বৃহস্পতিবার, ১০ আগস্ট, ২০২৩ ০০:০০ টা

নামছে বন্যার পানি, ভেসে উঠছে ক্ষত

♦ পানির তোড়ে উল্টে গেছে নৌকা, তিন শিশুসহ নিখোঁজ ৪ ♦ চট্টগ্রাম কক্সবাজার মহাসড়কে দ্বিতীয় দিনের মতো যান চলাচল বন্ধ ♦ পাহাড়ে পানিবন্দি মানুষ

প্রতিদিন ডেস্ক

নামছে বন্যার পানি, ভেসে উঠছে ক্ষত

কয়েকদিনের টানা বর্ষণে তলিয়ে গেছে বান্দরবান মহাসড়ক। বন্ধ রয়েছে যান চলাচল -বাংলাদেশ প্রতিদিন

দেশের বিভিন্ন স্থানে বন্যার পানি নামতে শুরু করেছে। মঙ্গলবার সন্ধ্যার পর থেকে গতকাল বিকাল পর্যন্ত তেমন বৃষ্টি না হওয়ায় কোনো কোনো এলাকায় বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। পানি নেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভেসে উঠছে ক্ষতচিহ্ন। কোথাও সড়ক, মহাসড়ক, কাঁচা রাস্তা, আবার কোথাও কালভার্ট ভেঙে নিশ্চিহ্ন হয়েছে। বীজতলা, ফসলের মাঠ, মাছের ঘের, বেড়িবাঁধ, ঘর ও ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান লন্ডভন্ড হয়েছে। এদিকে গত চার দিনে পানিতে ডুবে চট্টগ্রাম ও বান্দরবানে সাতজনের মৃত্যু হয়েছে। নিখোঁজ আছেন আরও তিনজন। চট্টগ্রাম শহর এখনো তলিয়ে আছে বৃষ্টি ও জোয়ারের পানিতে। কক্সবাজার ও বান্দরবানের সঙ্গে দ্বিতীয় দিনের মতো যান চলাচল বন্ধ রয়েছে। খাগড়াছড়ির সঙ্গে পর্যটন কেন্দ্র সাজেকের যোগাযোগ বন্ধ থাকায় বিপাকে পড়েছেন পর্যটকরা। অনেকেই সাজেকে আটকা পড়েছেন বলে স্থানীয় সূত্র জানায়। এদিকে বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তা ও ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনায় সেনাবাহিনী প্রধানের নির্দেশনায় সেনা সদস্যরা চট্টগ্রাম ও বান্দরবানের দুর্গম এলাকায় মঙ্গলবার থেকে কাজ করছেন। আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক ও জেলা প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর :

চট্টগ্রাম : টানা বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ট ভয়াবহ বন্যায় ষষ্ঠ দিনের মতো চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলা, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটি জেলার বিভিন্ন এলাকায় দুর্ভোগ পোহাচ্ছে মানুষ। চার দিনে পানিতে ডুবে চট্টগ্রাম ও বান্দরবানে সাতজনের মৃত্যু হয়েছে। নিখোঁজ আছেন আরও তিনজন। চট্টগ্রাম শহর তলিয়ে যাচ্ছে বৃষ্টির পানি ও জোয়ারে। গতকাল সকালে পানিতে ভেসে যাওয়ার ৪০ ঘণ্টা পর লোহাগাড়ার উত্তর আমিরাবাদ এলাকায় আসহাব মিয়া নামে এক কৃষকের লাশ উদ্ধার করেন স্থানীয়রা। এর আগে মঙ্গলবার রাতে নিরাপদ স্থানে যাওয়ার সময় তিন শিশু ও এক যুবক নৌকা থেকে পড়ে পানিতে তলিয়ে যায়। এদের মধ্যে গতকাল বিকালে এক শিশুর লাশ উদ্ধার করেছেন স্থানীয়রা। চট্টগ্রামের রাউজান, হাটহাজারী, বোয়ালখালী, চন্দনাইশ, সাতকানিয়া, লোহাগাড়া বান্দরবানের বিভিন্ন উপজেলা, খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটির বেশকিছু এলাকা পানির নিচে ডুবে আছে। এসব এলাকার বিদ্যুৎ ও টেলিফোন সংযোগ বিচ্ছিন্ন, সব যোগাযোগ বন্ধ। বিশুদ্ধ পানি ও খাবারের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। ঘরবাড়ি ছাড়াও বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কার্যালয়, ব্যবসা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মসজিদ-মন্দিরও ডুবে আছে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় চট্টগ্রাম ও বান্দরবানে সেনাবাহিনী কাজ করছে।

বন্যাকবলিত এলাকায় অন্তত ২০ লাখ মানুষ পানিবন্দি। অনেকে নিজের বাসস্থান ছেড়ে উঁচু এলাকার আত্মীয়স্বজনের বাসা ও আশ্রয় কেন্দ্রে অবস্থান নিয়েছেন। বিভিন্ন স্থানে শতাধিক ছোট-বড় পাহাড় ধসের খবর পাওয়া গেছে। বন্ধ রয়েছে সড়ক যোগাযোগ। সাঙ্গু, মাতামুহুরী, হালদা, মাইনী ও কর্ণফুলী নদীর পানি ফুলে আছে। কিছু এলাকায় বন্যার পানি কমে আসার সঙ্গে সঙ্গে ক্ষয়ক্ষতির চিত্র সামনে আসছে। পানি পুরোপুরি নামার পরই ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করা যাবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

পাহাড়ি ঢল, পাহাড় ধস এবং সড়কের ওপর পানি জমে থাকায় গতকালও বান্দরবানের সঙ্গে ঢাকা-চট্টগ্রাম, রাঙ্গামাটি, কক্সবাজার, রোয়াংছড়িসহ পাহাড়ি উপজেলাগুলোর সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ছিল। বান্দরবানের সাতটি উপজেলায় এখনো লাখো মানুষ পানিবন্দি।

বান্দরবানের জেলা প্রশাসক শাহ মোজাহিদ উদ্দিন জানিয়েছেন, পাহাড় ধস ও ঢলে বান্দরবানে চারজনের মৃত্যু হয়েছে। গতকাল সকাল থেকে বৃষ্টি কমার পর পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। এর মধ্যে ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণের চেষ্টা চলছে। এদিকে বৃষ্টির পরিমাণ কিছুটা কমে এলেও চট্টগ্রাম শহরের বিভিন্ন এলাকা এখনো জোয়ারের পানিতে তলিয়ে আছে। এ ছাড়া হাটহাজারীর সেকান্দরপাড়া, মাইজপাড়া, মনোহরপাড়া, রুদ্রপুর, কাজিরখীল, খন্দকিয়াসহ ৪০টি গ্রামের ২ লক্ষাধিক মানুষ এখনো পানিবন্দি। রাউজানের উরকিরচর, নোয়াপাড়া, পূর্বগুজরাসহ বিভিন্ন এলাকা এখনো পানির নিচে ডুবে আছে। হালদা ও কর্ণফুলী নদীর পার্শ্ববর্তী এলাকার গ্রামগুলো এখনো পানির নিচে। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের কেরানিহাট, লোহাগাড়ার বারআউলিয়া ডিগ্রি কলেজ এলাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় এখনো সড়কের ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হওয়ায় যান চলাচল স্বাভাবিক হয়নি। পানিতে ডুবে আছে দক্ষিণ চট্টগ্রামের চন্দনাইশ ও লোহাগাড়ার শত শত গ্রাম। বৃষ্টি ও বন্যায় গত কয়েকদিনে চট্টগ্রামে তিনজনের প্রাণহানি ও কয়েকজনের নিখোঁজ থাকার খবর পাওয়া গেছে। এর মধ্যে গত সোমবার হাটহাজারীতে নিপা পালিত নামের এক শিক্ষার্থী পানিতে ডুবে মারা যান। একই দিন লোহাগাড়ায় চারজন ও রাউজানে একজন পানিতে তলিয়ে যান। মঙ্গলবার রাতে চন্দনাইশে একজন পানির নিচে তলিয়ে যান। এদের মধ্যে মঙ্গলবার লোহাগাড়ায় জুনায়েদুল ইসলাম নামের এক শিক্ষার্থী ও গতকাল সকালে রাউজানে শাহেদ হোসেন বাবু নামের এক উদ্যোক্তার লাশ উদ্ধার করেছেন স্থানীয়রা। বাকিরা এখনো পর্যন্ত নিখোঁজ।

বান্দরবান : কয়েকদিনের টানা বৃষ্টিতে বান্দরবানের জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। ডুবে গেছে রাস্তাঘাট, বাড়িঘর, অফিস। সেই সঙ্গে বিভিন্ন স্থানে পাহাড় ধস ও রাস্তায় পানি জমে থাকায় বান্দরবানের সঙ্গে সারা দেশের সড়ক যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে, চলছে না বাস। এদিকে সাংগু ও মাতামুহুরী নদীর পানি বাড়ায় ডুবে গেছে বান্দরবান পৌরসভার বেশির ভাগ এলাকা। গতকাল সকাল থেকে বৃষ্টি কমায় পানি নামতে শুরু করেছে নিম্নাঞ্চল থেকে, তবে এখনো পানিবন্দি রয়েছে বান্দরবান পৌর এলাকার আর্মিপাড়া, মেম্বারপাড়া, ইসলামপুর, বালাঘাটাসহ জেলার বিভিন্ন নিম্নাঞ্চলের জনগণ।

খাগড়াছড়ি : কয়েকদিনের প্রবল বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে খাগড়াছড়ির দীঘিনালা উপজেলায় একটি কালভার্ট ডুবে গেছে। ফলে বন্ধ হয়ে গেছে জেলা সদরের সঙ্গে রাঙামাটির পর্যটননগরী সাজেকের যোগাযোগ। যে কারণে সাজেকে আসা অনেক পর্যটক আটকা পড়েছেন। দীঘিনালা উপজেলা কালভার্টটি ডুবে যাওয়ায় সাজেক থেকে কোনো গাড়ি ছাড়েনি। আবার বাঘাইহাট থেকেও কোনো গাড়ি সাজেকে প্রবেশ করেনি। বর্তমানে সাজেকে ২০০-২৫০ জন পর্যটক অবস্থান করছেন।

কক্সবাজার : কক্সবাজারে বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। মঙ্গলবার সন্ধ্যার পর থেকে গতকাল বিকাল পর্যন্ত বৃষ্টি হয়নি। এ পরিস্থিতিতে নামতে শুরু করেছে বন্যাকবলিত এলাকার পানি। এখন পর্যন্ত বন্ধ আছে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের সরাসরি যান চলাচল। তবে আনোয়ারা-বাঁশখালী-পেকুয়া আঞ্চলিক মহাসড়ক দিয়ে চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার যান চলাচল করছে। পানি নেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভেসে উঠছে ক্ষতচিহ্ন। কোথাও মহাসড়ক, সড়ক, কাঁচা রাস্তা, আবার কোথাও কালভার্ট, ভেঙে ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেছে। বীজতলা, ফসলের মাঠ, মাছের ঘের, বেড়িবাঁধ, ঘর ও ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান যেন লন্ডভন্ড হওয়ার দৃশ্য দেখা যাচ্ছে। গতকাল সকালে চকরিয়া উপজেলার পানিতে ডুবে থাকা কিছু সড়কের দৃশ্য দেখা মিলে ভাঙনের তীব্রতা। কাকড়া-মিনাবাজার সড়কটির ৩ কিলোমিটার এলাকায় কমপক্ষে ৫০টি ভাঙন সড়কটিকে চলাচল অনুপযোগী হয়েছে।

চকরিয়া (কক্সবাজার) : কক্সবাজারের চকরিয়ায় কমতে শুরু করেছে বন্যার পানি। টানা বৃষ্টি ও ঢলের পানিতে মাতামুহুরী নদীর তীরবর্তী এলাকা ডুবে যায়। গত দুই দিন ধরে পৌরসভা ও ১৮ ইউনিয়নের অধিকাংশ এলাকা বন্যার পানিতে নিমজ্জিত ছিল। গতকাল সকাল থেকে পানি কমতে শুরু করেছে। এখনো অধিকাংশ এলাকা পানির নিচে তলিয়ে আছে। তবে বিশুদ্ধ পানির অভাবে সংকটে রয়েছে বন্যাদুর্গতরা। এদিকে চকরিয়ায় মাতামুহুরী নদীতে বন্যার পানিতে ডুবে আনোয়ার হোসেন (৭০) নামে এক বৃদ্ধের মৃত্যু হয়েছে। গতকাল সকাল ৯টার দিকে উপজেলার মানিকপুর ইউনিয়নের নয়াপাড়া ৯ নম্বর ওয়ার্ড এলাকার মাতামুহুরী পয়েন্ট থেকে ওই বৃদ্ধের লাশ উদ্ধার হয়। তিনি মানিকপুর ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ড এলাকার বাসিন্দা।

ফেনী : ফেনীর ফুলগাজী ও পরশুরামের বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। ঢলের পানিতে গতকালও নতুন নতুন গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। মুহুরী ও কহুয়া নদীর ভাঙা বাঁধ দিয়ে এখনো লোকালয়ে পানি ঢুকছে। তৃতীয় দিনের মতো ফুলগাজী টু পরশুরাম সড়কে এখনো রয়েছে পানি। দুই উপজেলার অন্তত ১০টি গ্রামের মানুষ এখনো রয়েছে পানিবন্দি। অমানবিক জীবন যাপন করছেন তারা।

বাগেরহাট : লাগাতার বৃষ্টি ও জোয়ারের পানিতে বাগেরহাটে ভেসে গেছে ৩ হাজার ৮২৫ একর জমির ৪ হাজার ২৩০টি ঘেরের মাছ। সরকারি হিসেবে, মাছ চাষিদের ১ কোটি ৭৮ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। গতকাল সকাল থেকে বৃষ্টি কম হলেও বিকাল থেকে আবারও ভারী বৃষ্টিপাত শুরু হয়েছে। জেলায় এখনো ৫ হাজার ৩৬৩টি পরিবার পানিবন্দি রয়েছে।

বরিশাল : বরিশাল বিএম কলেজ ক্যাম্পাসে জলাবদ্ধতা নিরসনে মানববন্ধন হয়েছে। গতকাল সকালে কলেজের জীবনানন্দ দাশ মুক্তমঞ্চের সামনে হাঁটুপানিতে দাঁড়িয়ে এ মানববন্ধন করেন শিক্ষার্থীরা। সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট বিএম কলেজ শাখা এ মানববন্ধনের আয়োজন করে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর