সোমবার, ১৪ আগস্ট, ২০২৩ ০০:০০ টা

প্রশ্নফাঁসে চিকিৎসক সিন্ডিকেট

কোচিং সেন্টার খুলে হাতিয়ে নিয়েছে কোটি কোটি টাকা, ১২ জন গ্রেফতার

নিজস্ব প্রতিবেদক

মেডিকেল কলেজে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নফাঁসের সঙ্গে জড়িত চিকিৎসকদের একটি চক্র। তারা ২০০১ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ১০ বার প্রশ্নফাঁস করেছেন এবং হাতিয়ে নিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই চক্রটি কোচিং সেন্টার খুলে এবং প্রাইভেট পড়ানোর সুযোগ নিয়ে এই কান্ড করেছে। এদিকে গত ১০ দিনে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে প্রশ্নফাঁসের সঙ্গে জড়িত সাত চিকিৎসকসহ ১২ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। গ্রেফতারকৃতরা হলেন- ডা. ময়েজ উদ্দিন আহমেদ প্রধান, ডা. সোহেলী জামান, ডা. মোহাম্মদ আবু রায়হান, ডা. জেড এম সালেহীন শোভন, ডা. মো. জোবায়দুর রহমান জনি, ডা. জিল্লুর হাসান রনি, ডা. ইমরুল কায়েস হিমেল, জহিরুল ইসলাম ভূঁইয়া মুক্তার, রওশন আলী হিমু, আখতারুজ্জামান তুষার, জহির উদ্দিন আহমেদ বাপ্পি ও আবদুুল কুদ্দুস সরকার। এ ছাড়াও সিআইডি শতাধিক শিক্ষার্থীর নাম পেয়েছে, যারা ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্র পেয়ে মেডিকেলে ভর্তি হয়েছেন। এরই মধ্যে তাদের অনেকে পাস করে ডাক্তারও  হয়ে গেছেন। সিআইডি জানিয়েছে, যাদের গ্রেফতার করা হয়েছে তাদের কাছ থেকে নয়টি মোবাইল ফোন, চারটি ল্যাপটপ, ২ লাখ ১১ হাজার টাকা, ১৫ হাজার ১০০ বিদেশি মুদ্রা (থাই বাথ), বিভিন্ন ব্যাংকের ১৫টি চেক বই, ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ড, ভর্তির এডমিট কার্ড উদ্ধার করা হয়েছে। তারা বিভিন্ন কোচিং সেন্টারের আড়ালে মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস করতেন। ১৬ বছর ধরে শত শত মেডিকেল ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীর কাছে প্রশ্নপত্র সরবরাহ করেছে চক্রটি। এর মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ টাকা আয় করে দেশে বিলাসবহুল জীবনযাপন করছেন চক্রের সদস্যরা। এমনকি অনেকে বিদেশেও অর্থ পাচার করেছেন।

গতকাল রাজধানীর মালিবাগে সিআইডির মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান সংস্থাটির প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি মোহাম্মদ আলী মিয়া। তিনি বলেন, ৩০ জুলাই থেকে টানা ১০ দিন ঢাকা, টাঙ্গাইল, কিশোরগঞ্জ, বরিশালে অভিযান চালিয়ে প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের ১২ সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এর মধ্যে সাতজনই ডাক্তার। তাদের সবাই বিভিন্ন মেডিকেল ভর্তি কোচিং সেন্টার, নয়তো প্রাইভেট পড়ানোর আড়ালে প্রশ্নপত্র ফাঁস করতেন। ২০০১ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ১৬ বছরে অন্তত ১০ বার এই চক্র মেডিকেলের প্রশ্নপত্র ফাঁস করেছে। আসামিদের কাছ থেকে শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের দেওয়া বিপুলসংখ্যক ব্যাংকের চেক এবং এডমিট কার্ড উদ্ধার করা হয়েছে। তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে কোটি কোটি টাকার লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে।

এই সূত্রটি আরও জানিয়েছে, মেডিকেলের প্রশ্নফাঁসের অভিযোগে এর আগে গ্রেফতার হওয়া চক্রের অন্যতম হোতা জসীম উদ্দিন ভূঁইয়া এখন কারাগারে আছেন। তার কাছ থেকে একটি গোপন ডায়েরি উদ্ধার করা হয়েছে। যেখানে সারা দেশে ছড়িয়ে থাকা চক্রের অন্য সদস্যদের নাম রয়েছে। সে সব তথ্য যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। এই চক্রটি যেমন নানা কায়দায় প্রশ্নফাঁস করেছে, তেমনই গুজব ছড়িয়ে পরীক্ষার্থী ও অভিভাবকদের বিভ্রান্তও করেছে। সিআইডি প্রধান বলেন, দেশের মেডিকেল কলেজের ভর্তি পরীক্ষাগুলোতে নিয়মিত প্রশ্নফাঁসকারী সিন্ডিকেটের খোঁজ পায় সিআইডি। ২০২০ সালে মিরপুর থানায় করা এক মামলা থেকে জানা গেছে, চক্রের অন্তত ৮০ জন সদস্য প্রায় ১৬ বছরে হাজার হাজার শিক্ষার্থীকে অবৈধ উপায়ে মেডিকেল কলেজগুলোতে ভর্তি করিয়ে শত কোটি টাকা আয় করেছে। এদের মধ্যে আটজন তাদের দায় স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। যারা প্রশ্নপত্র পেয়ে মেডিকেলে ভর্তি হয়েছেন তাদের মধ্যে শতাধিকের নাম পাওয়া গেছে, যাদের অনেকে পাস করে ডাক্তারও হয়ে গেছেন। তিনি জানান, এদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনার কাজ প্রক্রিয়াধীন আছে। সিআইডি প্রধান জানান, প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের অন্যতম মাস্টারমাইন্ড ডা. ময়েজ উদ্দিন। মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করে ‘ফেইম’ নামে একটি কোচিং সেন্টারের মাধ্যমে মেডিকেল প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের সঙ্গে জড়ান। ২০ বছর এভাবে শত শত শিক্ষার্থীকে ভর্তি করিয়েছেন। এ ছাড়া গ্রেফতারকৃত ডা. সালেহীন শোভন, জোবাইদুর রহমান, জিল্লুর হাসান রনি ও জহির উদ্দিন আহমেদ বাপ্পী ২০০৫ সাল থেকে বিভিন্ন সময়ে প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িত। এরপর বিভিন্ন কোচিং সেন্টারের আড়ালে তারা প্রশ্নপত্র ফাঁস করে আসছিলেন। অতিরিক্ত আইজিপি মোহাম্মদ আলী মিয়া বলেন, এরই মধ্যে এসএসসি, এইচএসসি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা এবং বিসিএসসহ বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নফাঁসকারী সর্ববৃহৎ চক্রগুলোকে চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনা হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় দেশের মেডিকেল কলেজের ভর্তি পরীক্ষাগুলোতে নিয়মিত প্রশ্নফাঁসকারী বিশাল এই সিন্ডিকেটের সন্ধান মিলেছে।

কে কীভাবে এই চক্রে : মেডিকেল প্রশ্নফাঁস চক্রে জড়িত চিকিৎসক ময়েজ উদ্দিন আহমেদ ও সোহেলী জামান সম্পর্কে স্বামী-স্ত্রী। ময়েজ ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করে প্রশ্নফাঁসে জড়ান। তার মাধ্যমে শত শত শিক্ষার্থী অবৈধভাবে মেডিকেলে ভর্তি হয়েছেন। প্রশ্নফাঁস ও মানি লন্ডারিং মামলার আসামি এই ময়েজ চিহ্নিত ছাত্রশিবির নেতা এবং পরবর্তী সময়ে জামায়াতের ডাক্তার হিসেবে পরিচিত। তার স্ত্রী সোহেলী জামান প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের অন্যতম সদস্য। তিনি জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের ডাক্তার। ২০০৫ সালে প্রশ্ন পেয়ে ঢাকা ডেন্টাল কলেজে ভর্তি হয়ে এই প্রশ্নফাঁস চক্রের সঙ্গে জড়ান গ্রেফতার চিকিৎসক মো. আবু রায়হান। প্রাইভেট কোচিং সেন্টার চালাতেন। কিশোরগঞ্জের হোসেনপুরে একটি বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে প্র্যাকটিস করেন। আরেক চিকিৎসক জেড এম সালেহীন শোভন স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ থেকে পাস করে ‘থ্রি-ডক্টরস নামক’ কোচিং সেন্টারের মাধ্যমে মেডিকেল প্রশ্ন ফাঁসের সঙ্গে জড়িত হন। প্রশ্নফাঁসের মাধ্যমে শোভন বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন। তিনি ২০১৫ সালে র‌্যাবের হাতে একবার গ্রেফতারও হয়েছিলেন। শোভন স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের ছাত্রদলের পদধারী নেতা ছিলেন। এ ছাড়া গ্রেফতার চিকিৎসক মো. জোবাইদুর রহমান জনি ‘মেডিকো ভর্তি কোচিং সেন্টারের’ মালিক। ২০০৫ সাল থেকে এই চক্রে জড়িত। তিনি নামকরা বিভিন্ন ডাক্তারের সন্তানদের প্রশ্নফাঁস করে মেডিকেলে ভর্তির সুযোগ করে দিয়েছেন। তিনি মূলত মেডিকেল প্রশ্নফাঁসের সঙ্গে জড়িত চক্রের মূল হোতা ও বর্তমানে কারাগারে থাকা জসীমের গুরুত্বপূর্ণ সহযোগী। এই ব্যবসা করে দামি গাড়ি, বাড়ি, ব্যাংকে নগদ অর্থসহ কোটি কোটি টাকা আয় করেছেন। প্রশ্নফাঁসের মাধ্যমে অবৈধভাবে শত শত শিক্ষার্থীকে বিভিন্ন সরকারি- বেসকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি করান। জনি স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের ছাত্রদলের সভাপতি ছিলেন। পরে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য সম্পাদক ছিলেন। বর্তমানে যুবদলের কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যবিষয়ক সম্পাদক। চিকিৎসক জিল্লুর হাসান রনি জাতীয় পঙ্গু হাসপাতাল (নিটোর) একজন ডাক্তার। ২০০৫ সাল থেকে এই চক্রের সঙ্গে জড়িত হন। ২০১৫ সালের মেডিকেল পরীক্ষার সময় র‌্যাবের হাতে প্রশ্নফাঁসের অভিযোগে রংপুর থেকে গ্রেফতার হন। রংপুর মেডিকেলে অধ্যয়নকালে ছাত্রদল নেতা ছিলেন। বর্তমানে ড্যাবের সঙ্গে জড়িত এবং আহত বিএনপি নেতাদের চিকিৎসায় গঠিত দলের একজন চিকিৎসক।

সর্বশেষ খবর