মঙ্গলবার, ২৫ জুলাই, ২০২৩ ০০:০০ টা

নারীকে বিবস্ত্রের ইস্যুতে উত্তাল ভারতের সংসদ

পাল্টাপাল্টি দাবিতে অধিবেশন মুলতবি

কলকাতা প্রতিনিধি

ভারতের মণিপুরে দুই নারীকে বিবস্ত্র করে ঘোরানোর ঘটনায় উত্তাল দেশটির সংসদ। বর্ষাকালীন অধিবেশনের তৃতীয় দিন গতকাল মণিপুর ইস্যুতে কয়েক দফা মুলতবি হয়েছে সংসদের অধিবেশন। গত ৪ মে উত্তর-পূর্ব ভারতের মণিপুর রাজ্যের কাংপোকপি এলাকায় কুকি সম্প্রদায়ের দুই নারীকে বিবস্ত্র করে প্যারেড করানো হয় বলে অভিযোগ ওঠে। ওই ঘটনার প্রায় ৮১ দিন পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে সেই ভিডিও। বিষয়টি নিয়ে গত কয়েকদিন ধরেই উত্তাল গোটা ভারত। ওই ইস্যুতেই গতকাল সংসদে বিক্ষোভে ফেটে পড়েন বিজেপি বিরোধী দলগুলোর নতুন জোট ‘ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্টাল ইনক্লুসিভ অ্যালায়েন্সের (ইন্ডিয়া) সংসদ সদস্যরা। প্রথমে সংসদের চত্বরে মহাত্মা গান্ধীর মূর্তির নিচে বিক্ষোভ দেখিয়ে মণিপুরের সহিংসতার ঘটনায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বিবৃতি দাবি করেন তারা। বিক্ষোভে অংশ নেন কংগ্রেসের সভাপতি ও রাজ্যসভার সদস্য মল্লিকার্জুন খাড়গে, অধীর রঞ্জন চৌধুরী; তৃণমূল কংগ্রেসের অভিষেক ব্যানার্জি, সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, কাকলি ঘোষ দস্তিদার; আম আদমি পার্টির রাঘব চাড্ডা; ডিএমকের টি আর বালু; সমাজবাদী পার্টির অভিনেত্রী জয়া বচ্চন প্রমুখ।

সে ক্ষেত্রে ‘ইন্ডিয়া’ নামে বিরোধী জোট গঠনের পর এই প্রথম সংগঠনের সদস্যদের একজোট হয়ে কোনো বিক্ষোভে অংশ নিতে দেখা গেছে। হাতে প্ল্যাকার্ড, পোস্টার নিয়ে সরকারের বিরোধিতা করে স্লোগান দিতে থাকেন বিরোধী এই সংসদ সদস্যরা।

বিক্ষোভে অংশ নিয়েই কংগ্রেসের সভাপতি ও রাজ্যসভার সদস্য মল্লিকার্জুন খাড়গে বলেন, ‘এটা খুবই লজ্জাজনক যে, সংসদের অধিবেশন চলাকালীন প্রধানমন্ত্রী হাউসের বাইরে বক্তব্য দিচ্ছেন। তার কর্তব্য ছিল মণিপুরের সহিংসতা নিয়ে সংসদে বিস্তৃত বিবৃতি দেওয়া। তাই, আমরা রাজ্যসভার চেয়ারম্যান এবং লোকসভার স্পিকারের কাছে অনুরোধ করছি যে, প্রধানমন্ত্রী মণিপুরের বর্তমান পরিস্থিতি কী তা নিয়ে যেন বিবৃতি দেন।’ সমাজবাদী পার্টির অভিনেত্রী জয়া বচ্চন বলেন, ‘আন্তর্জাতিক স্তরে মণিপুরের ঘটনা এখন আলোচ্য বিষয়, অথচ আমাদের ভারতে এটা নিয়ে কোনো আলোচনা চলছে না। এ ব্যাপারে আমি কি বা বলতে পারি? এটা খুবই লজ্জার। প্রকৃতপক্ষে সরকারপক্ষ চায় না এ বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হোক।’

এরপর সংসদের ভিতরে এসেও একই দাবিতে সোচ্চার হয় বিরোধী দলের সংসদ সদস্যরা। একসময় অধিবেশন চলাকালীন রাজ্যসভার চেয়ারম্যান জগদীপ ধনকড়ের উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় হয় তৃণমূল সংসদ সদস্য ডেরেক ও ব্রায়েনের সঙ্গে। চেয়ারম্যান তাকে বলেন, ‘আপনি আপনার আসনে বসুন। আপনি চেয়ারকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছেন।’ এরপরই দুপুর ১২টা পর্যন্ত মুলতবি হয়ে যায় অধিবেশন। পরে অধিবেশন পুনরায় চালু হলে মণিপুর ইস্যুতে প্রধানমন্ত্রীর বিবৃতি দাবি করতে থাকেন বিরোধী দলের সদস্যরা। রাজ্যসভার চেয়ারম্যানের আপত্তি সত্ত্বেও আসন ছেড়ে হাত উঁচিয়ে তার সামনে চলে আসেন আম আদমি পার্টির সংসদ সদস্য সঞ্জয় সিং। তাকে শান্ত হতে বলা হলেও তিনি তা করেননি। পরে চেয়ারকে অপমানের অভিযোগে সঞ্জয় সিংকে অধিবেশনের বাকি দিনগুলোর জন্য বরখাস্ত করা হয়। এরপরই বিরোধী দলের সংসদ সদস্যরা হট্টগোল শুরু করে দেন। সবমিলিয়ে দুপুর ২টা পর্যন্ত রাজ্যসভার অধিবেশন মুলতবি করে দিতে বাধ্য হন রাজ্যসভার চেয়ারম্যান। এরপর একই ইস্যুতে বিরোধীরা বিক্ষোভ দেখালে বিকাল ৩টা পর্যন্ত তৃতীয়বারের জন্য রাজ্যসভার অধিবেশন মুলতবি করা হয়। এরপর এদিনের মতো মুলতবি করে দেওয়া হয় অধিবেশন। একই দৃশ্য দেখা যায় লোকসভার অধিবেশনে। সংসদের ভিতরেই ‘ইন্ডিয়া ফর মণিপুর’ প্ল্যাকার্ড নিয়ে এই ইস্যুতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বক্তব্যের দাবি জানাতে থাকে বিরোধী সংসদ সদস্যরা। প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং জানান ‘আমরা সংসদে আলোচনার জন্য প্রস্তুত।’

পরে দুপুর ২টায় ফের সংসদের অধিবেশন শুরু হলে লোকসভায় দাঁড়িয়ে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বলেন, ‘আমি সংসদে মণিপুর নিয়ে আলোচনার জন্য প্রস্তুত। আমি বিরোধীদের অনুরোধ করছি এ বিষয়ে আলোচনা করতে দিন। এই স্পর্শকাতর বিষয়ে সত্য জানাটা খুব জরুরি।’

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যের পরই বিরোধীরা ফের একই দাবিতে সরব হয়ে পড়লে এদিনের মতো মুলতবি হয়ে যায় লোকসভার অধিবেশন।

এদিকে মণিপুরের ঘটনা নিয়ে বিরোধীরা যেমন বিক্ষোভ দেখিয়েছে, তেমনি দেশটির রাজস্থান ও পশ্চিমবঙ্গের মালদায় নারীদের ওপর অত্যাচারের ঘটনার প্রতিবাদে গান্ধী মূর্তির নিচে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন বিজেপির সংসদ সদস্যরা।

কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অর্জুন রাম মেঘওয়াল বলেন, ‘বিরোধীরা দাবি তোলে মণিপুরের ঘটনা নিয়ে সংসদে আলোচনা করা হোক। আমরা তাতে রাজি। কিন্তু আমাদের দলের সংসদ সদস্যরা দাবি তুলেছেন মণিপুরের পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গ, রাজস্থানসহ গোটা ভারতে যেখানে নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে তা নিয়েও আলোচনা হোক। তাতে বিরোধীদের আপত্তি।’ বিজেপির সংসদ সদস্য দিয়া কুমারী বলেন, ‘ন্যাশনাল ক্রাইম ব্যুরোর রিপোর্ট অনুযায়ী রাজস্থানে নারীদের ওপর অত্যাচারের ঘটনা দিন দিন বাড়ছে। ধর্ষণের তালিকায় এই রাজ্যটি শীর্ষে রয়েছে। গত সাড়ে চার বছরে রাজস্থানে নারীদের ওপর নির্যাতনের ঘটনা ৪০ শতাংশ বেড়েছে। মণিপুরে যে ঘটনা ঘটেছে আমরা তার তীব্র নিন্দা জানাই। প্রধানমন্ত্রী নিজেও এই ঘটনার নিন্দা জানিয়েছেন। তিনি জানিয়েছেন এই বিষয়ে আলোচনা করতে প্রস্তুত কিন্তু বিরোধীরা তা করতে দিচ্ছে না। রাজস্থানের ঘটনা কি গুরুত্বপূর্ণ নয়? রাজস্থানের নারীরা কি মানুষ নয়? এমনকি প্রিয়াঙ্কা গান্ধী একবারও নির্যাতিতা পরিবারের সঙ্গে কথা বলেননি।’ উল্লেখ্য, বিক্ষোভের আভাস পাওয়া গিয়েছিল রবিবারই। দুপক্ষই জানিয়ে দেয় তারা তাদের অবস্থান থেকে একটুও নড়বে না। যদিও সরকার পক্ষের বক্তব্য ছিল মণিপুরের ঘটনা নিয়ে তারা আলোচনা করতে রাজি। কিন্তু বিরোধীদের দাবি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে সংসদে বিবৃতি দিক।

সর্বশেষ খবর