বুধবার, ১৬ আগস্ট, ২০২৩ ০০:০০ টা

ভোট নিয়ে বিএনপির চোখ লন্ডনে

আসে সাংগঠনিক ও রাজনৈতিক চূড়ান্ত সব সিদ্ধান্ত

শফিউল আলম দোলন ও শফিকুল ইসলাম সোহাগ

ভোট নিয়ে বিএনপির চোখ লন্ডনে

আগামী ভোট নিয়ে বিএনপির চোখ এখন লন্ডনে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে বিএনপির সব কর্মকান্ডের কেন্দ্রবিন্দু এখন যুক্তরাজ্যের রাজধানী লন্ডনে অবস্থানরত দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। যে যত আলাপ-আলোচনাই করুন না কেন, দলের এই হাইকমান্ডের সিদ্ধান্ত ও ইশারা ছাড়া কোনো পদক্ষেপ গ্রহণের কথা চিন্তাই করতে পারেন না কেউ। এমনকি দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটিতে গুরুত্বপূর্ণ কোনো বিষয়ে আলোচনার পর সিদ্ধান্তের প্রশ্ন এলে কমিটির সব সদস্য মিলে শেষ পর্যন্ত সর্বসম্মতিক্রমে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের ওপরই দায়িত্ব অর্পণ করে থাকেন। ফলে যে কোনো সাংগঠনিক ও রাজনৈতিক বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসে লন্ডন থেকে। এটাই এখন বিএনপিতে নিয়মে পরিণত হয়েছে। চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া অসুস্থ ও গৃহবন্দি অবস্থায় রাজনীতি থেকে দূরে থাকায় দল ও অঙ্গসহযোগী সংগঠনের নেতাদের সব আস্থা ও বিশ্বাসের কেন্দ্রবিন্দুও হয়ে উঠেছেন তারেক রহমান। দলীয় নীতিনির্ধারক ও নির্ভরযোগ্য সূত্রগুলো এসব তথ্য নিশ্চিত করেছে।

দলের অন্যতম ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদুর সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বললে তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানই হলেন দলের হাইকমান্ড, তথা বিএনপির কেন্দ্রবিন্দু। আর তিনি অবস্থান করছেন লন্ডনে। সুতরাং দলের নেতাদের দৃষ্টি তো লন্ডনেই থাকবে। তা নয় তো কি অন্য কোনো দলের নেতাদের দিকে থাকবে?

একই অভিব্যক্তি প্রকাশ করেছেন দলের বিশেষ সম্পাদক ড. আসাদুজ্জামান রিপন। তিনি বলেন, ম্যাডামের পর দলের শীর্ষনেতা হলেন তারেক রহমান। তার অবস্থান এখন লন্ডনে। সুতরাং বিএনপির চোখ লন্ডনে থাকবে, নাকি আমেরিকায় অবস্থানরত কোনো আওয়ামী লীগ নেতার দিকে থাকবে? কর্তৃত্ববাদী সরকারের শাসনামলে প্রতিকূল পরিস্থিতির কারণে তিনি আজ দেশে আসতে পরছেন না। সে জন্য তিনি সেখান থেকেই নেতৃত্ব দিচ্ছেন। পরিবেশ অনুকূল হলে ইনশা-আল্লাহ তিনি অবশ্যই দেশে ফিরে আসবেন। আর সেদিনও বেশি দূরে নয়। দলের অপর একজন নীতিনির্ধারক জানান, তারেক রহমানের নির্দেশনায় যেমন রাজপথে আন্দোলন চলছে, তেমনি ভিতরে ভিতরে নির্বাচনী প্রস্তুতির কাজও চলছে। চলছে প্রার্থী নির্ধারণের প্রক্রিয়া। এমনকি নির্বাচনী ইশতেহার তৈরির কার্যক্রমও চলছে পুরোদমে। এই তো মাত্র কিছুদিন আগে এ জন্য দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে তিন সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটিও গঠন করা হয়েছে। সেটিও গঠন করে দিয়েছেন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান নিজে। এ কমিটি এখন দেশের বিশিষ্ট আইনজ্ঞ, সংবিধান বিশেষজ্ঞ, অর্থনীতিবিদ, রাজনীতি বিশেষজ্ঞসহ বিভিন্ন সেক্টরের এক্সপার্টিজদের সহায়তা নিচ্ছে। জানা গেছে, আগামী জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে কয়েক মাসে বিএনপির অর্ধশতাধিক কেন্দ্রীয় নেতা লন্ডনে গিয়ে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে দেখা করে এসেছেন। তার সঙ্গে দেখা করতে যাবেন আরও অনেকে। দলে দলে লন্ডনমুখী হচ্ছেন বিএনপি নেতারা। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দৃষ্টি আকর্ষণ, তার গুডবুকে নাম লেখানো ও এ ব্যাপারে এলাকায় আওয়াজ তোলা, দলের ভিতরে নিজের কদর বৃদ্ধিসহ নির্বাচনে মনোনয়ন তথা প্রার্থিতার বিষয়টি নিশ্চিত করতেই মূলত তারা হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন লন্ডনে। কেউ কেউ আবার সাক্ষাৎকালে তারেক রহমানের সঙ্গে নানা পোজের ছবি তুলে সে ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করে জানানও দিয়েছেন নিজেদের লন্ডন সফরের কথা। তবে এর মধ্যে বেশির ভাগ নেতাই স্ব-উদ্যোগে লন্ডন গিয়ে চেষ্টা-তদবির করে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের সঙ্গে দেখা করে আসছেন। জানা গেছে, গত এপ্রিল থেকে দলের বিভিন্ন স্তরের ৬০ জনের বেশি নেতা লন্ডন গিয়ে তারেক রহমানের সঙ্গে দেখা করে এসেছেন। এর মধ্যে বিএনপির সমমনা দলেরও কেউ কেউ রয়েছেন। বিএনপির উল্লেখযোগ্য নেতার মধ্যে সফর করে এসেছেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জয়নাল আবদিন ফারুক, আরেক উপদেষ্টা ও ঢাকা মহানগরী উত্তর বিএনপির আহ্বায়ক আমান উল্লাহ আমান, ঢাকা মহানগরী দক্ষিণ বিএনপির আহ্বায়ক আবদুস সালাম, বিএনপির মিডিয়া সেলের আহ্বায়ক ও সাবেক এমপি জহির উদ্দিন স্বপন, মানবাধিকারবিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান, প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী, ঢাকা মহানগরী দক্ষিণ বিএনপির সদস্য ইঞ্জিনিয়ার ইশরাক হোসেন, ব্যারিস্টার নাসিরউদ্দিন অসীমসহ আরও অনেকে। এ ছাড়া বিএনপির সাবেক জোটসঙ্গী ও বর্তমানে যুগপৎ আন্দোলনের সমমনা দল বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির (বিজেপি) চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমান পার্থও লন্ডনে তারেক রহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে ছবি তুলে যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশ করেছেন। একটি বেসরকারি টেলিভিশনে টক-শোতে তিনি একথা স্বীকার করে বলেছেন, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের সঙ্গে আমার আগে থেকেই ভালো সম্পর্ক রয়েছে। তার সঙ্গে সাক্ষাৎকালে রাজনীতির অনেক বিষয়েই কথা হয়েছে। তিনি বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনাও দিয়েছেন। এ ছাড়া দীর্ঘদিন ধরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থান করছেন এমন অনেক নেতা লন্ডনে গিয়ে তারেক রহমানের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ শুরু করেছেন। এ বিষয়ে বিএনপির কয়েকজন নীতিনির্ধারকের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তারা জানান, হাতেগোনা দু-একজন ছাড়া যারা লন্ডনে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করছেন, তাদের সবাই নিজ উদ্যোগে গেছেন এবং যাচ্ছেন। তাদের অধিকাংশকেই তিনি (তারেক রহমান) ডেকে নেননি। সবাই মোটামুটি দলের ভিতরে নিজের পদ-পদবি ও অবস্থান পাকাপোক্ত করতে এবং আগামী জাতীয় নির্বাচনে নিজের আসনে মনোনয়ন নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যেই সেখানে গেছেন এবং যাচ্ছেন। পাশাপাশি এলাকার নেতা-কর্মীদের জানানো যে, দলীয় হাইকমান্ডের সঙ্গে তার বোঝাপড়া ও অবস্থান খুবই ভালো। তার মনোনয়ন মোটামুটি নিশ্চিত। দলীয় নেতাদের লন্ডন সফর নিয়ে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান বরকতউল্লাহ বুলু বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, নেতার সঙ্গে কর্মীদের যোগাযোগের একটা বড় দিকই হচ্ছে দেখা-সাক্ষাৎ। নেতা যেহেতু লন্ডন থাকেন, সেহেতু দলীয় নেতা-কর্মীরাও লন্ডন যাবেন- এটাই স্বাভাবিক। তবে যাদের সামর্থ্য আছে, তারাই লন্ডন যাচ্ছেন। আবার অনেকে ব্যক্তিগত কাজে লন্ডন যান, তখন নেতার সঙ্গে দেখা করে আসেন। আবার অনেকে সাংগঠনিক কাজেও লন্ডন যেতে পারেন। এর মাধ্যমে সাংগঠনিক কার্যক্রম বরং আরও গতিশীল হয়। বিএনপির প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী তার সাম্প্রতিক লন্ডন সফর সম্পর্কে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, এটা তো কয়েক মাস আগের কথা। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎটা আসলে নির্বাচনকেন্দ্রিক ছিল না। আমরা একটা আন্দোলনের মধ্যে আছি। তিনি সেখান থেকে নেতৃত্ব ও গাইডলাইন দিচ্ছেন। সে আন্দোলন কীভাবে আরও বেগবান করা যায়, সেটাই আমাদের উদ্দেশ্য। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান দেশবাসীর কাছে দোয়া চেয়েছেন। চলমান আন্দোলন সফল করার জন্য সর্বস্তরের মানুষকে অংশ নিতে আহ্বান জানিয়েছেন। এ ছাড়া বিএনপির মিডিয়া সেলের বিষয়বস্তুসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদি নিয়েও আলোচনা হয়েছে। বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও দলের আন্তর্জাতিক বিষয়ক কমিটির সদস্য শামা ওবায়েদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, দলের কোনো নেতা বা কর্মী যে পর্যায়েই থাকুক না কেন, তিনি ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের সঙ্গে দেখা করবেন, এটা তো অত্যন্ত স্বাভাবিক ঘটনা। এতে তারা দ্বিগুণ-তিন গুণ হারে উজ্জীবিত হন, সাংগঠনিক কার্যক্রমে বেশি প্রেরণা পাবেন। তাছাড়া চলমান রাজপথের আন্দোলনের বিষয়েও তিনি দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন। কাজেই নেতাদের লন্ডন সফরের বিষয়টিতে নেতিবাচক কিছু নেই। বরং লন্ডনের দিকে বিএনপির চোখ থাকাটাই স্বাভাবিক।

সর্বশেষ খবর