শনিবার, ৫ আগস্ট, ২০২৩ ০০:০০ টা
বিএমইটির শত কোটি টাকার ভুয়া স্মার্টকার্ড বাণিজ্য

তদন্তের পরও কিছুই হলো না দোষীদের

কূটনৈতিক প্রতিবেদক

জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে আরব আমিরাতে গমনেচ্ছু কর্মীদের নামে অবৈধভাবে অতিরিক্ত প্রায় ৪ হাজার বহির্গমন ছাড়পত্র ইস্যু করেও পার পেয়ে গেছেন জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো বা বিএমইটির দায়ী কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের তদন্তে বিএমইটিতে হওয়া এই অবৈধ বাণিজ্যের তথ্য উঠে আসার পর তোলপাড় হলেও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি প্রকৃত অর্থে দায়ী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে। সিন্ডিকেট তৈরি করে শত কোটি টাকার এই বাণিজ্য করলেও শুধু একজন চুক্তিতে নিয়োগপ্রাপ্ত সিস্টেম অ্যানালিস্ট ও রিক্রুটিং এজেন্সির ওপর দায় চাপিয়ে বের হয়ে গেছেন অন্যরা। সিন্ডিকেটের প্রধান কর্তা এখন জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো বা বিএমইটির আরেকটি বিভাগের পরিচালকের দায়িত্ব নিয়ে রয়েছেন বহাল তবিয়তে। ফলে ভুয়া স্মার্টকার্ড এখন বিএমইটিতে ‘কালচার’-এ পরিণত হয়েছে।

কর্মকর্তারা জানান, সাধারণভাবে বিএমইটির স্মার্টকার্ডই হলো বিদেশে কাজের জন্য যাওয়া বাংলাদেশিদের সরকারি স্বীকৃতি। বিদেশে কর্মস্থল ও কাজের ধরনসহ সব ধরনের তথ্য যাচাই-বাছাইয়ের পরই এই কার্ড দেয় বাংলাদেশ সরকার। মূলত বিএমইটির বহির্গমন শাখার পরিচালকই হলেন এই যাচাই-বাছাইয়ের দায়িত্বশীল কর্মকর্তা। তৎকালীন বহির্গমন শাখার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কারও এই দায় এড়ানোর সুযোগ নেই। প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ও তদন্ত কমিটির প্রধান মো. আবদুল করিমের গত বছরের অক্টোবরে জমা দেওয়া তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে চলতি ২০২২ সালের ১২ মে পর্যন্ত সংযুক্ত আরব আমিরাতে কর্মী নিয়োগের জন্য মন্ত্রণালয়ের অনুমতি ও বিএমইটির স্মার্টকার্ড ইস্যুর তথ্য বিশ্লেষণ অবৈধভাবে ৩ হাজার ৯৭৮টি স্মার্টকার্ড ইস্যুর প্রমাণ পাওয়া যায়। প্রতিবেদনে বলা হয়, সরকারের অতিগুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান বিএমইটি কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী ও কিছু রিক্রুটিং এজেন্সির যোগসাজশে একটি অবৈধ, দুর্নীতিপরায়ণ সিন্ডিকেটে পরিণত হয়। সরাসরি জড়িতদের মধ্যে রয়েছে- তৎকালীন পরিচালক (বহির্গমন) উপসচিব মোহাম্মদ মিজানুর রহমান ভূঁইয়া, উপপরিচালক (বহির্গমন) মো. আবুল কালাম আজাদ, সহকারী পরিচালক লিটন কান্তি চৌধুরী, বহির্গমন শাখার সহকারী পরিচালক শেলীনা আক্তার, বহির্গমন শাখার ডাটা এন্ট্রি অপারেটর মো. সাইফুল ইসলাম, বহির্গমন শাখার প্রধান সহকারী শামীমা ফেরদৌসী, বহির্গমন শাখার জনশক্তি জরিপ কর্মকর্তা মো. ইমারত হোসেন মোল্লা ও সিস্টেম অ্যানালিস্ট মো. সাইদুল ইসলাম। তদন্ত প্রতিবেদনে স্মার্টকার্ড কেলেঙ্কারিতে জড়িত প্রত্যেকের বিষয়ে বিস্তারিত তুলে ধরা হয়। অভিযোগ আছে, প্রতিটি ভুয়া স্মার্টকার্ডে ১ লাখ টাকা সংগ্রহ করে শত কোটি টাকার বাণিজ্য করা হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, বিশাল এই অপকর্মের শান্তি নিশ্চিত হলে ভুয়া স্মার্টকার্ডের চর্চা থেকে মুক্ত হওয়া যেত। সার্ভারে তথ্য তুলে স্মার্টকার্ড ইস্যুর পর তথ্য মুছে দেওয়ার মতো জাল-জালিয়াতি বন্ধ হতো। তাহলে চলতি বছরের জুলাই মাসেও ১২০ জন মালয়েশিয়াগামী কর্মীর ভুয়া স্মার্টকার্ড বানিয়ে মালয়েশিয়া প্রেরণের মতো ঘটনা ধরা পড়ত না। জানা যায়, মালয়েশিয়ার এই ভুয়া স্মার্টকার্ডের ক্ষেত্রেও সংশ্লিষ্ট কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে শুধু ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে রিক্রুটিং এজেন্সির বিরুদ্ধে। গত মঙ্গলবার প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের এক আদেশে আল-মামুন ওভারসিজ নামের এক এজেন্সির লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে। বিএমইটিকে দেওয়া মন্ত্রণালয়ের আরেক আদেশে এজেন্সি মালিক মোশাররফ হোসেন পাটোয়ারী ও কর্মচারী রবিনের বিরুদ্ধে তিন দিনের মধ্যে ফৌজদারি মামলা করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বিএমইটির জড়িত কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে। এ দফায় কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীকে চিহ্নিতও করা হয়নি। রিক্রুটিং এজেন্সির মালিকরা বলছেন, স্মার্টকার্ড তৈরির পুরো প্রক্রিয়ায় শুধু আবেদন ও গ্রহণ ছাড়া অন্য কোথাও রিক্রুটিং এজেন্সিরা জড়িত থাকে না। পুরো প্রক্রিয়া করে বিএমইটির কর্মকর্তারা। বহির্গমন শাখার কর্মকর্তা-কর্মচারীরাই সব কাজ করে। তাহলে শুধু রিক্রুটিং এজেন্সির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা কেন, বিএমইটির জড়িতদের বিরুদ্ধে কেন কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হবে না। মন্ত্রী-সচিবদের কাছে এ বিষয়গুলো অবহিত করার পরও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না বলে আক্ষেপ জনশক্তি রপ্তানিকারকদের।

সর্বশেষ খবর