সোমবার, ৭ আগস্ট, ২০২৩ ০০:০০ টা

অভিযোগ এমপিদের বিরুদ্ধে

ছাত্রলীগ থেকে মনোনয়নের দাবি - সব ভারপ্রাপ্তকে করা হলো ভারমুক্ত

নিজস্ব প্রতিবেদক

আওয়ামী লীগের বিশেষ বর্ধিত সভায় দলীয় এমপিদের বিরুদ্ধে দলীয় সভানেত্রীর কাছে নালিশ দিলেন তৃণমূল নেতারা। গতকাল গণভবনে সাড়ে ১০টা থেকে বিকাল সোয়া ৫টা পর্যন্ত এই বিশেষ বর্ধিত সভায় জেলা-উপজেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের ৩০ জনের অধিক নেতা বক্তৃতা করেন। তাদের অনেকের মুখ থেকে বেরিয়ে আসে দলীয় এমপিদের বিরুদ্ধে অভিযোগের পাহাড়। এ ছাড়া দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যেন ছাত্রলীগ থেকে উঠে আসা নেতৃত্বকে মনোনয়ন দেওয়ার দাবি জানানো হয়। এক ঘণ্টার বিরতি দিয়ে প্রায় ৬ ঘণ্টার মধ্যে ৫ ঘণ্টাই তৃণমূল নেতা-কর্মীদের বক্তব্য শোনেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তৃণমূল নেতারা সবাই দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঐক্যবদ্ধ থেকে নৌকায় ভোট দিয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যাকে টানা চতুর্থ মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী করার শপথ নেন। একই সঙ্গে তৃণমূল থেকে আসা নেতারা ঘোষণা করেন, বিএনপি এক দফা ঘোষণা করেছে। আমাদেরও এক দফা আছে, সেটা হলো সংবিধান মেনে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনেই নির্বাচন। শেখ হাসিনার বিকল্প কোনোভাবেই তৃণমূল আওয়ামী লীগ মেনে নেবে না। গতকালে বিশেষ বর্ধিত সভা থেকে জেলা-উপজেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করা নেতাদের ভারমুক্ত করা হয়। তৃণমূল নেতা-কর্মীদের মতামতের ভিত্তিতে দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনা এই ঘোষণা দেন। বৈঠকে উপস্থিত একাধিক সূত্র এমন তথ্য নিশ্চিত করেছে। সূত্র জানায়, বৈঠকে চট্টগ্রাম জেলা মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি মাহাতাব উদ্দিন বলেন, বিএনপি এক দফা দিয়েছে। আমাদেরও এক দফা আছে। সেটা সংবিধান মেনে বর্তমান সরকারের অধীনেই নির্বাচন। শেখ হাসিনার বাইরে কোনো নির্বাচন আমরা তৃণমূল আওয়ামী লীগ মানব না। পটুয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি কাজী আলমগীর তার বক্তব্যে বলেন, পটুয়াখালী জেলার তৃণমূলের আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা ভালো নেই। তাদের কথা আমরা আমাদের সরকারের সুফল ঘরে তুলে নিতে পারিনি। দলের প্রতীক নিয়ে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের অনেকেই দলের দুস্থ ও গরিব নেতা-কর্মীদের খোঁজখবর রাখেন না। এমপিরা খোঁজখবর রাখেন না। জেলার সব উপজেলায় সাংগঠনিক অবস্থা ভালো আছে। কিন্তু বাউফল উপজেলায় অনেকদিন ধরে বিরোধ চলছে। সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের গ্রুপিংয়ের কারণে প্রায়ই সেখানে মারামারির মতো ঘটনা ঘটছে। বরগুনার তালতলী উপজেলা আওয়ামী লীগের রেজাউল কবির রিজভী বলেন, তৃণমূলের অন্তর্কোন্দলের কারণে খুবই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। যাদের মনোনয়ন দেন, এমপি হওয়ার পর তারা তৃণমূলের সঙ্গে খোঁজখবর রাখেন না। ইউপি নির্বাচনে যারা বিদ্রোহী প্রার্থীর পক্ষে কাজ করেছেন তাদের দলীয় মনোনয়ন দেবেন না। যারা তৃণমূল নেতা-কর্মীর মনের ভাষা বোঝেন না, তাদের আর নৌকা দেবেন না। দিনাজপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আলতাফুজ্জামান মিতা বলেন, খালেদা জিয়ার বেড়ে ওঠা দিনাজপুরে। ফলে বিএনপি সেখানে কিছু ভোট পেত। গত সাড়ে ১৪ বছরে জেলায় ব্যাপক উন্নয়ন হওয়ায় সেখানে বিএনপির ভোট এখন অনেক অনেক কমে গেছে। আওয়ামী লীগের ভোট বেড়েছে কয়েকগুণ। দিনাজপুর জেলা সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী। কিন্তু এখনকার একজন এমপির কাছে যেতে পারছি না। উনি, দল মানেন না, নেতা মানেন না। উনি জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক, কেন্দ্রীয় নেতাদের নামে বিশ্রী ভাষায় বক্তৃতা করেন। আগামী নির্বাচনে দিনাজপুরের ৬টি আসনেই নৌকার বিজয় উপহার দেওয়ার কথা জানান তিনি। যশোর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শহীদুল ইসলাম মিলন বলেন, আমাদের ভিতরে ঐক্য নেই। আওয়ামী লীগ আজ দুই ভাগে বিভক্ত। একভাগ হচ্ছে, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, আরেক ভাগ হচ্ছে ‘আমিলীগ’। নেত্রী আপনি মনোনয়ন দিয়ে এমপি-উপজেলা চেয়ারম্যান, মেয়র বানান। আর তারা আওয়ামী লীগ বাদ দিয়ে ‘আমিলীগ’ করে। তারা টিআর কাবিখা কোথায় দেয়, কাকে দেয় দল জানে না। আওয়ামী লীগের দুর্দিনের লোকের টাকা নেই। তাই চাকরি হয় না। অথচ জামায়াত-বিএনপির লোকেরা চাকরি পায়। কারণ টাকা দেয়। এর বিহিত করা উচিত।  বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তালুকদার ইউনুছ বলেন, যারা এমপি নির্বাচিত হন, তারা জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যান। তারা যদি রাজপথের কর্মীদের সম্মান না দেন, তাহলে সমস্যা সৃষ্টি হয়। অনেকেরই এমপিসহ অন্য কিছু হওয়ার স্বপ্ন থাকে। বগুড়া জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মজিবুর রহমান মজনু বলেন, অরাজনৈতিক ব্যক্তিরা এমপি হওয়ায় তারা অগ্নিসন্ত্রাসের মদদদাতাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয়। এদের বিতাড়িত করতে হবে। রাজনীতি করা, ছাত্রলীগের সাবেক নেতাদের মনোনয়ন দিতে হবে। পঞ্চগড় জেলা সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার সাদাত সম্রাট বলেন, পঞ্চগড় এখন ভূমিহীন ও গৃহহীন মুক্ত জেলা। সাধারণ মানুষ তো প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া ঘর উপহার পেয়েছেন। বিএনপির অসচ্ছল নেতা-কর্মীদের প্রতিও কোনো অবিচার করা হয়নি।  একজন বিএনপি নেতার বক্তব্য তুলে ধরে তিনি বলেন, উপকারভোগী বিএনপি নেতারাও ব্যক্তিগত আলাপে বলেন, দেশ চালানোর জন্য শেখ হাসিনার বিকল্প নেই। জামালপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বিজন কুমার দাস আগামীতে প্রার্থী চূড়ান্তে জনপ্রিয়দের অগ্রাধিকার দেওয়ার অনুরোধ জানান। নির্বাচনের আগেই জেলার সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনগুলোর মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি দেওয়ার অনুরোধ জানান।  কুমিল্লা উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি রুহুল আমিন বলেন, সব ভেদাভেদ ও কোন্দল দূর করে আগামী জাতীয় নির্বাচনেও জেলার ৬টি আসনেই নৌকার বিজয় উপহার দেওয়া হবে। জরিপের ভিত্তিতে জনপ্রিয়দের মনোনয়ন দেওয়ার দাবি জানান তিনি। এ সময় তিনি প্রধানমন্ত্রীকে একটি দেশাত্মবোধক গান গেয়ে শোনান। লালমনিরহাট জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মতিয়ার রহমান বলেন, লালমনিরহাটে আগামীতে লাঙ্গলের পরিবর্তে নৌকা মার্কার মনোনয়ন দেওয়ার দাবি জানান তিনি। এ সময় লালমনিরহাটের উন্নয়ন চিত্র তুলে ধরেন তিনি। জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, লালমনিরহাট তো লালে লাল হয়ে গেছে। অনেক কিছু দিয়েছি। ফেনী জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সংসদ সদস্য নিজাম হাজারী বলেন, খালেদা জিয়ার জন্মস্থান হওয়ায় ফেনী এক সময় বিএনপির ঘাঁটি ছিল। সাড়ে ১৪ বছরে জেলার প্রতিটি এলাকায় উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে। ফেনী এখন আর বিএনপির ঘাঁটি  নেই। ফেনী এখন আওয়ামী লীগের ঘাঁটি। বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তালুকদার মোহাম্মদ ইউনুছ বলেন, অনেকেরই এমপি হওয়ার স্বপ্ন থাকতে পারে। সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ হলো আমাদের ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। সিরাজগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুস সামাদ তালুকদার দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনার উদ্দেশে বলেন, নেত্রী আওয়ামী লীগ নেতা ও জনপ্রতিনিধিরা আজকে আপনার সামনে কমিটমেন্ট করে যাবেন যে আমরা দলের ভিতরে কোনো বিভাজন করব না। নেতা-কর্মীদের সঙ্গে সম্পর্ক বাড়াব। যাকেই মনোনয়ন দেবেন আমরা তার পক্ষেই কাজ করব। কুমিল্লা উত্তর আওয়ামী লীগের সভাপতি রুহুল আমিন বলেন, আমার জেলায় পাঁচজন এমপি আছে। তাদের ব্যাপারে খোঁজখবর নেন। এমপিরা স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে মিলেমিশে কাজ করেন না।  আপনার প্রতীক নিয়ে তারা ভোট করে কিন্তু দলীয় নেতা-কর্মীদের অনেক অভিযোগ আমরা শুনতে পাই। আমাদের ক্ষমতা দিন, যেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারি। কিশোরগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি জিল্লুর রহমান বলেন, আমরা ‘ভাইলীগ’, ‘বোনলীগ’ করি। এগুলো বন্ধ করতে হবে। ইদানীং অনেক ভোট হয়েছে, সেখানে ভোটার উপস্থিতি অনেক কম। ঢাকার মতো জায়গায় কেন এত কম ভোট পড়বে। গুলশান বনানীতে শিক্ষিত লোক বসবাস করেন। তারা কেন হিরো আলমকে ভোট দেবে? কারণ আওয়ামী লীগের লোকজন ভোট কেন্দ্রে যান না। কেন জান না তা খুঁজে বের করতে হবে। নরসিংদী জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি জি এম তালেব হোসেন বলেন, নেত্রী আপনি যাকে খুশি মনোনয়ন দিন। আমরা বিজয়ী করব। তবে একটা দাবি তৃণমূলের সঙ্গে যাদের যোগাযোগ নেই তাদের মনোনয়ন দেবেন না। নোয়াখালীর সভাপতি খায়রুল হক সেলিম বলেন, নেত্রী আপনি বলছেন, শতফুল ফুটতে দিন। শত ফুুল তো ফুটতেই দেয় না। ফুল তো কেটে ফেলা হয়। কেউ যেন এই ফুল কেটে ফেলতে না পারে সে ব্যাপারে সজাগ থাকবেন। কোটচাঁদপুর উপজেলা আওয়ামী লীগ নেত্রী শরিফুন নেসা মিকি বলেন, উপজেলা চেয়ারম্যানদের ক্ষমতা একেবারে কম। নেত্রী আপনি একটু নজর দিন। আমরা নির্বাচিত হয়েছি, কিন্তু সেভাবে জনগণের জন্য কাজ করতে পারি না। পিরোজপুর জেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক কানাই লাল বক্তৃতার শেষে তাকে ভারমুক্ত করার দাবি জানান দলীয় সভানেত্রীর কাছে। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বলেন, ওকে যাও, এই সভা থেকে তোমাকে ভারমুক্ত করলাম। এরপর তিনি বলেন, আর কেউ ভারপ্রাপ্ত থাকবে না। সবাইকে ভারমুক্ত করা হলো- কি আপনারা (তৃণমূল থেকে আসা নেতা-কর্মীরা) অনুমতি দিলেন তো? জবাবে নেতারা দুই হাত তুলে দলীয় সভানেত্রীকে হ্যাঁ উত্তর দেন।  সমাপনী বক্তব্যে দলীয় নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আমি আপনাদের সঙ্গে আজ ৪২ বছর। আমার ওপর দায়িত্ব দিয়েছিলেন। আমি প্রতিটি গ্রামে গিয়েছি। মানুষের দুঃখ কষ্ট বোঝার চেষ্টা করছি। আওয়ামী লীগ আগের চেয়ে অনেক শক্তিশালী। হ্যাঁ, আমাদের দল যেমন বড়, তেমনি নেতা-কর্মীর সংখ্যাও অনেক। অনেক যোগ্য ব্যক্তি আছেন, যাদের আমরা মনোনয়ন দিতে পারি না। প্রয়োজনে যেখানে যাকে মনোনয়ন দেওয়া হয়, সেখানেই তার পক্ষে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করবেন। কোনো ভেদাভেদ করা যাবে না। সামনে নির্বাচনে নৌকাকে বিজয়ী করে বিজয়ী পতাকা নিয়ে গণভবনে আসবেন, সেই আমন্ত্রণ রইল। বৈঠক সূত্র জানায়, তৃণমূল নেতাদের মধ্যে আরও বক্তব্য রাখেন, বরগুনার তালতলী উপজেলার সভাপতি রেজাউল কবির রিজভী, রাজশাহী জেলার সভাপতি অনিল কুমার সরকার, গোমস্তাপুর উপজেলার সভাপতি গোলাম মোস্তফা বিশ্বাস, সিলেট জেলার সভাপতি শফিকুর রহমান চৌধুরী, কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আলী আমজাদ, ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পনিরুজ্জামান তরুণ, ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শামীম হক, গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আজমত উল্লা খান, কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মজিবুর রহমান, খুলনা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হারুন অর রশিদ, কাপ্তাই উপজেলার সভাপতি ওয়াং শিং সাই, মুজিবনগর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি রফিকুল ইসলাম, সাতক্ষীরা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ফজলুল হক, রাজশাহীর মতিহার থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুল মান্নান, মুন্সীগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ, নরসিংদী জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি জি এম তালেব হোসেন, মৌলভীবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মেসবাউর রহমান, তাড়াইল উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আজিজুল হক ভুইয়া প্রমুখ।

সর্বশেষ খবর