বুধবার, ৯ আগস্ট, ২০২৩ ০০:০০ টা
জন্মবার্ষিকী ও পদক বিতরণ অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী

বঙ্গমাতা পাশে থাকায় সহজ হয় জাতির পিতার সাফল্য

নিজস্ব প্রতিবেদক

বঙ্গমাতা পাশে থাকায় সহজ হয় জাতির পিতার সাফল্য

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বাবার রাজনৈতিক কারণে জীবনের যে চড়াই-উতরাই, মাকে কখনো ভেঙে পড়তে দেখিনি। বাবার পাশে থেকে সব সময় সহযোগিতা করেছেন। মা পাশে থাকাতে বাবা কিন্তু সফল হয়েছেন।

গতকাল সকালে রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিবের ৯৩তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন এবং বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব পদক-২০২৩ প্রদান অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে তিনি এসব কথা বলেন।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, বাবা রাজনীতি করেছেন, মা সংসারসহ সব গুছিয়ে রেখেছেন। ছোটবেলা থেকে তিনি একটা মানবিক চরিত্র নিয়ে গড়ে উঠেছেন। বাবার রাজনৈতিক কারণে জীবনের যে চড়াই-উতরাই, মাকে কখনো ভেঙে পড়তে দেখিনি। বাবার পাশে থেকে সব সময় সহযোগিতা করেছেন। এমনকি তাকে অর্থনৈতিক সহযোগিতাও করেছেন। মা পাশে থাকাতে বাবা কিন্তু সফল হয়েছেন। সাধারণ নারীদের মতো আমার মা যদি বলত, আজকে গয়না দাও, কালকে ফার্নিচার দাও, এটা ওটা দাও এমন করলে তো দেশ স্বাধীন করতে পারতেন না। তিনি বলেন, ৭৫ এর ১৫ আগস্ট তারা আমাদের বাড়িতে আক্রমণ করল, বাবাকে মেরে ফেলল। মা বের হয়ে আসলেন। তারা বললেন, আপনি আমাদের সঙ্গে চলেন। মা বললেন, তোমরা যেহেতু তাকে মেরে ফেলেছ, আমাকেও গুলি করে মেরে ফেল। আমি কোথাও যাব না। জীবনের পাশাপাশি মরণেও আমার বাবার সঙ্গী হয়ে চলে গেছেন মা। জাতির পিতার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ থেকে উদ্ধৃত করে প্রধানমন্ত্রী জানান, বঙ্গবন্ধু লেখেন ‘আব্বা-আম্মা ছাড়াও সবসময় রেণু (বঙ্গমাতা) আমাকে কিছু টাকা পয়সা দিয়েছে। রেণু যা কিছু জোগাড় করত বাড়ি গেলে এবং দরকার হলেই আমাকে দিত, কোনোদিন আপত্তি করেনি। নিজে মোটেই খরচ করত না, গ্রামের বাড়িতে থাকত। আমার জন্য সব রাখত।’ ‘এই ভাবে তিনি আমার বাবার পাশে থেকে তাঁকে সবরকমের সহযোগিতা দিয়েছেন’, উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী জানান, বঙ্গবন্ধু যখন বিএ পরীক্ষা দেন, কলকাতায় তখন দাঙ্গা হচ্ছিল। বঙ্গবন্ধু দাঙ্গা দমনে ঝাঁপিয়ে পড়েন, কিন্তু সে সময় বঙ্গমাতা চলে আসেন বঙ্গবন্ধুর লেখাপড়ায় সহযোগিতা করার জন্য। অনেক আত্মীয়-স্বজন সে সময় কলকাতায় থাকতেন উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাঁর মায়ের ধারণা হয়েছিল, তিনি যদি বঙ্গবন্ধুর পাশে থাকেন বাবা লেখাপড়া করবেন এবং পাস করবেন; যা করেছিলেনও তিনি। এটাও জাতির পিতা তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে লিখে গেছেন। সরকারপ্রধান বলেন, আমার বাবার সাফল্য যদি আপনারা দেখেন সেই ছাত্রজীবন থেকে মা পাশে থাকাতে তাঁর জীবন কিন্তু সাফল্যের সিঁড়ি বেয়ে ওঠে। শুধু ছাত্রজীবন থেকে নয়, রাজনৈতিক জীবনে তিনি সবসময় আমার বাবার পাশে ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তিনি (বঙ্গমাতা) বলতেন ‘রাজনীতি করো, আমার কোনো আপত্তি নেই, কিন্তু পড়াশোনা করো।’ তিনি বলেন, ‘আমার মাকেও পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা বারবার জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। মামলায় মাকে জড়ানোর চেষ্টা করা হয়েছিল। একটা পর্যায়ে পাকিস্তানের কিছু নেতা ও আওয়ামী লীগের কিছু নেতা আসেন ছয় দফার পরিবর্তে আট দফার প্রস্তাব নিয়ে। আমার মায়ের অদ্ভুত স্মরণশক্তি ছিল। তিনি শুনতেন এবং জেলখানায় গিয়ে আব্বার কাছে সেই কথাগুলো বলতেন। আব্বা যে নির্দেশনা দিতেন সেটা নেতা-কর্মীদের কাছে পৌঁছে দিতেন। আমরা মাকে ঠাট্টা করে বলতাম, ‘তুমি তো জীবন্ত টেপ রেকর্ডার।’

শেখ হাসিনা বলেন, আমার এখনো মনে আছে আমাদের বহু নেতা, আমাদের চাচার দল, আমাদেরও বোঝানোর চেষ্টা করেছে। তোমরা কিচ্ছু বুঝবে না, আট দফা দিলেই তো হয়ে গেল। মা বলতেন, এটা শুভঙ্করের ফাঁকি। আমাদের বাসায় মিটিং হতো। ওয়ার্কিং কমিটির মিটিং, ছয় দফা না আট দফা সেটা নিয়ে তুমুল বিতর্ক। আমার মা রান্নাবান্না করে সবাইকে খাওয়াতেন। তখন টাকা পয়সাও ছিল না। এত ডেকোরেশন-ডেকোরেটরও ছিল না। কিন্তু নিজের হাতেই সব করতেন। এরপর আইয়ুব খান আসলেন, আব্বার সঙ্গে প্যারোলে মুক্তি নিয়ে আলোচনা করতে। আমার মা সেখানেও বলেন, প্যারোলে না। আইয়ুব খান মামলা প্রত্যাহার করবে। সবাইকে ছেড়ে দেবে। মুক্ত মানুষ হিসেবে যাবেন। আমাদের অনেক নেতা, বেশ বড় বড় হোমড়া-চোমড়া নেতারাও তখন সেখানে আব্বাকে যে ক্যান্টনমেন্টে বন্দি রাখা হয়েছে, সেখানে সবাই চলে গেছেন এবং তাকে বোঝাবার চেষ্টা করছেন। কিন্তু আমি মার ওই বার্তাটা আব্বার কাছে পৌঁছে দিয়েছিলাম। কারণ আমার মা জানতেন এ রকম একটা ষড়যন্ত্র হচ্ছে। তাই আব্বাকে আগেই সতর্ক করেছিলেন। যখন আব্বা প্যারোলে গেলেন না, আমাদের নেতারা বাড়িতে এসে আমার মাকে ছেঁকে ধরলেন। শুধু বললেন, আপনি এটা কী করলেন? জানেন তারা (পাকিস্তানিরা) তো মেরে ফেলবে, আপনি বিধবা হবেন। মা খালি বলেছিলেন, আরও তো আসামিরা আছে? তাদেরও তো স্ত্রীরা আছে, তারাও বিধবা হবে। আমি একা সধবা থাকার চেষ্টা করব তাদের বাদ দিয়ে?’ আপনারা একটু চিন্তা করেন কত দৃঢ় মনোবল ছিল আমার মায়ের যোগ করেন, প্রধানমন্ত্রী। অনুষ্ঠানে নিজ নিজ ক্ষেত্রে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ চার বিশিষ্ট নারী ও জাতীয় নারী ফুটবল দলের মধ্যে ‘বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব পদক-২০২৩’ প্রদান করেন। বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিবের অবদানকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য আটটি ক্ষেত্রে নারীদের অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ প্রতি বছর সর্বোচ্চ পাঁচজন নারীকে এই পুরস্কার দেওয়া হয়। মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় দেশের রাজনীতি, শিক্ষা, সংস্কৃতি, খেলাধুলা এবং গবেষণায় অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ জাতীয় নারী ফুটবল দল এবং চার বিশিষ্ট নারীকে এ বছরের পুরস্কারের জন্য নির্বাচিত করে। খেলাধুলার ক্ষেত্রে সাফ ফুটবল-২০২২ এ অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন জাতীয় নারী ফুটবল দল ছাড়াও আরও চার নারী এই পদক লাভ করেন। তারা হলেন- রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের সাবেক প্রেসিডিয়াম সদস্য, দেশের প্রথম নারী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন (মরণোত্তর), শিক্ষা, সংস্কৃতি ও খেলাধুলায় নাসিমা জামান ববি ও অনিমা মুক্তি গোমেজ এবং গবেষণায় ডা. সেঁজুতি সাহা (মলিকুলার বায়োলজিস্ট)। অনুষ্ঠানে মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ফজিলাতুন নেসা ইন্দিরার সভাপতিত্বে স্বাগত বক্তব্য দেন মন্ত্রণালয়ের সচিব নাজমা মোবারেক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. তানিয়া হক বঙ্গমাতার জীবন ও কর্মকাণ্ডের ওপর ভিত্তি করে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন এবং আলোচনায় অংশ নেন জাতীয় মহিলা সংস্থার চেয়ারম্যান বেগম চেমন আরা তৈয়ব। পুরস্কারপ্রাপ্তদের পক্ষে বক্তব্য দেন জাতীয় নারী ফুটবল দলের অধিনায়ক সাবিনা খাতুন। শুরুতে বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিবের জীবন ও কর্মের ওপর নির্মিত একটি অডিও-ভিজুয়াল প্রামাণ্য প্রদর্শিত হয়। অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী আর্থিক অনুদান ও সেলাই মেশিন বিতরণ কার্যক্রমেরও উদ্বোধন করেন। সারা দেশের ৪ হাজার ৫০০ দুস্থ নারীকে সেলাই মেশিন এবং ৩ হাজার দুস্থ নারীর প্রত্যেককে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ২ হাজার করে টাকা প্রদান করা হয়।

সর্বশেষ খবর