বৃহস্পতিবার, ১০ আগস্ট, ২০২৩ ০০:০০ টা
পেশকারের ঘুষ নেওয়ার ভিডিও ভাইরাল

এখন ফটোকপি বন্ধ মাল দেন মাল

আরাফাত মুন্না

ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনালের বেঞ্চ সহকারী (পেশকার) শামীম আল মামুনের ঘুষ নেওয়ার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। সেই ভিডিওতে দেখা গেছে পেশকার শামীম একজন ব্যক্তির কাছ থেকে ২ হাজার টাকা ঘুষ নিচ্ছেন। একই ভিডিওর অন্য অংশে একজন ব্যক্তি তার কাছে একটি মামলার নথির ফটোকপি চাইলে তিনি বলেন, ‘এখন ফটোকপি বন্ধ, মাল দেন মাল, খরচাপাতি দেন, ১ হাজার টাকা বাইর করেন।’ ভিডিওতে থাকা ব্যক্তিটিই যে পেশকার শামীম আল মামুন, বাংলাদেশ প্রতিদিনকে তা নিশ্চিত করেছেন ঢাকার আদালতের অন্তত পাঁচজন আইনজীবী। দুর্নীতি প্রতিরোধে কাজ করা ব্যক্তিরা বলছেন, আদালতের দুর্নীতি-অনিয়মের ঘটনা প্রায় প্রকাশ্য। এই ঘটনাটিতে যেহেতু সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণ রয়েছে, তাই এই পেশকারকে কঠোর শাস্তির আওতায় এনে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে। বিষয়টি প্রধান বিচারপতি নজরে নিয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন বলেই মনে করেন তারা। এই ভিডিওর বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের রেজিস্ট্রার মোহাম্মদ সাইফুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘বিষয়টি আমি রেজিস্ট্রার জেনারেল মহোদয়কে অবহিত করেছি। তিনিই এ বিষয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ নেবেন।’ অনুসন্ধানে জানা গেছে, মামলার প্রস্তুতি ও বিভিন্ন আবেদন তৈরির জন্য অনেক সময়ই নথিপত্রের ফটোকপি প্রয়োজন হয়। সাধারণত আরজি, এজাহার, চার্জশিটসহ সব ধরনের প্রাথমিক নথির ফটোকপি নিয়ে থাকেন আইনজীবীরা। তবে ১ মার্চ এক সার্কুলারের মাধ্যমে অধস্তন আদালত বা ট্রাইব্যুনাল থেকে মামলার বিভিন্ন নথিপত্রের সার্টিফায়েড কপি (জাবেদা নকল) ছাড়া কোনো ধরনের ফটোকপি সরবরাহ না করতে নির্দেশনা দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন। আইনজীবীদের অভিযোগ, এই আদেশের পর এক দিনের জন্যও ফটোকপি দেওয়া-নেওয়া বন্ধ হয়নি, বরং আগে ১০০-২০০ টাকায় ফটোকপি পাওয়া যেত, এখন টাকা বেশি লাগে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকার আদালতের একাধিক আইনজীবী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, এখানে তো শুধু একটি আদালতের পেশকারের ভিডিও এসেছে। প্রায় সব আদালতের চিত্র একই রকম। টাকা না দিয়ে কোনো কাগজপত্রের অনুলিপি পাওয়া যায় না। বিভিন্ন ডকুমেন্টের ফটোকপির জন্য ক্ষেত্রবিশেষ ৫০০ টাকা থেকে ৩ হাজার টাকা নিয়ে থাকেন পেশকাররা। এ ছাড়া জামিনের বেল বন্ড দাখিলের জন্যও ৫০০ টাকা থেকে ১০ হাজার টাকার বেশি ব্যয় হয় বলে জানান আইনজীবীরা।

যা আছে ভিডিওতে : ২ মিনিট ২৭ সেকেন্ডের ভিডিওর ১২তম সেকেন্ডে নীল-সাদা প্রিন্টের শার্ট পরা পেশকার শামীম আল মামুনকে আদালতের বারান্দায় একজন ব্যক্তির সঙ্গে হাঁটতে দেখা গেছে। ওই ব্যক্তিকে তিনি বলছেন, ‘ওয়ারেন্ট করায় ফেলছি।’ কিছুক্ষণ হাঁটার পর ওই ব্যক্তিকে শামীম আল মামুন বলছেন, ‘দেন মালপানি দেন।’ পাশে থাকা ওই ব্যক্তি বলছেন, ‘আমি ৩ হাজার টাকা জোগার করছি। আগে দিছি ১ হাজার, আর এহন নেন ২ হাজার, আপনি আমার ভাই। ডকুমেন্ট কিছু দিবেন?’ এ সময় শামীম বলেন, ‘না এহন না।’ এ কথা বলে তিনি নিজ কক্ষের দিকে চলে যান। ভিডিওর ১ মিনিট ৫৫তম সেকেন্ডে আরও দেখা গেছে, কক্ষে ঢোকার পর ক্যামেরার পেছন দিকে থাকা এক ব্যক্তি কোনো একটি মামলার ফটোকপির বিষয়ে জানতে চাইছেন। এ সময় শামীম বলেন, ‘দিছেন খরচ দিছেন অরে? দেন খরচাপাতি দেন। এহন তো ফটোকপি দেওয়া নিষেধ কইরা দিছে, একেবারে বন্ধ কইরা দিছে। টাকা ১ হাজার বাইর করেন। খুব খারাপ অবস্থা।’ এরপর অন্য একটি মামলার বিষয়ে অন্য একজনের সঙ্গে কথা শুরু করেন শামীম। ভিডিওর বিষয়ে জানতে পেশকার শামীম আল মামুনকে তার মোবাইল ফোনে অন্তত চারবার ফোন করেও কোনো জবাব পাওয়া যায়নি। তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিন থেকে পাঠানো এসএমএসেরও জবাব দেননি।

কঠোর শাস্তির আওতায় এনে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে : পেশকার শামীম আল মামুনের ঘুষ নেওয়ার ভিডিওর বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বিচার বিভাগে যে দুর্নীতি-অনিয়ম হয় এটা প্রধান বিচারপতিসহ বিভিন্নজনের বক্তব্যে বিভিন্ন সময় উঠে এসেছে। এটা যে সেটারই প্রতিফলন। বর্তমান প্রধান বিচারপতি দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানের কথা জানিয়েছেন। বিচারাঙ্গনে দুর্নীতি সহ্য করা হবে না এমন ঘোষণাও দিয়েছেন তিনি। তিনি বলেন, ‘আমরা আশা করব এ ঘটনাটিতে (ভিডিও) যেহেতু সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণ রয়েছে, এর সঙ্গে যিনি বা যারা জড়িত তাদের বিচারের আওতায় আনা হবে। তবে এই বিচার শুধু বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ নয়। ঘটনাটি যেহেতু আইনগতভাবে অপরাধ, তাই এ অপরাধের যে শাস্তি তা নিশ্চিত করতে হবে। তাহলেই এ ধরনের ঘটনা রোধ করা সম্ভব হবে। দেশবাসীও এটাই প্রত্যাশা করেন।’ এ বিষয়ে জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘ঢাকার আদালতের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দুর্নীতি বিষয়ে আমরা অনেক আগে থেকেই কথা বলে আসছি। তবে কোনো সুরাহা হয়নি। এ বিষয়ে আমরা হাই কোর্টে একটি রিটও করেছিলাম। তখন আদালত দুর্নীতি বন্ধে কেন ব্যবস্থা নেওয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে উচ্চ আদালত রুল জারি করেন। সেই রুলের শুনানি এখনো হয়নি।’ তিনি বলেন, ঘুষ নেওয়া একটি অপরাধ। এই পেশকার সুপ্রিম কোর্টের অধীনস্থ কর্মচারী। তাই সুপ্রিম কোর্টের উচিত হবে দ্রুত তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর