শুক্রবার, ২৮ জুলাই, ২০২৩ ০০:০০ টা
রাবি শিক্ষক তাহের হত্যা

১৭ বছর পর কার্যকর দুই আসামির ফাঁসি

নিজস্ব প্রতিবেদক, রাজশাহী

১৭ বছর পর কার্যকর দুই আসামির ফাঁসি

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. এস তাহের আহমেদ হত্যা মামলায় দুই আসামি ড. মিয়া মহিউদ্দিন ও জাহাঙ্গীর আলমের ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে। গতকাল রাত ১০টা এক মিনিটে প্রথমে মিয়া মোহাম্মদ মহিউদ্দিন ও এরপর জাহাঙ্গীর আলমের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার মোহা. আবদুল জলিল এ তথ্য নিশ্চিত করে বলেন, রাতেই নিজ নিজ পরিবারের কাছে লাশ হস্তান্তর করা হয়েছে। ফাঁসি কার্যকরের সময় রাজশাহী জেলা প্রশাসক শামীম আহমেদ, জেলা পুলিশ সুপার এ বি এম মাসুদ হোসেন, জেলা সিভিল সার্জন ডা. আবু নাইদ মোহাম্মদ ফারুক উপস্থিত ছিলেন।

২০০৬ সালের ১ ফেব্রুয়ারি নিখোঁজ হন রাবি অধ্যাপক ড. এস তাহের আহমেদ। পরদিন বাড়ির পাশের ম্যানহোল থেকে তাঁর লাশ উদ্ধার করা হয়। ৩ ফেব্রুয়ারি নগরীর মতিহার থানায় মামলা করা হয়। ড. তাহেরের আইনজীবীকন্যা সেগুফতা তাবাসসুম আহমেদ বলেন, দীর্ঘ ১৭ বছর আইনি লড়াইয়ের পর দুই আসামির ফাঁসি কার্যকর হলো।

প্রতারণা ফাঁস করায় হত্যা : ২০০৫ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মিয়া মো. মহিউদ্দিন অধ্যাপক পদে পদোন্নতির জন্য আবেদন করেন। আবেদনের সঙ্গে যেসব সংযুক্তি দেওয়া হয় সেগুলোতে প্রতারণা খুঁজে পান পদোন্নতি রিভিউ কমিটি। এ কমিটিতে যুক্ত ছিলেন অধ্যাপক তাহের। এর আগেও ড. তাহেরকে প্রাণনাশের হুমকি দিয়েছিলেন মহিউদ্দিন। ড. মহিউদ্দিনের বিরুদ্ধে থানায় সাধারণ ডায়েরিও করেছিলেন অধ্যাপক তাহের। বিভাগ সূত্রে জানা যায়, আবেদনে প্রতারণার কয়েকটি বিষয় প্রাথমিকভাবে ধরে ফেলার পর বিভাগের মিটিংয়ে মহিউদ্দিনের পদোন্নতির বিরোধিতা করেন অধ্যাপক তাহের। এনিয়ে দুজনের কথা কাটাকাটিও হয়। সেই থেকে তাঁর ওপর ক্ষোভ ছিল মহিউদ্দীনের। এ মামলায় আপীল বিভাগের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, মহিউদ্দীন অনুমান করেছিলেন অধ্যাপক তাহের জীবিত থাকলে অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পাওয়ার আশা একেবারেই শূন্য। এ কারণে পদোন্নতির পথ পরিষ্কার করতেই এই হত্যাকান্ড সংঘটিত করা হয়। বিভাগের সিনিয়র শিক্ষকরা জানান, অধ্যাপক তাহের হত্যার পর মানববন্ধন ও প্রতিবাদ কর্মসূচির শুরুতে মিয়া মো. মহিউদ্দীনের উপস্থিতি ছিল সরব। সামনে থেকে হত্যার প্রতিবাদ জানাতেন তিনি। কিন্তু তদন্তে দেখা যায়, অধ্যাপক তাহের হত্যার ষড়যন্ত্র ও তা বাস্তবায়নে খুনিদের নানা লোভ দেখিয়ে হাত করাসহ লাশ গুম করা পর্যন্ত সব পরিকল্পনায় মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন ড. মিয়া মোহাম্মদ মহিউদ্দিন।

হত্যায় অংশ নিতে কেয়ারটেকারকে কম্পিউটার ও চাকরির প্রলোভন : আদালতে দেওয়া স্বীকারোক্তিতে জাহাঙ্গীর বলেছিলেন, মহিউদ্দিন স্যার কম্পিউটার ও চাকরির লোভ দেখিয়েছিলেন বলেই আমি ড. তাহের স্যারকে হত্যা করেছি। হত্যায় অংশ নেওয়া জাহাঙ্গীরের ভাই আবদুস সালাম ও তাদের আত্মীয় নাজমুলকেও প্রলোভন দেখান ড. মহিউদ্দিন।

ঠান্ডা মাথায় পরিকল্পনা : হত্যার মূল পরিকল্পনায় ছিলেন ড. মিয়া মো. মহিউদ্দিন। ১ ফেব্রুয়ারি রাতে জাহাঙ্গীরের হাতে একটি রিভলবার দিয়ে আগেই ড. তাহেরের বাসায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়। রাত ৯টার দিকে ড. মহিউদ্দিন, সালাম ও নাজমুল ওই বাসায় যায়। এ সময় চলছিল লোডশেডিং। কথা বলার এক পর্যায়ে জাহাঙ্গীর রিভলবারের বাঁট দিয়ে ড. তাহেরের ঘাড়ে আঘাত করে। এতে অচেতন হয়ে পড়লে তাকে ধরাধরি করে নিচে নামানো হয়। জাহাঙ্গীরের শোবার ঘরে ড. তাহেরকে নিয়ে মুখে বালিশ চাপা দিয়ে হত্যা করা হয়। মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পর বাড়ির পেছনের সেফটিক ট্যাংকে লাশ ফেলে রাখা হয়।

শিবিরের সংশ্লিষ্টতা : অধ্যাপক তাহেরের হত্যায় শিবির সংশ্লিষ্টতাও উঠে আসে। এ হত্যায় অংশ নেওয়া জাহাঙ্গীরের ভাই আবদুস সালাম শিবির কর্মী ছিলেন।

তদন্ত, রায়, আপিল, সাজা কার্যকর : ২০০৬ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি মামলা করেন ড. তাহের পুত্র সানজিদ আলভি আহমেদ। তদন্ত শেষে ২০০৭ সালের ১৮ মার্চ ছয়জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। ২০০৮ সালের ২২ মে রাজশাহীর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল মহিউদ্দিন, জাহাঙ্গীর, সালাম ও নাজমুলকে মৃত্যুদন্ডের আদেশ দেন। সালেহী ও আজিমুদ্দিনকে খালাস দেওয়া হয়। ২০১৩ সালের ২১ এপ্রিল হাই কোর্টের রায়ে মিয়া মহিউদ্দিন ও জাহাঙ্গীরের মৃত্যুদন্ড বহাল রাখা হয়। সালাম ও নাজমুলের সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেওয়া হয়। ২০২২ সালের ৫ এপ্রিল এ মামলার রায় হয় আপিল বিভাগে। একই বছরের ১৫ সেপ্টেম্বর আপিল বিভাগের রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশ হয়। চলতি বছর ২ মার্চ মৃত্যুদন্ডের দুই আসামিসহ তিনজনের রায় পুর্নবিবেচনার (রিভিউ)আবেদন খারিজ হয়ে যায়। রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদনও নাকচ হয়। তার চিঠি ও সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র ৫ জুলাই রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে পৌঁছায়। জাহাঙ্গীরের ফাঁসি কার্যকরের প্রক্রিয়া স্থগিত চেয়ে আবেদন করে তার ভাই সোহরাব। ১৭ জুলাই বিচারপতি ভীষ্মদেব চক্রবর্তী ও বিচারপতি মো. আলী রেজার হাইকোর্ট বেঞ্চ ওই রিট খারিজ করে আদেশ দেন। রিট খারিজের পর মৃত্যুদন্ড ঠেকাতে নথিপত্র নিয়ে মার্কিন দূতাবাসে যোগাযোগ করলেও সাড়া পায়নি জাহাঙ্গীরের পরিবার।

আমরা ন্যায়বিচার পেলাম, আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জানাই : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. এস তাহের আহমেদ হত্যা মামলায় দুই আসামির ফাঁসির রায় কার্যকর হওয়ায় প্রথমেই মহান আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করেছেন তার মেয়ে সেগুফতা তাবাসসুম আহমেদ। তিনি বলেন, এই ফাঁসি কার্যকরের মাধ্যমে আমরা ন্যায়বিচার পেলাম। এর জন্য দীর্ঘ ১৭ বছর ৬ মাস অপেক্ষা করতে হয়েছে। দীর্ঘ এই প্রতীক্ষা আমাদের কীভাবে কাটতে হয়েছে তা আর কীভাবে বলব। তবে এত বছর পরও আমার বাবার হত্যাকারীদের ফাঁসির রায় কার্যকর হওয়ায় আমরা সন্তুষ্ট। এ জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, আইনজীবী, বিচারক এবং সর্বপরি সরকারের কাছে কৃতজ্ঞতা জানাই।

রাত ১১টা ৫৮ মিনিটে কারাগার থেকে পুলিশি প্রহরায় মহিউদ্দিন ও জাহাঙ্গীরের লাশ তাদের বাড়ির উদ্দেশে আলাদা আলাদা অ্যাম্বুলেন্সে করে কারাগার থেকে বের করা হয়। শিক্ষক মহিউদ্দিনের লাশ নিয়ে যাওয়া হয় ফরিদপুরের ভাঙ্গার উদ্দেশে। কেয়ারটেকার জাহাঙ্গীরের লাশ নিয়ে যাওয়া হয় নগরীর খোজাপুর এলাকায়।

নগরীর রাজপাড়া থানার উপপরিদর্শক কাজল নন্দী জানান, পুলিশ তাদের স্বজনদের লাশ বুঝিয়ে দেবে। দাফন কাজ শেষ হওয়া পর্যন্ত পুলিশ থাকবে।

সহকর্মী ও শিক্ষার্থীদের সন্তোষ : ড. তাহের হত্যার আসামিদের ফাঁসি কার্যকরের খবরে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী রোহান ইসলাম বলেন, হত্যাকারীদের শাস্তির দাবিতে আমরা অনেকবার মানববন্ধন করেছি। অবশেষে খুনিদের ফাঁসি কার্যকর হলো। আইন বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক হাসিবুল আলম প্রধান বলেন, রায় কার্যকরের মধ্য দিয়ে শিক্ষাঙ্গনে একটা বার্তা গেল, হত্যাকান্ড ঘটিয়ে কেউ পার পায় না। দন্ড ভোগ করতে হয়। ড. তাহেরের সহকর্মী ও বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক সুলতান-উল-ইসলাম বলেন, তাহের স্যারের পরিবার অবশেষে বিচার পেয়েছে এর জন্য আমরা খুশি।

মহিউদ্দিনের দাফন ভাঙ্গায় : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) অধ্যাপক এস তাহের আহমেদ হত্যা মামলায় ফাঁসি হওয়া মিয়া মোহাম্মদ মহিউদ্দিনের দাফন হবে ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলার তুজারপুর ইউনিয়নের জান্দী গ্রামে। পারিবারিক কবরস্থানে বাবার কবরের পাশেই আজ তাকে দাফন করা হবে বলে জানান মহিউদ্দিনের ছোট ভাই আরজু মিয়া। এলাকায় মহিউদ্দিন সূর্য মিয়া নামে পরিচিত। মহিউদ্দিনের লাশ গ্রহণের জন্য আরজু মিয়া গতকাল সকালে রাজশাহী গেছেন। এদিকে গতকাল বিকাল ৪টা পর্যন্তও তার মা সেতারা বেগমকে (৮২) ফাঁসি কার্যকরের তথ্য জানানো হয়নি। মহিউদ্দিনের ছোট বোন রিনা বেগম বলেন, মাকে আমরা বিষয়টি এখনো জানাতে পারিনি। সেতারা বেগমের তিন ছেলে ও দুই মেয়ের মধ্যে মহিউদ্দিন সবার বড়।

সর্বশেষ খবর