সোমবার, ৭ আগস্ট, ২০২৩ ০০:০০ টা

খুনের কন্ট্রাক্ট নেওয়া হয় দুই পক্ষ থেকেই

সাখাওয়াত কাওসার

দুই পক্ষের কাছ থেকেই খুনের কন্ট্রাক্ট নিয়েছিলেন মো. এসহাক মিয়া। এখলাস ও মনির কোম্পানি- দুই পক্ষের সঙ্গেই ভালো সম্পর্ক থাকায় কেউই ন্যূনতম সন্দেহ করেনি তাকে। নিহত এখলাসের কাছ থেকে এসহাক নিয়েছিলেন মোবাইল ফোন। চুক্তি হয়েছিল বেদখল হওয়া জমি উদ্ধার হলে এখলাস মোটা অঙ্কের টাকা দেবেন। অন্যদিকে প্রতিপক্ষ মনির কোম্পানির কাছ থেকে এখলাসকে খুনের জন্য দুই দফায় এসহাক নিয়েছিলেন ১১ লাখ টাকা। সেখান থেকে ৫ লাখ টাকা দিয়েছিলেন কিলার রহমানকে। সম্প্রতি ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের কাছে চার দিনের রিমান্ডের পর আদালতে নিজের অপরাধ স্বীকার করে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন এসহাক। ঢাকার অতিরিক্ত মুখ্য মহানগর হাকিম মো. তোফাজ্জেল হোসেন আসামির স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি রেকর্ড করেন। পরে আসামিকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন আদালত।

আদালত সূত্র বলছে, এসহাকের মতো করে বাকি আসামি মনির কোম্পানি, আবদুর রহমান এবং ফয়সল আহমদও স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন আদালতে। এর আগে আদালতের নির্দেশে তাদের প্রত্যেককে চার দিনের রিমান্ডে নিয়েছিলেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মো. হুমায়ুন কবীর। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (লালবাগ) মো. মোস্তফা কামাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘একটি ক্লুলেস মার্ডার ছিল এটি। তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তা এবং স্থানীয় সোর্সের তথ্যের ভিত্তিতে ২০-২৫ দিন পর হত্যার মোটিভ, কারা ছিল, কী কারণে এ হত্যাকা , এর পুরোটাই উদ্ঘাটন করি আমরা।’

তিনি বলেন, কামরাঙ্গীরচরে ভিকটিম এখলাসের পরিবারের ৪১ শতক জমি দখল করে রেখেছিলেন মনির কোম্পানি। আবার এখলাসের ডিভোর্সি স্ত্রী বীথি ওরফে রত্নার সঙ্গে মনির কোম্পানির অবৈধ সম্পর্কও মেনে নিতে পারছিলেন না এখলাস। খুন হওয়ার আগে এখলাসও মনির কোম্পানিকে খুন করার পরিকল্পনা করেছিলেন। এর দায়িত্বও দিয়েছিলেন এসহাককে।

সূত্র বলছে, ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেওয়া প্রত্যেকের জবানিতেই উঠে এসেছে, প্রথমত জমি সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে বিরোধ ছিল এখলাস ও মনির কোম্পানির মধ্যে। পরবর্তী সময়ে এখলাসের দ্বিতীয় স্ত্রীর সঙ্গে মনির কোম্পানির অবৈধ সম্পর্ক বিরোধের একটি কারণ ছিল। এ দুই কারণে দুই পক্ষই নিজেদের ওপর ক্ষিপ্ত ছিল। এর বড় সুবিধা নিয়েছেন এসহাক মিয়া ওরফে এসাক ওরফে ইছাহাক (৫৫)। উভয় পক্ষের কাছ থেকেই কিলিংয়ের কন্ট্রাক্ট নিয়েছিলেন এসহাক।

আদালত সূত্র জানায়, ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে এসহাক মিয়ায় জবানিতে উঠে এসেছে খুনের আদ্যোপান্ত। তিনি উল্লেখ করেছেন, তার বাবা মৃত চান মিয়া, ঠিকানা ১৫৯ গজমহল, থানা হাজারীবাগ, জেলা ঢাকা। ট্যানারি স্থানান্তরিত হওয়ার আগে হাজারীবাগে তিনি ব্যবসা করতেন। বর্তমানে বিভিন্ন কোম্পানি থেকে কেমিক্যাল ড্রাম সংগ্রহ করে বিক্রি করাই তার পেশা। ওই এলাকায় মনির কোম্পানির আইয়ুব ব্রাদার্স নামে চামড়ার ফ্যাক্টরি আছে। মনির কোম্পানির গ্রামের বাড়ি নোয়াখালী। তবে পরিবার নিয়ে বসবাস করেন রাজধানীর মোহাম্মদপুরে। ১০ বছর আগে একটি জমি কিনে দেওয়ার কারণে মনিরের সঙ্গে তার সম্পর্ক হয়। বয়সে ছোট হলেও তিনি মনিরকে নানা বলে ডাকেন। মনির কোম্পানি প্রতিদিন সকালে হাজারীবাগে চামড়ার ফ্যাক্টরিতে আসেন। এর বাইরে কামরাঙ্গীরচরে তার কমিউনিটি সেন্টারেও বসেন। আবার নিহত এখলাসের বাড়ি তার বাড়ি থেকে মাত্র ১০০ গজ দূরে। এখলাসকে তিনি মামা ডাকতেন।

জবানবন্দিতে এসহাক উল্লেখ করেছেন, কামরাঙ্গীরচরে (ঝাউচর) এখলাস ও তার ওয়ারিশদের (প্রায় ৪৫ জন) ৪০ কাঠার মতো জমি আছে। ৪০ কোটি টাকার মূল্যের এ জমি মনির কোম্পানি তিন বছর ধরে দখল করে রেখেছেন। সম্প্রতি জমি উদ্ধারের জন্য এখলাস জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে অভিযোগ করলে মনির কোম্পানি তাদের ৪-৫ কোটি টাকা দিতে রাজি হন। তবে এখলাস তা নিতে সম্মত ছিলেন না। দুই বছর আগেও এখলাস-মনিরের সম্পর্ক ভালো ছিল। এখলাসের দ্বিতীয় বিয়েতে মনির উকিল বাবা ছিলেন। তবে এখলাসের স্ত্রীর সঙ্গে পরকীয়ায় জড়িয়ে যান মনির। এখলাসের অনুপস্থিতিতে ওই বাসায় যাতায়াত ছিল তার। বিষয়টি টের পাওয়ার পর মনিরের ওপর চরম ক্ষিপ্ত হন এখলাস। জমি এবং পরকীয়া উভয় কারণে মনির কোম্পানিকে খুনের পরিকল্পনা করেন এখলাস। খুনের দায়িত্ব দেওয়া হয় এসহাককে। এ জন্য দুটি মোবাইল কিনেছিলেন এখলাস। একটি নিজের কাছে রেখে অন্যটি দিয়েছিলেন এসহাককে। এখলাস তাকে বলেছিলেন, মনির কোম্পানির কাছ থেকে জমি উদ্ধার হলে কিছু টাকা তিনি এসহাককে দেবেন।

জবানবন্দিতে এসহাক উল্লেখ করেন, এখলাসের পরিকল্পনার বিষয়টি তিনি নিজেই মনির কোম্পানিকে জানিয়েছিলেন। এখলাসের সঙ্গে এ-সংক্রান্ত কথোপকথন মনিরকে শুনিয়েছিলেন হেডফোনের মাধ্যমে। তৎক্ষণাৎ এখলাসকে মেরে ফেলার পরিকল্পনা করেন মনির। যে মার্ডার করবে তাকে ১০ লাখ এবং দায়িত্ব পালনের জন্য ১০ লাখ টাকা দেওয়ার কথা বললে টাকার লোভে পড়ে যান এসহাক। দূর সম্পর্কের ভাই রহমানকে খুনের দায়িত্ব দেন। এ জন্য রহমানকে এসহাক ৬ লাখ টাকা দিয়েছিলেন।

খুনের বিষয়ে মনির কোম্পানির দেওয়া শর্তের বিষয়টি উল্লেখ করে এসহাক বলেন, কোরবানি ঈদের আগেই কাজ শেষ করতে হবে, এখলাসের হাতের আঙুলগুলোর সামনের অংশ কেটে ফেলতে হবে এবং মুখের চামড়া খুলে ফেলতে হবে, যাতে করে কেউ তার চেহারা বুঝতে না পারে। ফিঙ্গার পরীক্ষা করেও তাকে যেন চিহ্নিত করতে না পারে। লাশ ফেলতে হবে কাঁচপুরের দিকে। এসব নির্দেশনা রহমানকে জানানো হয়েছিল। তবে সবকিছু ঠিকঠাক করলেও লাশ ফেলা হয় কামরাঙ্গীরচরে ম্যাটাডোর কোম্পানির পাশে।

এখলাসকে খুনের টাকা এখলাসের মাধ্যমেই খুনির কাছে পাঠানো হয় উল্লেখ করে এসহাক বলেন, এখলাস কোনোভাবেই কল্পনাও করতে পারেননি রহমানই তাকে খুন করবেন। এ জন্য এসহাক খুনের কন্ট্রাক্টের ২ লাখ টাকা এখলাসের মাধ্যমেই রহমানের কাছে পাঠান। বিডিআর-১ নম্বর গেটের কাছে টপ টেইলার্সের সামনে রহমানের কাছে যান এখলাস। টাকা নেওয়ার পর এখলাসকে দোকানের ভিতরে ঢুকিয়ে নিয়ে সেই দোকানের শার্টার নামিয়ে ফেলেন রহমান। শ্বাস রোধ করে মেরে ফেলেন এখলাসকে। শর্ত অনুযায়ী হাতের আঙুলগুলো কেটে ফেলেন এবং মুখম লের চামড়া খুলে ফেলেন। রাত ১১টার দিকে তাকে রহমান ফোন করে কাজ শেষ বলে অবহিত করেন। কাজ শেষ করার পর মনির কোম্পানির কাছ থেকে আরও ৬ লাখ টাকা নেন এসহাক। এ টাকা থেকে আরও ১ লাখ টাকা রহমানকে দেওয়া হয়। ২৭ জুন (পরদিন) ম্যাটাডোর ফ্যাক্টরির পাশে এখলাসের লাশ পায় পুলিশ। আদালত ও তদন্ত-সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, কিলিংয়ে অংশ নেওয়া ফয়সলকে ৫০ হাজার টাকা দেন রহমান। টপ টেইলার্সের ভিতর এখলাসকে খুন করার পর লাশ বস্তায় ভরে কামরাঙ্গীরচরে ম্যাটাডোর কোম্পানির পাশে ফেলে দেন রহমান ও ফয়সল। ওই এলাকায় ১২২ শতাংশ জমি সরকারের একটি সংস্থার জন্য অধিগ্রহণ করা হয়েছে। ওই জমির ৪১ শতাংশ এখলাস গংয়ের। ক্ষতিপূরণ বাবদ প্রায় ১২ কোটি টাকা পাওয়ার কথা ছিল এখলাস গংয়ের। তবে আরেকটি পক্ষ জমিটির দাবিদার ছিল। এখলাস জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে একটি আবেদন করে জানিয়েছিলেন, জমির মালিকানা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত যেন অধিগ্রহণের টাকা অন্য কাউকে দেওয়া না হয়। হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী মনির কোম্পানি বিএনপির প্রয়াত নেতা নাসির উদ্দিন আহমেদ পিন্টুর ঘনিষ্ঠজন। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগে যোগ দেন তিনি।

সর্বশেষ খবর