বৃহস্পতিবার, ১০ আগস্ট, ২০২৩ ০০:০০ টা

মুহূর্ত কাটত মৃত্যুশঙ্কায়

ইয়েমেনে আল-কায়েদার ডেরায় দেড় বছর, ফিরেছেন অপহৃত বাংলাদেশি জাতিসংঘ কর্মকর্তা

বিশেষ প্রতিনিধি

মুহূর্ত কাটত মৃত্যুশঙ্কায়

কখনো পাহাড়ের ভিতর ছিলাম। আকাশ-বাতাস দেখতে পাইনি মাসের পর মাস। আবার কখনো ছিলাম উত্তপ্ত মরুভূমিতে। আমি যেভাবে ছিলাম, তা শুধু দেখা যায় অ্যাকশন মুভিতে। প্রতিটি মুহূর্ত কাটত মৃত্যু আতঙ্কে। এই বুঝি আমাকে হত্যার ডাক পড়ল। কখনো ভাবিনি, জীবন নিয়ে দেশে ফিরতে পারব।

ইয়েমেনে অপহরণের শিকার হয়ে প্রায় দেড় বছর আল-কায়েদার ডেরায় থাকার পর উদ্ধার হয়ে দেশে ফিরে এসব কথা বলেন জাতিসংঘের কর্মকর্তা লে. কর্নেল (অব.) সুফিউল আনাম। গতকাল একটি বিমানে ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণের পর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সাবেক এই কর্মকর্তা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দাকে (এনএসআই) ধন্যবাদ জানান। তিনি বলেন, অস্ত্রের মুখে পাহাড়ে একটি আশ্রয় কেন্দ্রে নিয়ে যায় জঙ্গিরা। এই দেড় বছরে ১৮ বার বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে রাখা হয় আমাদের। কখনো পাহাড়, কখনো মরুভূমি দেখেছি। চোখ বেঁধে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নেওয়ায় কোন জায়গাগুলোয় ছিলাম সেগুলোর নাম জানি না। তবে অবর্ণনীয় উৎকণ্ঠায় প্রতিটি দিন কেটেছে। ওরা আমাদের বলেছিল, কিছু দাবি আদায় করতে অপহরণ করা হয়েছে। দাবি আদায় হয়ে গেলে ছেড়ে দেওয়া হবে। আমাদের মনে ভয় ছিল, দাবি আদায় হবে না। যদি দাবি আদায় না করে জাতিসংঘ আমাদের উদ্ধারের চেষ্টা করে, তাহলে ওরা আমাদের নির্ঘাত হত্যা করে ফেলে রেখে পালিয়ে যাবে। এ আতঙ্কেই আমাদের দিন কাটত। এক প্রশ্নের জবাবে সুফিউল আনাম বলেন, যতক্ষণ ওদের কাছে টাকা ছিল আমাদের খাবারের কষ্ট দেয়নি। একটা সময় ওদের টাকা ফুরিয়ে গিয়েছিল। তখন খাবারের কিছুটা কষ্ট হয়েছে। তবে ওদের কী ডিমান্ড (চাহিদা) ছিল, সে সম্পর্কে আমরা জানতাম না। শুধু ভিডিও করার সময় বলেছে, অল্প কিছু দাবি আদায় করতে চায়। অন্য এক প্রশ্নের জবাবে সাবেক এই সেনা কর্মকর্তা বলেন, আমাকে উদ্ধারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনায় বাংলাদেশের পক্ষ থেকে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, এও জানতাম না। কারণ কোনোরকম যোগাযোগের সুযোগ আমি পাইনি। পরিবারের সঙ্গেই দেড় বছর পর কথা হয়েছে। জাতিসংঘ কোনো উদ্যোগ নিয়েছে কি না তাও জানি না। তবে জাতিসংঘ এরকম অপহরণের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট দেশের সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে ব্যবস্থা নিয়ে থাকে। তিনি বলেন, আমি খুব ভাগ্যবান, প্রাণ নিয়ে ফিরতে পেরেছি। এজন্য প্রধানমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ট সবার কাছে কৃতজ্ঞ। অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা হিসেবে আমি দেশের প্রয়োজনে অবশ্যই যে কোনো চ্যালেঞ্জ নিতে প্রস্তুত বলেও যুক্ত করেন তিনি। তবে নিজের নিরাপত্তার স্বার্থে এড়িয়ে গেছেন কয়েকটি প্রশ্ন। জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দার (এনএসআই) পরিচালক ইমরুল মাহমুদ বলেন, এটা চ্যালেঞ্জিং ও দীর্ঘ প্রক্রিয়া ছিল। প্রধানমন্ত্রী আমাদের ওপর আস্থা রেখেছিলেন। দেড় বছরের চেষ্টায় এ সফলতা। অপহরণকারীরা ৩০ লাখ মার্কিন ডলার চেয়েছিল, কিন্তু কোনো টাকাপয়সা দিতে হয়নি তাকে মুক্ত করতে। এ প্রক্রিয়ায় সহযোগিতাকারী বিভিন্ন দেশ ও সংস্থাকেও ধন্যবাদ জানান তিনি। গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে ইয়েমেনের দক্ষিণাঞ্চল থেকে অপহরণের শিকার হন বাংলাদেশের সাবেক সেনা কর্মকর্তা এ কে এম সুফিউল আনাম। এর পর থেকে কোনো খোঁজ মিলছিল না জাতিসংঘে কর্মরত এই কর্মকর্তার। ধারণা করা হয়েছিল, অপহরণের পর তাঁকে হত্যা করে জঙ্গি গোষ্ঠী। প্রায় সাত মাস পর ৭ সেপ্টেম্বর ওই কর্মকর্তার একটি ভিডিও প্রকাশ করে জঙ্গি গোষ্ঠীদের অনলাইন তৎপরতা পর্যবেক্ষণকারী সাইট ইন্টেলিজেন্স গ্রুপ। জানা যায়, আল-কায়েদার ইয়েমেন শাখা অপহরণ করেছে অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট কর্নেল সুফিউলকে। আল-কায়েদার দাবিদাওয়া মেনে নিজেকে মুক্ত করতে সুফিউল আকুতি জানান জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক মহলের কাছে। উল্লেখ করেন নিজের দুর্দশা ও শারীরিক দুরবস্থার কথা। সুফিউল আনামকে মুক্ত করতে প্রধানমন্ত্রী ও জাতিসংঘ মহাসচিব বরাবর চিঠিও পাঠায় তাঁর পরিবার। এ বিষয়ে তখন পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন জানিয়েছিলেন, শুরু থেকেই ঘটনাটি গুরুত্বের সঙ্গে দেখে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এ বিষয়ে জাতিসংঘ মহাসচিবের সঙ্গে কথাও হয় পররাষ্ট্রমন্ত্রীর। তবে মুক্তিপণ দিয়ে কোনো কর্মকর্তাকে ছাড়িয়ে আনার বিষয়ে নীতিগত বাধা আছে জাতিসংঘের।

তাঁকে উদ্ধারে ঢাকায় নিযুক্ত ইয়েমেনসহ পাশের দেশের রাষ্ট্রদূতদের নিয়মিত চাপ দিয়ে আসছিল বাংলাদেশ। ১৯৭৭ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে কর্মরত ছিলেন এ কে এম সুফিউল আনাম। অবসরের পর ইয়েমেনে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর