মঙ্গলবার, ১ আগস্ট, ২০২৩ ০০:০০ টা

বেসরকারি খাতে ঋণে ভাটা

দেড় বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম, নেপথ্যে মূল্যস্ফীতি জ্বালানি সংকট, বহুমুখী চ্যালেঞ্জে কমেছে বিনিয়োগ কর্মসংস্থানে নেতিবাচক প্রভাব

শাহেদ আলী ইরশাদ

বেসরকারি খাতে ঋণে ভাটা

বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি ১৮ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে পৌঁছেছে। মূল্যস্ফীতি, জ্বালানি সংকট, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাসহ বহুমুখী চ্যালেঞ্জে ঋণ বিতরণ কমে গেছে। আগামীতে যার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে কর্মসংস্থানে। ব্যাংকাররা মনে করছেন, বিনিয়োগের জন্য গ্যাস-বিদ্যুতের চ্যালেঞ্জের সঙ্গে রাজনৈতিক স্থিতাবস্থা বজায় রাখা জরুরি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি মে মাসে ১১ দশমিক ১ শতাংশ থেকে কমে জুনে ১০ দশমিক ৫৭ শতাংশে নেমে এসেছে। ২০২১ সালের নভেম্বরের পর জুনে ঋণের প্রবৃদ্ধি সর্বনিম্ন ১০ দশমিক ১১ শতাংশ ছিল। ২০২০-২১ অর্থবছরে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি ছিল ৮ দশমিক ৩৫ শতাংশ, ২০২১-২২ অর্থবছরে ১৩ দশমিক ৬৬ শতাংশ এবং ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১০ দশমিক ৫৭ শতাংশ।

ব্যাংকাররা বলছেন, দেশের ব্যাংকিং খাতে তারল্য ঘাটতির কারণে জুনে বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি কমেছে। বিভিন্ন কারণে গত কয়েক মাসে ব্যাংক খাতে অতিরিক্ত তারল্য ক্রমাগত হ্রাস পেয়েছে। যেমন বাণিজ্যিক ব্যাংকে ডলারের ঘাটতির মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডলার বিক্রি বাড়ানো, আমানতের সুদহার কম, ক্রমবর্ধমান খেলাপি ঋণ এবং ব্যাংক কেলেঙ্কারির আতঙ্কে গ্রাহকরা ব্যাংক থেকে নগদ টাকা তুলে নিয়েছেন। ফলে অনেক ব্যাংক নগদ টাকার সংকটে ভুগছে এবং প্রতিদিনের কার্যক্রমের জন্য নগদ টাকার চাহিদা মেটাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং অন্যান্য বড় ব্যাংকের কাছ থেকে ধারও নিতে হয়েছিল। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, ২০২২ সালের জুনে ব্যাংকগুলোয় অতিরিক্ত তারল্যের পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৩ হাজার কোটি টাকা। ২০২৩ সালের জুন শেষে অতিরিক্ত তারল্যের পরিমাণ ১ কোটি ৬৭ লাখ কোটি টাকায় নেমে এসেছে।

ব্যাংকাররা বলেছেন, দেশের অর্থনীতি উচ্চ মূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক মুদ্রা বাজারে অস্থিরতা, ডলারের ঘাটতি এবং জ্বালানি সংকটসহ কিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে, যার ফলে যৌথভাবে ব্যবসায়িক কার্যক্রম হ্রাস পেয়েছে। বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে অনেক ব্যবসায়ী ব্যাংক ঋণ নিতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। ব্যাংকাররা আরও বলছেন, সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক আমদানির ওপর নজরদারি জোরদার করেছে এবং আমদানির ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করেছে, যার ফলে ব্যবসায়িক কার্যক্রমের গতি কমে গেছে এবং একই সঙ্গে ঋণের চাহিদা হ্রাস পেয়েছে। আমানত কমে যাওয়ার পাশাপাশি খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ার কারণে নতুন করে ঋণ বিতরণ ব্যাংকগুলোর জন্য কঠিন হয়ে গিয়েছিল।

এসব বিষয়ে বেসরকারি ব্যাংকের এমডিদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও ব্র্যাক ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) সেলিম আর এফ হুসেন গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বর্তমান অস্থিতিশীল বৈশ্বিক এবং দেশের পরিবেশে ব্যবসায়ীরা নতুন কোনো প্রকল্পে বিনিয়োগ করছেন না। সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে বেঁচে থাকার চেষ্টা করছেন। তিনি আরও বলেন, বিনিয়োগের জন্য গ্যাস-বিদ্যুতের চ্যালেঞ্জের সঙ্গে এ ধরনের স্থিতাবস্থা বজায় রাখা জরুরি। নির্বাচনের বছর অনেক ব্যবসায়ী মনে করছেন পরিবেশ অস্থিতিশীল হতে পারে। তাই তারা নতুন করে বিনিয়োগে যাচ্ছেন না।

এদিকে আর্থিক খাতে ডলারের ঘাটতি মেটাতে বাংলাদেশ ব্যাংক ২০২২ সালের জুলাই থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত ১ হাজার ৩৫৭ কোটির বেশি ডলার বিক্রি করেছে ব্যাংকগুলোর কাছে। ফলস্বরূপ ব্যাংকব্যবস্থা থেকে স্থানীয় মুদ্রায় সমপরিমাণ অর্থ সংগ্রহ করা হয়েছে। ২০২১ সালের আগস্টে দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ৪ হাজার ৮৬০ কোটি ডলার। ২০২৩ সালের জুলাই শেষে নেমে এসেছে ২ হাজার ৯৬৮ কোটি ডলার। এক বছরের ব্যবধানে মার্কিন ডলারের বিনিময় হার ৯০ থেকে দ্রুত বেড়ে ১০৯ টাকা হয়েছে। এতে টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে ২৫ শতাংশের বেশি। বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি ২০২২ সালের আগস্টে ১৪ দশমিক ০৭ শতাংশে পৌঁছেছে, যা বাংলাদেশ ব্যাংক ঘোষিত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের মুদ্রানীতির লক্ষ্যমাত্রা ১৪ দশমিক ১ শতাংশের কাছাকাছি। গত ৩ জুলাইয়ে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো প্রকাশিত মূল্যস্ফীতির তথ্য বলছে, জুনে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৭৪ শতাংশ। এর আগে মে-তে ছিল ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশ আর এপ্রিলে ৯ দশমিক ২৪ শতাংশ। জুনে মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৭৪ শতাংশ হওয়ার মানে হলো, ২০২২ সালের জুনে একজন মানুষ যে পণ্য ও সেবা ১০০ টাকায় কিনত, চলতি বছরের জুনে একই পণ্য কিনতে তার খরচ হয়েছে ১০৯ টাকা ৭৪ পয়সা। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে খরচ বেড়েছে ৯ টাকা ৭৪ পয়সা। জানতে চাইলে গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ব্যাংকের আমানতের প্রবৃদ্ধি তো কম, বিনিয়োগের প্রবৃদ্ধি বেশি হবে কী করে? আগে আমানত বাড়াতে হবে। আমানত না বাড়ালে বিনিয়োগও বাড়বে না। মানুষ ব্যবসা না করলে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে কীভাবে? তিনি আরও বলেন, ‘বর্তমানে যাদের কর্মসংস্থান আছে তাদেরই কর্মে রাখা কঠিন হবে। নতুন কর্মস্থানের কথা বাদই দিলাম। সামনে জাতীয় নির্বাচন সবাই এটা নিয়েই ব্যস্ত থাকবে। মানুষের চলাচলে বিঘ্ন ঘটছে। মানুষ ঠিকমতো চলতে না পারলে অর্থনীতি চলবে কী করে?’

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর