জীবনে আর কোনো নির্বাচনে অংশ নেব না। পাশাপাশি এই নির্বাচনকে আমি প্রত্যাখ্যান করলাম। গতকাল বেটার লাইফ হাসপাতাল থেকে প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে রাজধানীর রামপুরায় মহানগর প্রজেক্টের ডি ব্লকের দুই নম্বর রোডে নিজ বাসায় এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ কথা বলেন।

হিরো আলম বলেন, সকাল থেকে আমার ওপর হামলার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। সে অনুযায়ী বিকালে তারা জয় বাংলা স্লোগান তুলে আমার ওপর হামলা করে। জোর করে ব্যালটে সিল মারতে বাধা দেওয়ায় তারা আমার ওপর হামলা করে। এ বিষয়ে আমি আমেরিকান অ্যাম্বাসি, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ যত জায়গায় চিঠি দেওয়ার দরকার দেব। নির্বাচন কমিশনের কাছে আমি এর আগে অভিযোগ দিয়েছিলাম কিন্তু তারা তা আমলে নেয়নি। এই নির্বাচন কমিশনের প্রতি আমার আস্থা নেই।

সর্বশেষ খবর