বুধবার, ১৬ আগস্ট, ২০২৩ ০০:০০ টা
পিরোজপুরে জানাজা শেষে সাঈদীকে দাফন

ঢাকা চট্টগ্রাম কক্সবাজারে তাণ্ডব, নিহত ১

নিজস্ব প্রতিবেদক

ঢাকা চট্টগ্রাম কক্সবাজারে তাণ্ডব, নিহত ১

মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আমৃত্যু কারাদণ্ড পাওয়া জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর দাফন সম্পন্ন হয়েছে। গতকাল বেলা সাড়ে ৩টায় পিরোজপুর শহরের বাইপাস সড়কে সাঈদী ফাউন্ডেশন প্রাঙ্গণে বায়তুল হামদ জামে মসজিদের পাশে তাকে দাফন করা হয়। সাঈদীর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা ঢাকা, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে ব্যাপক তাণ্ডব চালায়। এতে একজন নিহত ও আহত হয়েছেন পুলিশসহ অর্ধশতাধিক। কক্সবাজারের চকোরিয়ায় সংর্ঘষে একজন গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়েছেন। চট্টগ্রামে পুলিশসহ আহত হয়েছেন অন্তত ২৫ জন। ঢাকার শাহবাগে জামায়াত-শিবিরের হামলার পর এক সংবাদ সম্মেলনে ডিএমপি কমিশনার বলেছেন, পুলিশ অসীম ধৈর্য ধরে কোনো শক্তি প্রয়োগ না করেই লাশ পিরোজপুর নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মীরা পুলিশের ওপর হামলা চালায়। এতে পুলিশের ৫টি গাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দুটি মোটরসাইকেলেও আগুন দেয় তারা। এ সময় পুলিশের বেশ কয়েকজন সিনিয়র কর্মকর্তা আহত হন। সোমবার রাত ৮টা ৪০ মিনিটে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুর সংবাদ ছড়িয়ে পড়লে জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মীরা দলে দলে হাসপাতালে আসতে শুরু করেন। তারা হাসপাতালের ভিতরে ও সামনের সড়কে অবস্থান নেয়। তারা ক্রমশ বিক্ষুব্ধ হতে থাকে। তারা প্রথমে হামলা চালায় কর্তব্যরত সাংবাদিকদের ওপর। এতে চারজন সংবাদকর্মী গুরুতর আহত হন। রাতভর জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মীরা দেলাওয়ার হোসেন সাঈদীর মৃত্যুকে ‘হত্যাকাণ্ড’ উল্লেখ করে বিক্ষোভ করেন। এ সময় সরকারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন স্লোগান দেন তারা। তারা সাঈদীর লাশ পিরোজপুর নিতে বাধা প্রদান করে। এ সময় পুলিশের ওপর হামলা চালায়। ব্যাপক তাণ্ডব চালাতে থাকে হাসপাতালের ভিতর-বাইরে। গতকাল ভোর ৫টায় পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ও সাউন্ড গ্রেনেড ছুড়ে তাদের ছত্রভঙ্গ করে। এ সময় কাঁদানে গ্যাসের শেল ও সাউন্ড গ্রেনেডের ধোঁয়ায় ছেয়ে যায় পুরো হাসপাতাল এলাকা। একপর্যায়ে জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে হাসপাতাল ও শাহবাগ এলাকা ত্যাগ করে বিভিন্ন দিকে চলে যান। সাঈদীর মৃত্যুতে গতকাল জোহরের নামাজের পর বায়তুল মোকাররমে গায়েবানা জানাজা করার দাবি তুলে তার দল জামায়াতে ইসলামী। পুলিশ অনুমতি না দিলেও দুপুরে তারা মসজিদের বাইরে জড়ো হতে থাকেন, এতে উত্তেজনা তৈরি হয়। এ সময় সাঈদীর ভক্ত-সমর্থক জামায়াত নেতা-কর্মী এবং আওয়ামী লীগের কর্মীদের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয়। এ সময় পুলিশ সেখান থেকে কয়েকজনকে আটক করে বলেন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মতিঝিল বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) হায়াতুল ইসলাম। হায়াতুল ইসলাম বলেন, ভিতরে শোক দিবসের অনুষ্ঠান পালনকারীদের সঙ্গে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার পর কিছু জামায়াত-শিবির কর্মী বায়তুল মোকাররমের উত্তর ফটকে এসে বিক্ষোভ শুরু করে। পুলিশ এলে তারা ভিতরে চলে যায়। তখন ভিতরে থাকা শোক দিবস পালনকারীদের সঙ্গে সংঘর্ষ বাধে। পরে পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ আনে, তবে পুলিশ মসজিদের ভিতরে ঢোকেনি।

এদিন বিকাল সাড়ে ৪টায় কক্সবাজারের চকরিয়ায় দেলওয়ার হোসাইন সাঈদীর গায়েবানা জানাজাকে কেন্দ্র করে সহিংসতায় ফোরকানুল ইসলাম (৬০) নামে একজন নিহত হয়েছেন। এ সময় সংঘর্ষে চকরিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ও ইউএনর গাড়ি ভাঙচুর করে। এ ঘটনায় মনির ও কুতুব উদ্দিন নামে দুজন আহত হন। কক্সবাজার প্রতিনিধি জানান, চকরিয়া পৌরসভার ৮ নম্বর ওয়ার্ড বাঁশঘাট রোডের মাথায় এ ঘটনা ঘটে। নিহত ফোরকানুল ইসলাম (৬০) চকরিয়া পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ড আবদুল বারী পাড়ার আবুল ফজলের ছেলে। সে পেশায় চা দোকানদার। চকরিয়া থানার ওসি জাবেদ মাহমুদ বলেন, কার গুলিতে কে নিহত হয়েছে আমি জানি না। জানাজা শেষে ফেরার পথে উচ্ছৃঙ্খল জনতা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। পরে পুলিশ ও ইউএনওর গাড়ি ভাঙচুর করে। পাশাপাশি কিছু লোক আবার পুলিশকে রক্ষা করতে সচেষ্ট ছিল।

চট্টগ্রাম থেকে প্রতিনিধি জানান, চট্টগ্রামে পুলিশের সঙ্গে জামায়াত-শিবিরের সংঘর্ষ পুলিশসহ আহত হয়েছে ২৫ জন। মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আমৃত্যু কারাদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর গায়েবানা জানাজাকে কেন্দ্র করে জামায়াত-শিবিরের সঙ্গে পুলিশের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়েছে। এ সময় জামায়াত-শিবির নেতা-কর্মীরা ব্যাপক ভাঙচুর চালিয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ ঘটনায় পুলিশের এডিসিসহ আহত হয়েছে প্রায় ২০-৩০ জন। নগরের আলমাস সিনেমা হলের সামনে থেকে এই সংঘর্ষ শুরু হয়। পরে কাজীর দেউড়ি মোড়, ওয়াসার মোড়, জিইসি মোড় ও লালখান বাজারসহ নগরের বিভিন্ন স্থানে তা ছড়িয়ে পড়ে। আহতদের মধ্যে নগর পুলিশের এডিসি নোবেল চাকমা, এসি অন্তু চক্রবর্তী, কোতোয়ালি থানার ওসি জাহিদুল কবির, ওসি তদন্ত রুবেল হাওলাদারসহ সাতজন পুলিশসহ ২০ জন। চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের উপকমিশনার (দক্ষিণ) মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, জানাজার অনুমতি ছাড়া জমিয়তুল ফালাহ মসজিদের আশপাশে জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মীরা বিকাল থেকে জড়ো হতে থাকে। তারা অতর্কিত পুলিশের ওপর হামলা চালায়। আমাদের পূর্বপ্রস্তুতি থাকায় তাৎক্ষণিকভাবে সেটা প্রতিরোধ করেছি। পুলিশের একাধিক সদস্য আহত হয়েছে।

চট্টগ্রাম মহানগর জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ও শুরা সদস্য আ জ ম ওবায়েদুল্লাহ জানান, আমরা গায়েবানা জানাজার জন্য প্রশাসনের কাছে অনুমতি চেয়েছি, না পেয়ে আমরা জানাজা স্থগিত করেছি। আমাদের নেতা-কর্মীসহ সবাইকে তা জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু যারা আমাদের নেতা-কর্মী নন, সাধারণ সাঈদী ভক্ত বিভিন্ন উপজেলা থেকে এসেছেন তারা ওই এলাকায় ছিলেন। কিন্তু পুলিশ নামাজের সময়ে মসজিদে প্রবেশ করতে না দিয়ে অতর্কিতভাবে হামলা করে ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটিয়েছে। কোতোয়ালি থানার ওসি জাহিদুল কবির বলেন, জামায়াত-শিবিরের ৩০ জনের বেশি নেতা-কর্মীকে কোতোয়ালি থানা পুলিশ গ্রেফতার করেছে। এ ঘটনায় পুলিশের এডিসি নোবেল চাকমা, এসি অন্তু চক্রবর্তীসহ ২০ জন আহত হয়েছে। খুলশী থানার ওসি সন্তোষ চাকমা বলেন, জামায়াতের নেতা-কর্মীরা অনুমতি ছাড়া বেআইনি জড়ো হচ্ছে। পুলিশ তাদের বাধা দিলে তারা অতর্কিত হামলা করে পুলিশের ওপর। পরে পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।

ডিএমপি কমিশনারের সংবাদ সম্মেলন : মানবতাবিরোধী অপরাধে আমৃত্যু কারাদণ্ডপ্রাপ্ত দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে জামায়াত-শিবির তাণ্ডব চালিয়েছে। হামলা ও ভাঙচুরের বিষয়টি বিবেচনা করে সাঈদীর গায়েবানা জানাজা রাজধানীতে করতে দেওয়া হবে না বলে জানিয়েছেন ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক। গতকাল সকালে রাজধানীর মিন্টো রোডে ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন। ডিএমপি কমিশনার বলেন, দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী মারা যাওয়ার পর তার দুই ছেলে হাসপাতালে উপস্থিত ছিলেন। তারা জেল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে পোস্টমর্টেম ছাড়া লাশ পিরোজপুরে নিয়ে যাওয়ার অনুমতি পায়। সে অনুযায়ী তারা লাশ পিরোজপুরে নেওয়ার প্রস্তুতি নিলে জামায়াতের কয়েক হাজার নেতা-কর্মী শাহবাগ ও বঙ্গবন্ধু মেডিকেল কলেজে একত্রিত হয়ে জানাজা পড়ার পরে লাশ নিয়ে যাওয়ার দাবি তোলে। পরের দিন শোক দিবসে বিভিন্ন প্রোগ্রাম থাকার কারণে পুলিশের পক্ষ থেকে তাদেরকে রাতে জানাজা পড়ার অনুমতি দেওয়া হয়। রাত ২টার দিকে তারা জানাজার পরিবর্তে মোনাজাত করে এবং পরে গায়েবানা জানাজা পড়ে নেওয়ার কথা জানায়। মোনাজাত শেষে লাশ যখন পিরোজপুরের উদ্দেশে নিয়ে যাওয়ার জন্য বের করা হয় তখন হাজার হাজার নেতা-কর্মী লাশবাহী গাড়ির সামনে শুয়ে পড়ে। তারা কোনো মতেই এই লাশ পিরোজপুরে নিয়ে যেতে দেবে না। তারা তখন লাশবাহী গাড়ির সঙ্গে থাকা পুলিশ সদস্যদের ওপর আক্রমণ করে তাদের গাড়ি ভাঙচুর শুরু করে। তাদের হামলায় পুলিশের সিনিয়র অফিসারসহ কয়েকজন আহত হন। পুলিশের ৫টি গাড়ি ভাঙচুর ও ২টি মোটরসাইকেল আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। ডিএমপি প্রধান আরও বলেন, ফজরের নামাজের পর তাদেরকে আবারও জানাজার অনুমতি দেওয়া হয়। কিন্তু ফজরের নামাজের পর তারা বঙ্গবন্ধু মেডিকেল কলেজ প্রাঙ্গণ দখল করে নেয় এবং লাশ পিরোজপুরে নিতে বাধা দেয়। তখন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতির আশঙ্কায় পুলিশ বাধ্য হয়ে অত্যন্ত সীমিত আকারে শক্তি প্রয়োগ করে বঙ্গবন্ধু মেডিকেল কলেজ ক্যাম্পাস মুক্ত করে লাশ পিরোজপুরে পাঠানোর ব্যবস্থা করে। হাসপাতালে অনেক রোগী ভর্তি ছিল তাদের সার্বিক স্বাস্থ্যের কথা চিন্তা করে পুলিশ প্রথম থেকে হাসপাতালে শক্তি প্রয়োগ করা থেকে বিরত ছিল। কিন্তু তাদের তাণ্ডবের একপর্যায়ে বাধ্য হয়ে পুলিশ সীমিত আকারে শক্তি প্রয়োগ করে।

ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনায় গ্রেফতার ১৬ : বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদ এলাকায় জামায়াত নেতাকর্মী এবং আওয়ামী লীগের কর্মীদের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনায় ১৬ জনকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে।

গতকাল দুপুরের এ ঘটনার পর কয়েকজনকে আটকের কথা জানানো হলেও রাতে ১৬ জনকে গ্রেফতারের তথ্য দেন ঢাকা মহানগর পুলিশের মতিঝিল বিভাগের উপ-কমিশনার হায়াতুল ইসলাম। এরা সবাই জামায়াত-শিবির কর্মী বলে জানান তিনি।

সর্বশেষ খবর