শিরোনাম
রবিবার, ১৩ আগস্ট, ২০২৩ ০০:০০ টা

বিএনপিতে শিগগিরই শুদ্ধি অভিযান

বড় নেতারা বেশি আতঙ্কে ♦ শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে কঠোর অবস্থানে হাইকমান্ড ♦ দায়িত্বে অবহেলা করলে সরাসরি অপসারণ

শফিউল আলম দোলন ও শফিকুল ইসলাম সোহাগ

বিএনপিতে শিগগিরই শুদ্ধি অভিযান

বিএনপিতে শুদ্ধি অভিযান শুরু হয়েছে। মূল দল থেকে শুরু করে অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন পর্যন্ত কেউ বাদ পড়ছেন না। কেন্দ্র থেকে মহানগর, জেলা-উপজেলা পর্যন্ত নানাভাবে চলবে এ অভিযান। দায়িত্বে অবহেলা করলেই সরাসরি অপসারণ। শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে কঠোর অবস্থান নিয়েছেন দলীয় হাইকমান্ড তারেক রহমান। এর ফলে বড় পদের নেতারা সবচেয়ে বেশি আতঙ্কে রয়েছেন। যে কোনো সময় ছিটকে পড়তে পারেন যে কোনো পর্যায়ের নেতা। বিশেষ করে ঢাকা মহানগর বিএনপিতে কিছুদিনের মধ্যেই বড় আকারের পরিবর্তন আসতে পারে। অপসারণ ছাড়াও তিরস্কারেরও শিকার হতে পারেন যে-কেউ। কারণ আরও বেশ কজন নেতার বিরুদ্ধে দায়িত্বে অবহেলার সুষ্পষ্ট প্রমাণ মিলেছে হাইকমান্ডের তদন্তে। ২৯ জুলাই ঢাকার প্রবেশমুখে অবস্থান কর্মসূচি ঘিরে দায়িত্বশীল নেতাদের ভূমিকা নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়েছে দলের ভিতরে। সে কর্মসূচিতে অনেক নেতাই দায়িত্বে অবহেলা করেছেন বলে জানা গেছে। ফলে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান এই কঠোর অবস্থান নিয়েছেন। দলের নির্ভরযোগ্য সূত্রগুলোর মাধ্যমে এসব তথ্য জানা গেছে। এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও দলের আন্তর্জাতিক বিষয়ক কমিটির চেয়ারম্যান আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, দলের শৃঙ্খলা রক্ষা করাটা একটা কমন বিষয়। পাশাপাশি সঠিক নেতৃত্ব নির্ধারণ করতে হবে। দায়িত্বে যে অবহেলা করবেন তাকে সঙ্গে সঙ্গেই বাদ দিয়ে দিতে হবে। সে ক্ষেত্রে এক মুহূর্তও বিলম্ব করা যাবে না। যারা কর্মঠ, দক্ষ এবং দলের প্রতি কমিটমেন্ট আছে, তাদেরই দায়িত্ব দিতে হবে। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান এসব বিষয়ে যে কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছেন এটাই তো হওয়া উচিত। জানা যায়, শুদ্ধি অভিযানের অংশ হিসেবে দায়িত্বে অবহেলা ও নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগে ইতোমধ্যে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি কাজী রওনকুল ইসলাম শ্রাবণকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। তার পদে সংগঠনের সিনিয়র সহসভাপতি রাশেদ ইকবাল খানকে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি করা হয়েছে। ভেঙে দেওয়া হয়েছে ঢাকা মহানগর উত্তর-দক্ষিণ যুবদলের কমিটিও। এই দুই শাখায় নতুন আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু সেই কমিটিতে রাখা হয়নি যুবদল সভাপতি সুলতান সালাউদ্দিন টুকুর অনুসারী উত্তর যুবদলের ‘প্রভাবশালী’ যুগ্ম আহ্বায়ক মিজানুর রহমান রাজকেও। বাদ পড়েছেন সদস্য সচিব জগলুল পাশা পাপেলও। মহানগর উত্তর যুবদলের নতুন আহ্বায়ক শরীফ উদ্দিন জুয়েল ও সদস্য সচিব হয়েছেন সাজ্জাদুল মিরাজ। একই সঙ্গে যুবদলের ঢাকা দক্ষিণের আহ্বায়ক গোলাম মওলা শাহীন জেলে থাকা অবস্থায় তাকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। তার স্থলে নতুন আহ্বায়ক হয়েছেন বিলুপ্ত কমিটির সদস্য সচিব খন্দকার এনামুল হক এনাম। ইকবাল হোসেনকে দেওয়া হয়েছে যুগ্ম আহ্বায়কের পদ। সদস্য সচিব করা হয়েছে রবিউল ইসলাম নয়নকে। একইভাবে স্বেচ্ছাসেবক দল, শ্রমিক দল, মহিলা দলসহ সব অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের প্রতিই নজর রাখছেন হাইকমান্ড। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের নির্দেশনায় মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলামের নেতৃত্বে দলের নীতিনির্ধারক মহল তথা স্থায়ী কমিটির সদস্যরাও যথেষ্ট তৎপর হয়েছেন। শুক্রবারের কর্মসূচিতে অনেক সিনিয়র নেতাকেও বৃষ্টিতে ভিজে গণমিছিলে অংশ নিতে দেখা গেছে। এ ছাড়া অনেককেই এখন ছোটখাটো অজুহাত এড়িয়ে দলীয় কর্মসূচিতে নিয়মিত উপস্থিত থাকার চেষ্টা করতে দেখা যাচ্ছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিএনপির একজন সিনিয়র নেতা জানান, আগামী এক মাসে বিএনপির অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের বেশ কিছু পদে পরিবর্তন আসবে। দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হতে পারে ঢাকা মহানগর বিএনপির কয়েকজন নেতাকেও, যাদের বিরুদ্ধে দলে অন্তঃকোন্দল ও কর্মসূচি বাস্তবায়নে দায়িত্বে অবহেলা ও নিষ্ক্রিয়তার প্রমাণ মিলেছে। তিনি জানান, যেহেতু এবার ঢাকাকেন্দ্রিক আন্দোলন গড়ে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে দলের, সে জন্য দ্রুততম সময়ের মধ্যেই কমিটি পুনর্গঠন করা হচ্ছে। যাদের সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আছে। তারা কেউ নির্ধারিত সময়ে কর্মসূচিতে যাননি, কেউবা ছবি তুলেই চলে যান। এমন আরও অভিযোগে কয়েকজনের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে।

একই বিষয়ে দলের স্থায়ী কমিটির অপর সদস্য নজরুল ইসলাম খান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সাংগঠনিক ক্ষেত্রে এটা হলো একটা চলমান বিষয়। একটা পরিবারের ভিতরে যেমন শৃঙ্খলা বজায় রাখতে হয়, তেমনি দলের ভিতরে তো আরও বেশি প্রয়োজন। আর কমিটি গঠন-পুনর্গঠনের বিষয়টা তো একটা ‘কন্টিনিওয়াস প্রসেস’। এটা নতুন কিছু নয়।

নীতিনির্ধারণী মহলের অপর একটি সূত্রে জানা গেছে, জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে ২০১৩ সালের ১৯ ডিসেম্বরের ‘মার্চ ফর ডেমোক্রেসি’ প্রোগ্রামের মতো বেশ কজন নেতার খোলস পরিবর্তনের সিদ্ধান্তেরও আভাস-ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। এমনকি অতীতের মতো ডিগবাজিও দিতে পারেন কয়েকজন। দলের নিজস্ব গোয়েন্দা সূত্রগুলোর মাধ্যমে নীতিনির্ধারকরা বিষয়টি জানতে পারেন। এসব কারণে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান হার্ডলাইনে অবস্থান নিয়েছেন। সংশ্লিষ্ট সূত্রটি জানিয়েছে, যত বড় নেতাই হোন না কেন, এবার দলের ন্যূনতম স্বার্থপরিপন্থী কোনো কাজে কেউ জড়িত হলে, বিশেষ করে সরকারের দেওয়া লোভ-লালসার টোপে পড়ে দল থেকে কেউ ডিগবাজি দেওয়ার চেষ্টা করলে সঙ্গে সঙ্গেই সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। পাশাপাশি শারীরিকভাবে তাকে হেনস্তা করতেও প্রস্তুত রয়েছেন সারা দেশের তৃণমূল নেতারা। জানা গেছে, দলীয় সিদ্ধান্ত উপেক্ষা বা অবহেলা করায় কাউকে দেওয়া হচ্ছে অব্যাহতি, শৃঙ্খলাভঙ্গের দায়ে কেউ হচ্ছেন বহিষ্কার। আবার কমিটি গঠনে স্বেচ্ছাচারিতার পরিণামেও হচ্ছেন অপসারণ। এভাবেই দলের ভিতরে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে চলছে শুদ্ধি অভিযান। আর কমিটি পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে এবার অধিক প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে অপেক্ষাকৃত তরুণ, সাহসী ও দলের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ নতুন মুখ। বিশেষ করে যারা রাজপথের গণআন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে পারবেন সে ধরনের নেতাদেরই সামনে আনা হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান বরকতউল্লা বুলু বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘বিএনপিতে জিয়াউর রহমানের পরিবারই শুধু অপরিহার্য। বেগম খালেদা জিয়া এবং তারেক রহমানের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। এর বাইরে আমরা যে যত বড় নেতাই হই না কেন, কেউই অপরিহার্য নই। দলের হাইকমান্ডের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে নিজেকে জাহির করাটা সাংগঠনিক অপরাধ। শৃঙ্খলা ভঙ্গ করলে দলের স্বার্থে বিভিন্ন মেয়াদে কিংবা স্থায়ীভাবে শাস্তি পাওয়াটা অপরিহার্য। এখানে কে কত বড় নেতা তা দেখার বিষয় নয়।’ এ ছাড়া ২৯ জুলাই রাজধানীর চারটি স্থানে পালিত কর্মসূচিতে দায়িত্বশীল নেতাদের ভূমিকা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে যাচাই করছেন দলের হাইকমান্ড তারেক রহমান। এদের মধ্যে অনেককে ওই দিন ফোন করেও পাওয়া যায়নি। অনেকে নির্দিষ্ট স্থানে না গিয়ে নিজের সুবিধামতো সময়ে সন্ধ্যায় ঝটিকা মিছিল করে দায়িত্ব সারেন। পুলিশের উপস্থিতির সঙ্গে সঙ্গে অনেকেই নেতা-কর্মী রেখে পালিয়ে গেছেন। ঢাকা মহানগরীর অনেক নেতার বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ নেতাদের লেজুড়বৃত্তি ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে তথ্য ফাঁসের অভিযোগ রয়েছে। এসব ঘটনার ‘নিরপেক্ষ’ তদন্ত করেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। সে তদন্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে দলের হাইকমান্ড সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিতে শুরু করেছেন। শ্রাবণের মতো ভাগ্য বরণ করতে পারেন অঙ্গসংগঠনের আরও দুই শীর্ষস্থানীয় নেতা। অভিযুক্ত বিএনপির মহানগরের নেতাদের করা হচ্ছে সতর্ক, যা নিয়ে আলোচনা হয়েছে দলের সর্বশেষ স্থায়ী কমিটির সভায়।

বিএনপির অপর একটি সূত্র জানায়, আগামী দিনের কর্মসূচিতে সাময়িকভাবে বাদ পড়া নেতাদের উপস্থিতি, গতিবিধি ও দলীয় কর্মকান্ডে তাদের ভূমিকা কেমন হয় তা পর্যবেক্ষণেও একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। আমলনামা সন্তোষজনক হলে আবারও তাদের পদ-পদবিতে যুক্ত করে পুরস্কৃত করার পরিকল্পনা রয়েছে। কিন্তু নেতিবাচক হলে চিরতরে বহিষ্কার করা হতে পারে দল থেকে।

সর্বশেষ খবর