সোমবার, ২৪ জুলাই, ২০২৩ ০০:০০ টা

প্রতিহতের চেষ্টা হলে নির্বাচন চ্যালেঞ্জ হবে

বিশেষ সাক্ষাৎকারে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল

গোলাম রাব্বানী

প্রতিহতের চেষ্টা হলে নির্বাচন চ্যালেঞ্জ হবে

আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকে রাজনৈতিকভাবে প্রতিহত করার চেষ্টা করা হলে নির্বাচন আয়োজন কমিশনের জন্য চ্যালেঞ্জ হবে বলে মন্তব্য করেছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল। তবে তিনি আশা করছেন, রাজনৈতিক সমঝোতা হবে। নির্বাচন শান্তিপূর্ণ পরিবেশে অংশগ্রহণমূলক হবে। গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে নির্বাচন, চলমান রাজনীতি, বিদেশিদের দৌড়ঝাঁপসহ নানা প্রসঙ্গে খোলামেলা কথা বলেছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। তিনি মনে করেন, রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলে সংলাপের মাধ্যমে ন্যূনতম মৌলিক প্রশ্নে মতভেদ ও সংকট নিরসন অসম্ভব নয়। সিইসি বলেছেন, নির্বাচন কমিশনের ওপর বিদেশিদের কোনো চাপ নেই। কমিশনের কাছে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো বার্তাও নেই। নির্বাচনের গ্রহযোগ্যতার কোনো নির্ধারিত মানদন্ড নেই উল্লেখ করে সিইসি বলেছেন, কমিশনের সফলতা বিফলতা নির্বাচন শেষে জনগণই মূল্যায়ন করবে।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক মহল এখন সরগরম। সব চেয়ে বড় জাতীয় নির্বাচনের আয়োজন নির্বাচন কমিশনের জন্য কতটা চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন?

সিইসি : রাজনৈতিক প্রতিকূলতা, অস্থিরতা, ডামাডোল অনেক কিছু সত্ত্বেও কমিশনকে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতায় তার দায়িত্ব পালন করে যেতে হবে। নির্বাচন রাজনৈতিকভাবে স্বাগত হওয়ার বিষয়। সব দলই নির্বাচনের পক্ষে। নির্বাচনের পদ্ধতি প্রকৃতি নিয়ে মতভেদ রয়েছে। মতভেদের নিরসন হতে পারে। নির্বাচনকে রাজনৈতিকভাবে প্রতিহত করার চেষ্টা হলে চ্যালেঞ্জ হতে পারে। পরিশেষে কতটা চ্যালেঞ্জ থাকবে বা আদৌ থাকবে কিনা তা এ মুহূর্তে নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। আশাকরি একটা সমঝোতা হবে। নির্বাচন শান্তিপূর্ণ পরিবেশে অংশগ্রহণমূলক হবে।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : সংসদ নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য করতে কী কী পদক্ষেপ নিচ্ছেন?

সিইসি : ইতোমধ্যে সমাপ্ত হওয়া বিভিন্ন পর্যায়ের প্রায় সহস্রাধিক নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য করতে যে সব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে সেরকমেরই পদক্ষেপ নেওয়া হবে। তবে সংসদ নির্বাচনে ভোট ইভিএমে না হয়ে পুরোটাই কাগজের ব্যালটে হবে। বাড়তি কী কী পদক্ষেপ নেওয়া হবে তা এখনই বলা যাবে না। একই দিনে প্রায় ৪২ হাজার কেন্দ্রের ২ লক্ষাধিক বুথে অনুষ্ঠেয় জাতীয় সংসদের সাধারণ নির্বাচনের জটিলতা, গুরুত্ব ও বহুমাত্রিকতা নিঃসন্দেহে ব্যাপক। সেগুলো বিবেচনায় থাকবে। গ্রহণযোগ্যতার নির্ধারিত কোনো মানদন্ড নেই বিধায় অনুপমভাবে তা নিরূপণ করা যাবে না। তবে, জনগণের ব্যাপক অংশকে বিশ্বাস করতে হবে যে নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়েছে। সেজন্য কমিশন চেষ্টা কররে ভোটগ্রহণ প্রক্রিয়াকে যতটা সম্ভব স্বচ্ছ করতে। গণমাধ্যম এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। নতুন আরও আরও পদক্ষেপ নেওয়া হলে তা যথাসময়ে জনগণকে অবহিত করা হবে।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতিমূলক কাজ এর মধ্যে কতটা শেষ হয়েছে? তাতে কি আপনি সšুÍষ্ট?

সিইসি : নির্বাচনের প্রস্তুতিমূলক কাজে কমিশন পিছিয়ে নেই। প্রস্তুতির বিষয়টি চলমান। পরিকল্পনা মাফিক এগিয়ে চলেছে।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : বিগত দুটি সংসদ নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক-সমালোচনা রয়েছে। নির্বাচন নিয়ে জনমনে আস্থার সংকট রয়েছে বলে মনে করা হয়। বর্তমান কমিশন সেই হারানো আস্থা ফিরিয়ে আনতে পারবে কি? আপনি কতটা আশাবাদী?

সিইসি : বিগত দিনের অতীত হয়ে যাওয়া বিষয় নিয়ে মন্তব্য করব না। আস্থা-অনাস্থার তর্ক-বিতর্কে প্রবৃত্ত হব না। আমার বিনম্র অভিমতে আস্থার সংকট নির্বাচন কমিশনকে নিয়ে না যতটা তার চেয়ে অধিক রাজনীতিতে। সেখানে কেউ কাউকে বিশ্বাস করতে পারছেন না। আমরা সীমিত ক্ষেত্রে আমাদের করণীয় নিয়ে ভাবছি এবং করণীয় সমাধা করতে সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছি। কর্মসমাপন হওয়ার পর দিনশেষে জনগণ কীভাবে আমাদের অর্জন, সফলতা, বিফলতা মূল্যায়ন করবেন সময়ই তা বলে দেবে। 

বাংলাদেশ প্রতিদিন : নির্বাচন নিয়ে বিদেশিদের কোনো ধরনের চাপ অনুভব করছেন কি? বিদেশিদের উদ্বেগ দূর করতে কমিশন কোনো বিশেষ উদ্যোগ নেবে কি?

সিইসি : বিদেশিদের কোনো ধরনের চাপ আমাদের ওপর নেই। 

বাংলাদেশ প্রতিদিন : বিরোধী রাজনৈতিক দল থেকে শুরু করে নানা মহলে নির্বাচনকালীন বিশেষ সরকার বা তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে নানা আলোচনা হচ্ছে। বিরোধী দলগুলো বলছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচনে অংশ নেবে না। এক্ষেত্রে কমিশন কীভাবে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিশ্চিত করবে? রাজনৈতিক দলগুলোকে নির্বাচনে আনার ব্যাপারে কমিশনের কোনো বিশেষ উদ্যোগ বা ভূমিকা থাকবে কি?

সিইসি : সংবিধানের অর্থ ও অন্তর্নিহিত চেতনার আলোকে বহুদলীয় গণতন্ত্রের চর্চা প্রয়োজন। গণতন্ত্র ও রাজনীতির উৎকর্ষ সাধনের জন্য অবাধ, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনিবার্যভাবেই প্রয়োজন। রাজনৈতিক নেতৃত্বে পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাস প্রয়োজন। নির্বাচন পদ্ধতির কতিপয় মৌলিক প্রশ্নে মতভেদ স্পষ্ট। ও থেকে সংকট উদ্ভূত হতে পারে। সদিচ্ছা থাকলে সংলাপের মাধ্যমে মতভেদ ও সংকট নিরসন অসম্ভব নয়। নিদেনপক্ষে ন্যূনতম কতিপয় মৌলিক প্রশ্নে ঐকমত্য হতে পারে। বিষয়টি বিবদমান রাজনৈতিক দলসমূহ এবং রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের অধিক্ষেত্র। সেখানে আমাদের অনুপ্রবেশ বাঞ্ছনীয় নয়। আমাদের কেবল শুভকামনা থাকবে। আমরা আন্তরিকভাবে চাই নির্বাচন প্রকৃত অর্থেই অংশগ্রহণমূলক হোক। নির্বাচন আপেক্ষিক অর্থে অংশগ্রহণমূলক হয়তো হবে। কিন্তু প্রধানতম কোনো দল বা দলগুলো অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকলে নির্বাচনের আইনগত বৈধতা ক্ষুণœ না হলেও ন্যায্যতা (Legitimacy) প্রশ্নে অনাকাক্সিক্ষত বিতর্ক উদ্ভূত হতে পারে।  

বাংলাদেশ প্রতিদিন : যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সংঘাতমুক্ত নির্বাচন অনুষ্ঠানের ওপর বিশেষ জোর দেওয়া হয়েছে। ভোট গ্রহণের দিন বা আগে-পরে সহিংসতা রোধে কী কী পদক্ষেপ নেবে নির্বাচন কমিশন?

সিইসি : এ নিয়ে আমাদের কাছে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো বার্তা নেই। সরকারের কাছে যদি যুক্তরাষ্ট্রের এ বিষয়ে কোনো পরামর্শ বা বার্তা থেকে থাকে সরকার সেটা বুঝবে এবং দেখবে। কমিশনের ভাবনা থাকবে সংবিধান ও প্রচলিত বিধিবিধান অনুসরণ করে নির্বাচন আয়োজন করা। নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করে সম্ভাব্য যে কোনো সংঘাত প্রতিহত করার জন্য কমিশন তার নিজ দায়িত্বের অংশ হিসেবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসমূহকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিয়ে থাকবে।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : নির্বাচনকালীন সময়ে নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে নির্বাচনের আগে স্থানীয় ও পুলিশ প্রশাসন ঢেলে সাজানোর পরিকল্পনা আছে কি?

সিইসি : পুলিশ ও প্রশাসনের নিরপেক্ষতা নিয়ে এ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত বিভিন্ন পর্যায়ের সহস্রাধিক নির্বাচনে কমিশনকে কোনো বিরূপ অবস্থার মুখোমুখি হতে হয়নি। ভবিষ্যতেও যে হবে না, তা নিশ্চিত করে বলছি না। তারপরও সাধারণ নির্বাচনের আগে পুলিশ ও প্রশাসনকে ঢেলে সাজানো বা সীমিত সময়ের জন্য পুনর্বিন্যাস করা একান্তই আবশ্যক মনে করলে কমিশন যথাসময়ে চিন্তাভাবনা করে সেবিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। ভোট প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা, নিরপেক্ষতা ও জনগণের সার্বিক আস্থা উপেক্ষণীয় নয়।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : নির্বাচনের আগে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আবারো সংলাপের কথা ভাবছেন কি?

সিইসি : এখনো সেভাবে ভাবা হয়নি। রাজনীতির চলমান চিত্র ও পারিপার্শ্বিক অবস্থা আরও খানিকটা পর্যালোচনা করে কমিশন পুনর্বার সংলাপ বিষয়ে ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নেবে। 

বাংলাদেশ প্রতিদিন : ‘রাতের ভোট’ বলে দেশে একটি অনাকাক্সিক্ষত শব্দ প্রচলিত হয়েছে। আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে ব্যালটের ব্যবহার হবে বলে আবারও এরকম কোনো শব্দ প্রয়োগের শঙ্কা আছে কি?

সিইসি : মন্তব্য করছি না।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : সার্বিকভাবে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে আয়োজন এবং সব মহলে একে গ্রহণযোগ্য করে তোলার ব্যাপারে আপনি কতটা আশাবাদী?

সিইসি : আমি আশাবাদী। আমাদের প্রয়াসে শৈথিল্য থাকবে না। আয়োজনকে সফল করতে জনগণ এবং সংশ্লিষ্ট সবাইকেও আমাদের প্রয়াসে অংশী হতে হবে। তবে দেশে নির্বাচনের সমকালীন পরম্পরা বিশ্লেষণে মনে হয় সার্বিক গ্রহণযোগ্যতা বিষয়ে কমবেশি সংশয় বা বিতর্ক উত্থাপিত হতেই পারে। আগেই বলেছি  গ্রহণযোগ্যতা নিরূপণের সুস্পষ্ট কোনো মানদন্ড নেই। তবে ভোট প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে জনমনে বিশ্বাস (credibility) স্থাপনের আন্তরিক প্রয়াস আমাদের অবশ্যই থাকবে।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : সম্প্রতি বরিশাল ও ঢাকা-১৭ উপনির্বাচনে প্রার্থীর ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে। আগামী সংসদ নির্বাচনে এ ধরনের ঘটনার ক্ষেত্রে প্রার্থীর নিরাপত্তা বা ঘটনা প্রতিকারের ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা কেমন হবে?

সিইসি : নির্বাচনে সহিংসতার সম্ভাবনা থাকে। প্রার্থী, সাধারণ ভোটার, নির্বাচন কর্মকর্তা, সংবাদ কর্মীসহ যে কারও ওপর আক্রমণ বা সহিংসতা হতে পারে। এ জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসমূহকে সতর্ক অবস্থানে রাখা হয়। তারা এমন সব অনভিপ্রেত ঘটনা প্রতিহত করার চেষ্টা করে থাকেন। এরপরও সহিংসতার কিছু কিছু ঘটনা ঘটে থাকে। ঘটনা ঘটে গেলে দুর্বৃত্তকে আইনের আওতায় এনে বিচারের মাধ্যমে শাস্তি নিশ্চিত করে প্রতিকারের প্রতিবিধান করতে হবে। তদুপরি সংশ্লিষ্ট সবাইকেও নিজ নিজ নিরাপত্তা বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত নির্বাচনে ৩৬ ব্যক্তির মৃত্যুর ঘটনাটি আমাদের নজরে এসেছে। আইন ও বিধিবিধানে আইনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা বিষয়ে যে সব নির্দেশনা দেওয়া আছে সেগুলো কমিশন যথারীতি অনুসরণ করার পাশাপাশি নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও কী উপায়ে জোরদার করা যায় তা নিয়ে অবশ্যই ভাববে।

সর্বশেষ খবর