মঙ্গলবার, ২৫ জুলাই, ২০২৩ ০০:০০ টা

হাসপাতালে ঠাঁই মিলছে না

মারা গেছেন আরও নয়জন, আক্রান্ত ২২৯৩

নিজস্ব প্রতিবেদক

হাসপাতালে ঠাঁই মিলছে না

রাজধানীর মুগদা হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন ডেঙ্গু রোগীরা -জয়ীতা রায়

প্রতিদিন ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হচ্ছে ২ হাজারের বেশি মানুষ। রাজধানীর হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গু রোগীর ভিড়ে শয্যা সংকুলান হচ্ছে না। সরকারি হাসপাতালে শয্যার তুলনায় কয়েকগুণ বেশি রোগী ভর্তি, বেসরকারিতেও মিলছে না ঠাঁই। ঢাকার বাইরে চট্টগ্রাম, বরিশালে প্রতিদিন রেকর্ডসংখ্যক রোগী ভর্তি হচ্ছে।

স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, ‘ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করা আমাদের কাজ নয়, আমাদের কাজ রোগীদের চিকিৎসাসেবা দেওয়া। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কাজ জনগণকে অবহিত করা। মানুষের জ্বর বিভিন্ন কারণে হতে পারে, আমরা বলেছি জ্বর হলে দ্রুত পরীক্ষা করাতে।’ গতকাল ঢাকা মেডিকেল কলেজের এমবিবিএস কে-৮০ ব্যাচের ওরিয়েন্টেশন প্রোগ্রাম শেষে সাংবাদিকদের এ কথা বলেন তিনি।

তিনি আরও বলেন, ‘আপনারা জানেন আমরা সরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গু পরীক্ষার ফি ৫০ টাকা করে দিয়েছি। আমরা দেখছি ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। ঢাকা শহরে ডেঙ্গু রোগীর সঙ্গে সঙ্গে সারা দেশে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। আমাদের মূল কথা হলো ডেঙ্গু মশা কমাতে হবে, তাহলে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা কমে যাবে। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে শুধু বর্ষা মৌসুমে নয়, ঢাকা সিটি করপোরেশন ও বিভিন্ন পৌরসভায় মশা নিধনের কাজটি সারা বছর করতে হবে।’

অ্যাম্বুলেন্স মালিকদের ধর্মঘট বিষয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কেন কী কারণে তারা ধর্মঘট ডেকেছে সে বিষয়টি আমার জানা নেই, তাই আমি ভালো কিছু বলতে পারব না। দেশে একটি সমস্যা চলছে ডেঙ্গু পরিস্থিতি বাড়ছে। এখন সময় নয় ধর্মঘট করার। মানুষের সেবা, জীবন রক্ষা এবং চিকিৎসাসেবার এখন প্রয়োজন। সেটি বন্ধ করে দিয়ে আমরা ধর্মঘটে চলে গেলাম। এটি আমি সঠিকভাবে নিতে পারছি না। তারপরও তাদের কী সমস্যা আছে, সেই সমস্যার যেন সমাধান হয় সেটি আমরা করার চেষ্টা করব এবং লক্ষ্য রাখব।’ স্বাস্থ্য অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, গতকাল সারা দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন ২ হাজার ২৯৩ জন, মারা গিয়েছেন নয়জন। আক্রান্তদের মধ্যে ঢাকার বাসিন্দা ১ হাজার ২৩৮ জন এবং ঢাকার বাইরের বাসিন্দা ১ হাজার ৫৫ জন। ঢাকায় মারা গিয়েছেন নয়জন। গতকাল ঢাকার বাইরে মৃত্যুর ঘটনা নেই। এ বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন ৩৫ হাজার ২৭০ জন, মারা গেছেন ১৮৫ জন। এর মধ্যে জুলাইয়ের ২৪ দিনে মারা গেছেন ১৩৮ জন।

হাসপাতালগুলোতে বাড়ছে রোগীর চাপ। রাজধানীর সবচেয়ে বেশি রোগী ভর্তি আছে মুগদা জেনারেল হাসপাতালে। গতকাল এ হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন ৫৭৯ জন। রোগীর চাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে হাসপাতাল। শয্যা না থাকায় মেঝেতে রোগী রেখে চলছে চিকিৎসা। বেসরকারি হাসপাতালেও শয্যা সংকট। রোগী সামনে আরও বাড়তে থাকলে সামলানো মুশকিল হয়ে যাবে বলছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গতকাল ভর্তি ছিলেন ২৭৫ জন, মিটফোর্ড হাসপাতালে ২৭৮ জন, শিশু হাসপাতালে ৮১ জন, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১৭৮ জন, সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে ১৭৭ জন, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ১৫৭ জনসহ রাজধানীর সরকারি হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন ২ হাজার ৩১৬ জন। বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন ২ হাজার ৭৯ জন। ঢাকার বাইরে বাড়ছে রোগীর সংখ্যা। অন্যান্য বিভাগের হাসপাতালে ভর্তি আছেন ৩ হাজার ৬৮ জন। নিজস্ব প্রতিবেদক, বরিশাল জানান, বরিশাল শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (শেবাচিম) গত রবিবার চিকিৎসাধীন ছিলেন রেকর্ড সংখ্যক ২১৬ জন ডেঙ্গু রোগী। এর আগে গত শনিবার চিকিৎসাধীন ছিলেন দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ২০৫ জন রোগী। হাসপাতালের ওষুধ এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষাসহ অন্যান্য প্রাপ্য সুবিধা নিয়ে রোগীদের অভাব-অভিযোগের শেষ নেই। ওয়ার্ডগুলো নামমাত্র পরিষ্কার করায় নোংরায় ভরা। মশা-মাছি এবং দুর্গন্ধে টেকা দায়। ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসায় প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি না থাকায় জটিল রোগীদের ঢাকায় প্রেরণ করেন চিকিৎসকরা। এ বিষয়ে হাসপাতালের পরিচালক ডা. এইচ এম সাইফুল ইসলাম বলেন, নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যেও রোগীদের সর্বাত্মক সেবা দেওয়ার চেষ্টা চলছে। তাদের জন্য আরও জায়গা বাড়ানো হয়েছে। রোগীদের সরকারি সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা হচ্ছে। নিজস্ব প্রতিবেদক, চট্টগ্রাম জানান, চট্টগ্রামে গ্রাম এলাকার চেয়ে শহরে ডেঙ্গু রোগে আক্রান্তের হার অনেক বেশি। প্রতিদিনই মোট আক্রান্ত থেকে কয়েকগুণ বেশিই শনাক্ত হচ্ছে শহর এলাকায়। এ কারণে নগরের মানুষ অনেকটা আতঙ্ক আর শঙ্কায় দিন পার করছে। তাছাড়া মশক নিধন কাজ যথাসময়ে আশানুরূপ না হওয়ায় এ শঙ্কা আরও বাড়ছে বলে জানা যায়। চলতি বছর চট্টগ্রামে মোট আক্রান্ত হয় ২ হাজার ১২৭ জন। চট্টগ্রাম সিভিল সার্জন কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, গতকাল সকাল পর্যন্ত চট্টগ্রামে ডেঙ্গু রোগে মোট আক্রান্ত হয় ৯৩ জন। এর মধ্যে মহানগরে ৮৬ জন এবং ১৫ উপজেলায় সাতজন। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. আবদুল্লাহ আবু সাঈদ বলেন, আগে গ্রাম পর্যায়ে এডিস মশা মোটেও ছিল না। এখন ধীরে ধীরে গ্রামেও এডিস মশা জন্মাচ্ছে। তবে শহর এলাকায় এডিস মশা বেশি হওয়ার অন্যতম কারণ হলো- নগর ঘনবসতি, নগরে উন্নয়ন কাজ বেশি চলে, শহরে বাসার আশপাশ এবং এসির পানিসহ নানাভাবে জমাট পানি বেশি থাকে। জমাট পানি এডিস মশা উৎপাদনের জন্য উর্বর স্থান। কার্যত এসব কারণে গ্রামের চেয়ে নগরে ডেঙ্গু আক্রান্ত বেশি হচ্ছে। তাই জরুরি ভিত্তিতে বাসার আশপাশে অবশ্যই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. মো. ইলিয়াছ চৌধুরী বলেন, প্রতিদিনই নতুন করে ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। সঙ্গে মৃত্যুও আছে। তাই ডেঙ্গু থেকে বাঁচতে হবে অবশ্যই রাত-দিন সব সময়ই মশারি টাঙিয়ে ঘুমাতে হবে। একই সঙ্গে বাড়ির আঙিনা কোনো মতেই অপরিষ্কার রাখা যাবে না। জমাট পানি কিংবা অপরিষ্কার জায়গায় এডিস মশা বেশি জন্মায়।

পটুয়াখালী প্রতিনিধি জানান, পটুয়াখালীতে আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা। ঈদুল ফিতর উপলক্ষে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে ঈদ পালন করতে পটুয়াখালীতে আসা লোকজনই আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলেও এখন তা জেলার উপজেলাগুলোর গ্রামাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ছে। পটুয়াখালী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নির্ধারিত ওয়ার্ডের মেঝে ও করিডোরে রোগীর চিকিৎসা চলছে। এ অবস্থায় স্বাস্থ্য বিভাগের পক্ষ থেকে সবাইকে সচেতন হওয়ার জন্য তাগিদ দিচ্ছেন। চলতি বছরের শুরু থেকে এ পর্যন্ত জেলায় ৬৬৫ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে। বর্তমানে পটুয়াখালী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন ১৬৪ জন। গতকাল নতুন করে ৫৩ রোগী ভর্তি হয়েছে। তবে এ পর্যন্ত কোনো মৃত্যু নেই। পটুয়াখালী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. দিলরুবা ইয়াসমিন লিজা বলেন, ঈদের পর পরই ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বেড়ে গেছে। ডেঙ্গু রোগীদের জন্য পৃথক ওয়ার্ড করা হলেও এখন জায়গা হচ্ছে না। পটুয়াখালীর সিভিল সার্জন ডা. এস এম কবির হাসান বলেন, ঈদ পরবর্তী হঠাৎ করে ডেঙ্গু রোগী বেড়ে গেছে। তাদের চিকিৎসা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। নিজস্ব প্রতিবেদক, সিলেট জানান, সিলেটে বেড়েই চলছে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। একের পর এক স্থানে মিলছে এডিশ মশার লার্ভা। আক্রান্তরা হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরলেও গণসচেতনতার অভাবে ডেঙ্গুর ‘কমিউনিটি ট্রান্সমিশনের’ আশঙ্কা করছেন সিলেট সিটি করপোরেশনের স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা। নগরীতে ডেঙ্গু পরিস্থিতি যাতে নিয়ন্ত্রণের বাইরে না যায় সে জন্য ‘হার্ডলাইনে’ যাচ্ছে সিলেট সিটি করপোরেশন (সিসিক)। আজ মঙ্গলবার থেকে একযোগে চারটি ভ্রাম্যমাণ আদালত নামছে অভিযানে। কারও বাসা-বাড়ি কিংবা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের সামনে এডিস মশার লার্ভা পাওয়া গেলে মোটা অঙ্কের জরিমানা করা হবে। এ ছাড়া গণসচেতনতা তৈরিতে নগরীতে ব্যাপক প্রচারণা শুরু হচ্ছে। পাশাপাশি নগরীতে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রমও জোরদার করা হবে বলে জানিয়েছেন সিসিক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী।

রাবি প্রতিনিধি জানান, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) ৪ শিক্ষার্থী ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন। আবাসিক হলগুলোতে জ্বর নিয়ে কাতরাচ্ছেন অনেকে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ডেঙ্গু সচেতনতায় নির্দেশনা দিলেও সংশ্লিষ্টদের কার্যকরী কোনো পদক্ষেপ নেই। ফলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে।

এ ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক সুলতান-উল-ইসলাম বলেন, দেশে ডেঙ্গু পরিস্থিতির কথা বিবেচনা করে গত সপ্তাহে সভা ডেকে সচেতনতা বৃদ্ধিসহ বেশকিছু সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সেখানে প্রত্যেক হল প্রাধ্যক্ষসহ সংশ্লিষ্টদের প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এখন তারা কেন কার্যকরী কোনো ব্যবস্থা নেয়নি, তা অবশ্যই জানতে চাইব। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, মশার যন্ত্রণায় ক্যাম্পাসে টেকা মুশকিল হলেও একই অবস্থা। হল প্রাধ্যক্ষ পরিষদের আহ্বায়ক ড. হাসনা হেনা জানান, সেদিন সভায় সব হলের প্রাধ্যক্ষ উপস্থিত ছিলেন। এখন এক সপ্তাহ পরও সবাই কেন প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়নি, তা আমি জানি না। তবে দ্রুতই সবাইকে নিয়ে বসব।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর