শনিবার, ১২ আগস্ট, ২০২৩ ০০:০০ টা

আতঙ্কের নাম ইয়াবা

♦ দেড় বছরে উদ্ধার ৬ কোটি ২৪ লাখ পিস ♦ ধরা পড়ছে মোট ইয়াবার মাত্র ১০ শতাংশ

আলী আজম

আতঙ্কের নাম ইয়াবা

সারা দেশে আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে ভয়ংকর মাদক ইয়াবা। মিয়ানমার থেকে দেশের সীমান্ত অঞ্চল দিয়ে দেদার প্রবেশ করছে ইয়াবা। প্রায় প্রতিদিনই বড় বড় চালান ধরা পড়ছে ইয়াবার। গত দেড় বছরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ৬ কোটি ২৩ লাখ ৯৪ হাজার ৮৩৩ পিস ইয়াবা ট্যাবলেট ধরা পড়েছে। এদিকে জাতিসংঘের মাদক নিয়ন্ত্রণ সংস্থার (ইউএনওডিসি) তথ্য বলছে, বাংলাদেশে যত মাদক ঢুকছে, এর মাত্র ১০ শতাংশ ধরা পড়ে।

চিকিৎসকরা বলছেন, নিয়মিত ইয়াবা সেবন করলে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ, নিদ্রাহীনতা, খিঁচুনি, ক্ষুধামন্দা এবং মস্তিষ্ক বিকৃতি দেখা যেতে পারে। ইয়াবা গ্রহণের ফলে ফুসফুস, বৃক্ক সমস্যা ছাড়াও অনিয়মিত এবং দ্রুতগতির হৃৎস্পন্দনের মতো সমস্যা দেখা দিতে পারে। অতিরিক্ত হারে ইয়াবা গ্রহণ হাইপারথাইরয়েডিজম বা উচ্চ শারীরিক তাপমাত্রার কারণ হতে পারে। এর মরণ ছোবলে জীবন নিঃশেষ হয়ে যায়।

গবেষকরা বলছেন, বর্তমান মাদকাসক্তদের ৫৮ শতাংশ ইয়াবাসেবী। যার অধিকাংশই অল্পবয়সী ছেলেমেয়ে। বিভিন্ন মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে যারা চিকিৎসার জন্য শরণাপন্ন হচ্ছেন তাদের অধিকাংশই ইয়াবাসেবী। হেরোইন এবং ফেনসিডিলের চল এখনো আছে। কিন্তু তা সীমিত পর্যায়ে। হেরোইন এবং ফেনসিডিলের জনপ্রিয়তাকে ছাড়িয়ে গেছে ইয়াবা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে বর্তমানে মাদকাসক্তদের সম্পর্কে সরকারিভাবে সুনির্দিষ্ট কোনো পরিসংখ্যান না থাকলেও বেসরকারিভাবে দেশে ১ কোটিরও বেশি মাদকাসক্ত রয়েছে। এদের ৮০ শতাংশই তরুণ। তাদের মধ্যে ৪৮ শতাংশ শিক্ষিত। বাকিদের মধ্যে নিরক্ষর এবং শুধুই অক্ষরজ্ঞানসম্পন্নরাও আছে। দারিদ্র্যসীমার নিচে যাদের অবস্থান তাদের সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। মাদকাসক্তদের ৬০ শতাংশ বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে জড়িত। এদের ৩০ শতাংশই শুধু নেশার খরচ জোগান দিতে নানা ধরনের অপকর্মে জড়িয়ে পড়ে। মাদকাসক্তির ভয়াবহ বিস্তার ঘটেছে ছাত্র ও শিক্ষিত বেকারদের মধ্যে। দেশে নারীদের মধ্যেও মাদকাসক্তের সংখ্যা বাড়ছে। এটি উদ্বেগের কারণ। সারা দেশে বছরে মাদকের পেছনে খরচ হয় আনুমানিক ৬০ হাজার কোটি টাকা। এ ব্যবসায় পৃষ্ঠপোষক, ব্যবসায়ী, বাহক ও বিক্রির নেটওয়ার্কে কাজ করে প্রায় ২ লাখ ব্যক্তি। প্রতি বছরই বাড়ছে এই সংখ্যা। বাংলাদেশ থেকে মাদকের কারণে প্রতি বছর পাচার হয়ে যায় ৪৮১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বা প্রায় ৫ হাজার ১৪৭ কোটি টাকা। নেশাজাতীয় দ্রব্যের বিস্তারের এই সর্বনাশা চিত্র যেভাবে আর্থিক ও শারীরিক ক্ষতি করছে, সেভাবে একটি প্রজন্মের চিন্তার জগতে বন্ধ্যত্ব সৃষ্টি করছে। দীর্ঘ মেয়াদে এর ফল ভয়াবহ হবে। উঠতি বয়সী যুবকরা বিশেষ করে স্কুল কলেজগামী ছেলেরা এ মরণ নেশায় জড়িয়ে পড়ছে। কৌতূহল, পারিবারিক অশান্তি, বেকারত্ব, প্রেমে ব্যর্থতা, বন্ধুদের প্ররোচনা, অসৎ সঙ্গ, নানা রকম হতাশা ও আকাশ সংস্কৃতির নেতিবাচক প্রভাবে যুবসমাজ মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছে। যারা নেশা করে তারা জানে নেশা কোনো উপকারী বা ভালো কাজ নয়। এটি মানুষের জীবনীশক্তি নষ্ট করে দেয়। ফলে আগামী প্রজন্মকে বাঁচাতে সমন্বিতভাবে কাজ করে মাদকের বিস্তার রোধ করতে হবে। সচেতনতামূলক কার্যক্রম বৃদ্ধি করে এর কুফল সম্পর্কে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে হবে।

প্রধানত, মিয়ানমার সীমান্ত দিয়ে দেশে ইয়াবাসহ সব ধরনের মাদক আসছে। দেশের ভিতর দিয়ে যত মাদক চোরাচালান হয়, এর সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ উদ্ধার হয়। অর্থাৎ দেশে আসা ৮০ শতাংশ মাদক উদ্ধার করা সম্ভব হয় না। মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার ও মাদকাসক্তি দেশের উন্নয়নে অন্যতম বাধা। তাই এ বাধা দূর করতে মাদক নির্মূল না হওয়া পর্যন্ত অভিযান অব্যাহত রাখতে হবে। সেই সঙ্গে মাদকসহ গ্রেফতাররা এবং মাদক ব্যবসায়ীরা যাতে জামিনে ছাড়া না পায়, সেজন্য কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। গত বুধবার কক্সবাজারের টেকনাফ থানার মেরিন ড্রাইভ সংলগ্ন মিঠা পানির ছড়া ঘাট থেকে ৭ লাখ পিস ইয়াবা ট্যাবলেট জব্দ করেছে কোস্ট গার্ড। ১০ আগস্ট কক্সবাজারের টেকনাফে অভিযান চালিয়ে ২ লাখ ৩৪ হাজার পিস ইয়াবা ট্যাবলেট উদ্ধার করে বিজিবি। গত ১৪ জুন কক্সবাজারের টেকনাফ থানার সাবরাং ইউনিয়নের আশিকানিয়া এলাকা থেকে ৩ লাখ ৮০ হাজার পিস ইয়াবা ট্যাবলেট জব্দ করে বিজিবি। গত ১৪ এপ্রিল কক্সবাজার ও বান্দরবানে পৃথক অভিযান চালিয়ে ৩ লাখ ৫০ হাজার পিস ইয়াবা ট্যাবলেট ও ২ লাখ ৮৩ হাজার টাকাসহ ৫ জনকে গ্রেফতার করে র‌্যাব-১৫ এর সদস্যরা। র‌্যাব সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের ১ জুলাই থেকে চলতি বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত ১ কোটি ৫ লাখ ৩৮ হাজার ৮৪২ পিস ইয়াবা ট্যাবলেট উদ্ধার করা হয়েছে। পাশাপাশি হেরোইন ১১৯ কেজি ১৪৪ গ্রাম, ফেনসিডিল ১৪ হাজার ৮২৩ বোতল, বিদেশি মদ ৩১ হাজার ৮৬৬ বোতল, গাঁজা ২৯ হাজার ৮১৮ কেজি ৭৩ গ্রাম এবং আইস ২৬ কেজি ২৬৪ গ্রাম উদ্ধার করা হয়েছে। এর সঙ্গে জড়িত ১১ হাজার ৮৭ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। জব্দকৃত মাদকের আনুমানিক মূল্য ৭২০ কোটি ২৬ লাখ টাকা।

গত বছরের জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের মে পর্যন্ত মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর, পুলিশ, বিজিবি, র‌্যাব ও কোস্টগার্ডের অভিযানে ৬ কোটি ২৩ লাখ ৯৪ হাজার ৮৩৩ পিস ইয়াবা ট্যাবলেট, কোকেন ৭ কেজি ১৫ গ্রাম, ফেনসিডিল ৯ লাখ ৪১ হাজার ২৯২ বোতল, ফেনসিডিল ২৯০ লিটার, হেরোইন ৫৯১ কেজি ৪৯৪ গ্রাম, বিদেশি মদ ৪ লাখ ২৮ হাজার ৯৪৬ বোতল, গাঁজা ১ লাখ ৬৭ হাজার ৭০৪ কেজি ২৬ গ্রাম এবং ইনজেক্টিং ড্রাগ ২ লাখ ৯৯ হাজার ৯০৯ অ্যাম্পুল উদ্ধার করা হয়েছে।

র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, মাদকের বিরুদ্ধে র‌্যাব সর্বদা জিরো টলারেন্স। নিয়মিত মাদকবিরোধী অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। মাদকের সঙ্গে জড়িত কাউকে ছাড় দেওয়া হচ্ছে না। সম্প্রতি মাদকের সঙ্গে সম্পৃক্ত বড় মাপের বেশ কয়েকজন ডিলারকে গ্রেফতার করা হয়েছে। যারা মিয়ানমার থেকে ইয়াবাসহ মাদকের বড় চালান নিয়ে আসত। সীমান্ত এলাকায় যারা মাদক ব্যবসায় জড়িত তাদের তালিকা করা হয়েছে। তালিকা অনুযায়ী তাদের গ্রেফতার করা হচ্ছে। রাজধানী ঢাকায়ও যারা মাদকের সঙ্গে সম্পৃক্ত, তাদের তালিকাও করা হয়েছে। সে অনুযায়ী গ্রেফতার অভিযান চলছে। মাদকের বিস্তার রোধে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধিসহ সবাইকে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। আমরা মাদকের কুফল উল্লেখ করে লিফলেট বিতরণসহ স্কুল-কলেজে গিয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের সচেতন করছি।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের পরিচালক (অপারেশনস ও গোয়েন্দা) ডিআইজি তানভীর মমতাজ বলেন, ইয়াবাসহ মাদক নিয়ন্ত্রণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করছি। যৌথ অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। ইয়াবা মূলত মিয়ানমার থেকে আসছে। দেশে অবস্থানরত মিয়ানমারের নাগরিকরা এই ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। তাদের আমরা নজরদারিতে রাখছি। তাদের অনেকে ইয়াবাসহ গ্রেফতার হয়েছে। মিয়ানমার টার্গেট করে যে কোনো উপায়ে বাংলাদেশে ইয়াবাসহ মাদক প্রবেশ করাচ্ছে। অল্প সময়ে ধনী হওয়ার প্রবণতা থেকে দেশের অসৎ লোকেরা ইয়াবা ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ছে। মাদক কারবারি যেই হোক তাদের কঠোর হস্তে দমন করা হচ্ছে। মাদক শুধু পরিবার নয়; সমাজকে ধ্বংস করে দেয়। তাই মাদকের খারাপ দিক তুলে ধরে প্রচার-প্রচারণাসহ এর খারাপ পরিণতি তুলে ধরে যুব সমাজকে সচেতন করা হচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল?্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের শিক্ষক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিয়মিতই মাদকের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে মাদক জব্দ ও এর সঙ্গে জড়িতদের গ্রেফতার করছে। তবে দেশে যে পরিমাণ মাদক আছে সেই পরিমাণ মাদক উদ্ধার করতে পারছে না। আর যে পরিমাণ মাদক উদ্ধার হয় সেটি সমাজে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারছে না। মাদকের বাহক বা মাদকাসক্ত ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হচ্ছে। কিন্তু এর পেছনে রাঘব-বোয়াল, পৃষ্ঠপোষক বা মূলহোতা হিসেবে যারা কাজ করছে তাদেরও আইনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মাদকাসক্ত ব্যক্তিরা কর্মক্ষমতা হারিয়ে তাদের জীবনে ঝুঁকি বা হুমকি তৈরি করছে। তাদের ব্যক্তিগত কর্মদক্ষতা বা নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা থেকে পিছিয়ে পড়ে ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে। মাদকাসক্ত ব্যক্তিরা পরিবার ও সমাজের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। মাদকের টাকা জোগাড় করতে সমাজে নানা ধরনের অপরাধমূলক কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়ছে। পরিবার ও সমাজের মধ্যে সে একটা হুমকি তৈরি করছে। মাদক যেন দেশের মধ্যে প্রবেশ করতে না পারে সে বিষয়ে জোর দিতে হবে। এটি বন্ধ করতে না পারলে মাদকের বিরুদ্ধে সরকারের যে জিরো টলারেন্স নীতি রয়েছে তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর