বুধবার, ৯ আগস্ট, ২০২৩ ০০:০০ টা

ডেঙ্গুর ওষুধপত্রের খরচ নাগালের বাইরে

জয়শ্রী ভাদুড়ী

ডেঙ্গুর ওষুধপত্রের খরচ নাগালের বাইরে

রাজধানীর মুগদা হাসপাতালে গতকাল লিফটের সামনেও চলছে ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসা -বাংলাদেশ প্রতিদিন

ডেঙ্গুজ্বরের থাবায় কাঁপছে দেশ। দেশে ডেঙ্গু আক্রান্তের ইতিহাসে এ বছর সর্বোচ্চ ৩৪০ জনের মৃত্যু হয়েছে। প্রতিদিন আক্রান্তের নতুন রেকর্ড তৈরি হচ্ছে। রোগীর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে স্যালাইন, ওষুধ, ডাবসহ অন্যান্য পথ্যের দাম। চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় বাজারে দেখা দিয়েছে ওষুধ, স্যালাইনের সংকট।

পরিস্থিতি সামলাতে ওষুধ কোম্পানিগুলোর সঙ্গে বৈঠক করেছে ঔষধ প্রশাসন অধিদফতর। অধিদফতরের উপপরিচালক মো. নুরুল আলম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত বেড়ে যাওয়ায় স্যালাইনসহ এ-সংক্রান্ত ওষুধের চাহিদা অনেক বেড়েছে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় গত সপ্তাহে ওষুধ কোম্পানির সঙ্গে আমরা বৈঠক করেছি। তাদের সাপ্তাহিক ছুটির দিনেও ওষুধ উৎপাদন করতে বলা হয়েছে। আগে প্রয়োজন অনুযায়ী তারা শিফট পরিচালনা করত। এখন তিন শিফটে ওষুধ উৎপাদন করতে বলা হয়েছে। আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি মানুষের প্রয়োজনীয় ওষুধের চাহিদা নিশ্চিত করতে। নিয়মিত রোগী বাড়তে থাকলে এটা খুব কঠিন হয়ে পড়ে।’ তিনি আরও বলেন, বিস্তীর্ণ এলাকায় ডেঙ্গু রোগী ছড়িয়ে রয়েছে। মার্কেটিং পরিকল্পনার কারণে অনেক সময় কিছু জায়গায় সংকট দেখা দেয়। তাই সংকট নিরসনে একেক ওষুধ কোম্পানিকে একেক জায়গায় ওষুধ সরবরাহ করতে বলা হয়েছে। কয়েক গুণ বেশি দামে স্যালাইন, ওষুধ বিক্রি হচ্ছে- এ বিষয়ে জানতে চাইলে বলেন, ওষুধ কোম্পানি ওষুধের দাম বাড়ায়নি। কেউ বেশি দামে ওষুধ বিক্রি করলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান তিনি। ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত রোগী ৭২ হাজার ছাড়িয়েছে। রোগী বেড়ে যাওয়ায় বাজারে শিরায় দেওয়া স্যালাইন এবং মুখে খাওয়ার স্যালাইনের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় স্যালাইনের চাহিদা বেড়েছে, সে তুলনায় সরবরাহ নেই। শরীরে পানিশূন্যতা দেখা দিলে, ডায়রিয়া বা কলেরা হলে অথবা রক্তচাপ স্থিতিশীল রাখার জন্য শিরায় স্যালাইন ব্যবহারের পরামর্শ দেন চিকিৎসক। হঠাৎ ডায়রিয়া বা কলেরা বাড়লে স্যালাইনের চাহিদা কিছুটা বেড়ে যায়। ডেঙ্গু রোগীদেরও অনেক সময় স্যালাইন দেওয়ার প্রয়োজন হয়। প্রধানত শিরায় দেওয়া স্যালাইন চার ধরনের। এর মধ্যে সাধারণ বা নরমাল স্যালাইন ডেঙ্গু চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। কিছু স্যালাইন থাকে হৃদরোগে আক্রান্তদের জন্য। অন্য এক ধরনের স্যালাইনকে বলে গ্লুকোজ স্যালাইন। আবার কলেরার চিকিৎসার জন্য ভিন্ন ধরনের স্যালাইন আছে। ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাবের মধ্যেই উৎপাদন ও বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো স্যালাইনের দাম বাড়িয়েছে, সৃষ্টি হয়েছে সরবরাহ সংকট। আগে যে স্যালাইন বিক্রি হতো ৯০ টাকায়, এখন তা ১৫০ থেকে ১৬০ টাকা। আবার অনেক জায়গায় স্যালাইন পাওয়াই যাচ্ছে না। সরকারি হাসপাতালে কর্মরত কয়েকজন চিকিৎসক বলেন, রোগীর শরীরে স্যালাইন ঢোকানোর জন্য ক্যানোলা ব্যবহার করা হয়। ডেঙ্গুর সংক্রমণ বাড়ায় উৎপাদক ও সরবরাহকারীরা ক্যানোলার দাম বাড়িয়েছে। আগে ক্যানোলার যে সেটের দাম ছিল ৪০ টাকা, এখন তা ১৫০ টাকা। এর সঙ্গে দাম বেড়েছে মাইক্রোপ্রোরও (ক্যানোলা স্থাপনে ব্যবহৃত বিশেষ টেপ)। আগে এক বাক্স মাইক্রোপ্রোর দাম ছিল ৬০০ টাকা, এখন ৮০০। মিটফোর্ডের হক ফার্মেসির বিক্রয় কর্মী আসিফ আলী বলেন, ‘স্যালাইনের চাহিদা কয়েক গুণ বেড়েছে। ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের কাছে ১০০ প্যাকেটের চাহিদা দিলে তারা ৫ প্যাকেট দিচ্ছেন। তাই ৯৫ জন গ্রাহককে ফেরত পাঠাতে হচ্ছে। আগে প্রতিটি ১ হাজার মিলিলিটারের নরমাল স্যালাইন ৯০ টাকায় বিক্রি হতো। এখন তার দাম ১৫০-১৬০ টাকা। সরবরাহ সংকটে কোথাও কোথাও ৩০০-৩৫০ টাকায়ও স্যালাইন বিক্রি হচ্ছে।’ বাংলাদেশ কেমিস্টস অ্যান্ড ড্রাগিস্ট সমিতির পরিচালক জাকির হোসেন রনি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘কোনো স্যালাইনের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য বাড়েনি, কিন্তু অতিরিক্ত দামে বিক্রি হচ্ছে। বেশির ভাগ কোম্পানিই চাহিদামতো স্যালাইন, ওষুধের সরবরাহ নিশ্চিত করতে পারছে না। এজন্য বাজরে সংকট দেখা দিয়েছে। ৮০-৯০ টাকার স্যালাইন ১২০ থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। এ সময়ে ডেঙ্গুজ্বর প্রতি বছর হানা দেয়। এ আপৎকালীন সংকট কাটাতে ওষুধ কোম্পানিগুলোর আগে থেকেই পরিকল্পনা করা প্রয়োজন। ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরও বিষয়টা পর্যালোচনা করতে পারে।’

রাজধানীর হাসপাতালগুলোর সামনে একেকটি বড় আকারের ডাব ২০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। মাঝারি ও ছোট আকারের ডাব বিক্রি হচ্ছে ১২০ থেকে ১৬০ টাকায়। শাহবাগের ডাব বিক্রেতা শরীফ মৃধা বলেন, ‘এমনিতে আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে ডাবের ফলন কম থাকে। এ ছাড়া বৃষ্টির কারণে পিচ্ছিল গাছে উঠে ডাব পাড়া মুশকিল। এজন্য এর সরবরাহ আরও কমে গেছে। কিন্তু ডেঙ্গুর প্রকোপে চাহিদা তৈরি হয়েছে ব্যাপক। সবকিছু মিলিয়েই ডাবের দামের এমন ঊর্ধ্বগতি।’ মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘ডেঙ্গু আক্রান্তের রক্তের জলীয় অংশ কমে যায়। এতে রক্তের ঘনত্ব বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি রক্তচাপ কমে যায়। রক্তের তারল্য ঠিক ও রক্তচাপ স্থিতিশীল রাখতে রোগীকে স্যালাইন দিতে হয়। অনেকে বারবার বমি করে, মুখে তরল খাবার খেতে পারে না। তাই ফ্লুইডের ঘাটতি মেটাতে শিরায় স্যালাইন দিতে হয়।’ প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক আরও বলেন, ‘ডেঙ্গুজ্বর হলে রোগীদের ফলমূলের জুস, ডাবের পানি খেতে বলা হয়। বমি বা পাতলা পায়খানায় পটাশিয়ামের ঘাটতি মেটাতে ডাব কার্যকর। কিন্তু স্যালাইন, ডেঙ্গুজ্বরে প্রয়োজনীয় ওষুধ, ডাবসহ অন্যান্য ফলমূল কয়েক গুণ বেশি দামে কিনতে হচ্ছে রোগীদের। এটা অন্যায়, অনুচিত, অমানবিক। মানুষের সংকট নিয়ে ব্যবসা করা ঘৃণ্য কাজ।’

সর্বশেষ খবর