মশার লার্ভা নিধনে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) আমদানি করা জৈব কীটনাশক বিটিআই নিয়ে জালিয়াতির চিত্র ফুটে উঠেছে। এর মধ্যে গৃহকর পরিশোধের ভুয়া রশিদ নিয়ে চলছে তোলপাড়। গ্রাহকের টাকা আত্মসাতের লিখিত অভিযোগ জমা পড়েছে ডিএনসিসিতে। সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানে এহেন অনিয়মে ক্ষুব্ধ নগরবাসী।
এ বছর ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন চার শর বেশি মানুষ। দেশে ডেঙ্গু আক্রান্তের ইতিহাসে সবচেয়ে মৃত্যু। এডিস মশা বাগে আনতে হিমশিম খাচ্ছে সিটি করপোরেশন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে নতুন মশার ওষুধ বাসিলাস থুরিনজেনসিস ইসরায়েলেনসিস বা বিটিআই প্রয়োগ শুরু করে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন। গত ৭ আগস্ট রাজধানীর গুলশান লেকে বিটিআই প্রয়োগের উদ্বোধন করেন মেয়র আতিকুল ইসলাম। অনুষ্ঠানে ডিএনসিসি কর্তৃপক্ষ জানায়, সিঙ্গাপুরের বেস্ট কেমিক্যালস কোম্পানি থেকে ৫ টন বিটিআই আনা হয়েছে। প্রতি কেজির দাম পড়েছে ৩ হাজার ৩৮৫ টাকা। সে হিসেবে ৫ টনের দাম পড়েছে ১ কোটি ৬৯ লাখ ২৫ হাজার টাকা। সব মিলিয়ে ৫ কোটি টাকার বিটিআই আমদানির কথা জানায় উত্তর সিটি। অনুষ্ঠানে সিঙ্গাপুরের বেস্ট কেমিক্যালসের একজন প্রতিনিধির সঙ্গে সাংবাদিকদের পরিচয়ও করিয়ে দেওয়া হয়। তার নাম জানানো হয় ‘লি শিয়াং’। বলা হয়, তিনি কোম্পানির এক্সপোর্ট ম্যানেজার এবং তিনি ডিএনসিসির কর্মীদের প্রশিক্ষণ দেবেন। মার্শাল অ্যাগ্রোভেট কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড নামে একটি কোম্পানি কীটনাশকটি সরবরাহ করেছে। তারা দাবি করেছে, সিঙ্গাপুরের কোম্পানি বেস্ট কেমিক্যালস এর উৎপাদক। তবে বেস্ট কেমিক্যালস তাদের ফেসবুক পেজে ঘোষণা দিয়েছে, তারা এটি সরবরাহ করেনি। এমনকি তাদের নাম ব্যবহার করে যারা ‘বিটিআই’ সরবরাহ করেছে, তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণাও দিয়েছে তারা। গত সোমবার বেস্ট কেমিক্যালস সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘জালিয়াতির সতর্কবার্তা’ (স্ক্যাম অ্যালার্ট) শিরোনামে দেওয়া এক বার্তায় জানায়, ‘এটা আমাদের নজরে এসেছে যে বাংলাদেশের মার্শাল অ্যাগ্রোভেট কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড ৫ টন বিটিআই লার্ভিসাইড পণ্য ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে (ডিএনসিসি) সরবরাহ করেছিল। এতে তারা জালিয়াতির মাধ্যমে (ফ্রডলি) আমাদের কোম্পানির নাম (বেস্ট কেমিক্যাল) বিটিআইয়ের প্রস্তুতকারক হিসেবে ব্যবহার করেছে।’ সতর্কবার্তায় আরও বলা হয়, বেস্ট কেমিক্যালের মাধ্যমে ৫ টন বিটিআই লার্ভিসাইড সরবরাহ করা হয়নি। মার্শাল অ্যাগ্রোভেট কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড বেস্ট কেমিক্যালের নিযুক্ত কোনো পরিবেশকও নয়। এ ছাড়া মার্শাল অ্যাগ্রোভেট মি. লি শিয়াং নামে যে ব্যক্তিকে বেস্ট কেমিক্যালের রপ্তানি ব্যবস্থাপক (এক্সপোর্ট ম্যানেজার) এবং বিটিআই বিশেষজ্ঞ দাবি করেছিল, তিনি বেস্ট কেমিক্যালের কোনো কর্মী নন। ফেসবুকে দেওয়া ওই বার্তায় আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে বলেও হুঁশিয়ারি দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। এ বিষয়ে বলা হয়, ‘আমাদের মেধাস্বত্ব আইনের অধিকার লঙ্ঘন করে এমন জালিয়াতি, উৎপাদন, বিক্রি ও বিতরণ অথবা উৎপাদন, বিক্রি ও বিতরণের প্রস্তাব দেওয়া যে কোনো পক্ষের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নিতে বেস্ট কেমিক্যাল দ্বিধা করবে না।’ মার্শাল অ্যাগ্রোভেট কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার অ্যাসোসিয়েশনের (বিএফএ) সদস্য। প্রতিষ্ঠানটির কার্যালয় পুরানা পল্টনের বায়তুল আবেদ ভবনের নবম তলায়। বিএফএর ওয়েবসাইটে থাকা সদস্যদের বিস্তারিত তথ্যের জায়গায় প্রতিষ্ঠানটির একটি মুঠোফোন নম্বর দেওয়া রয়েছে। নম্বরটি মার্শাল অ্যাগ্রোভেটের মালিক মো. আলাউদ্দিনের। ওই নম্বরে কল দিলে বন্ধ পাওয়া যায়। ১৪ আগস্ট মার্শাল অ্যাগ্রোভেট কেমিক্যাল লিমিটেডকে চিঠি দিয়েছে ডিএনসিসি। সিটি করপোরেশনের প্রধান ভান্ডার ও ক্রয় কর্মকর্তা রমেন্দ্রনাথ বিশ্বাস স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে মার্শাল অ্যাগ্রোভেটের সরবরাহ করা বিটিআই যে সিঙ্গাপুরের বেস্ট কোম্পানির, এ-সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্যপ্রমাণ উপস্থাপন করতে বলা হয়েছে। মশা দমনে বিটিআই প্রসঙ্গে ডিএনসিসি মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা নিয়ম মেনেই স্বল্প দামে দিতে পারবে এমন কোম্পানি থেকে বিটিআই এনেছি। আমি বলিনি বিটিআই সবচেয়ে ভালো কোম্পানি থেকে এনেছি। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ও গবেষণা করে এ বিটিআইকে সবচেয়ে ভালো ও ভেজালহীন বলেছে। তবু বিটিআই নিয়ে কোনো প্রকার অনিয়ম হলে আইনের সর্বোচ্চ প্রয়োগ করা হবে।’ তিনি গতকাল রাজধানীর মোহাম্মদপুরে ডেঙ্গু দমনে পরিচালিত অভিযানে এসব কথা বলেন। মেয়র আরও বলেন, ‘মার্শাল অ্যাগ্রোভেট যেহেতু দাবি করেছে তারা সিঙ্গাপুরের বেস্ট কেমিক্যালস থেকে বিটিআই এনেছে, এজন্য তাদের কাছে আরও তথ্য চেয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে। সেখানে জানতে চাওয়া হয়েছে তারা কোন কোম্পানি থেকে এনেছে, কার মাধ্যমে এনেছে। আর ৫ টন বিটিআই মাত্র আনা হয়েছে পরীক্ষামূলকভাবে, আমাদের প্রয়োজন হবে হাজার টন।’ মশার ওষুধ নিয়ে শোরগোলের মধ্যে উঠে এসেছে গ্রাহকের গৃহকর আত্মসাতের আরেক চিত্র। গৃহকর পরিশোধে ভুয়া রসিদ পাওয়া নিয়ে ডিএনসিসিতে এখন পর্যন্ত সাতজন ভুক্তভোগী লিখিত অভিযোগ করেছেন। গৃহকর পরিশোধে ভুয়া রসিদ পাওয়া নিয়ে ৬ আগস্ট ডিএনসিসিতে অভিযোগ করেছেন রাজধানীর মিরপুরের মাটিকাটা এলাকার বাসিন্দা মারুফ হোসেন। প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা বরাবর লিখিত অভিযোগ করেন তিনি। অভিযোগে লিখেছেন, গত ২২ জানুয়ারি তিনি ডিএনসিসির অঞ্চল-২-এ একটি বেসরকারি ব্যাংকের এজেন্ট শাখায় ২০২২-২৩ অর্থবছরের গৃহকর বাবদ ৪২ হাজার ৭ টাকা পরিশোধ করেন। পরে ১১ জুলাই চলতি অর্থবছরের কর পরিশোধ করতে গিয়ে জানতে পারেন, তার গত অর্থবছরের টাকাই বকেয়া আছে। এ ঘটনায় যোগাযোগ করলে মিরপুরে ডিএনসিসির আঞ্চলিক কার্যালয়ের কর্মকর্তারা মারুফকে জানান, কর পরিশোধের যে রসিদ তাকে দেওয়া হয়েছে, সেটা ভুয়া। পরে কর পরিশোধের তথ্যসংক্রান্ত ঢাকা উত্তর সিটির ওয়েবসাইটের নাগরিক পোর্টালে গিয়ে দেখেন, তার কর পরিশোধের লেনদেনের তথ্যও সরিয়ে ফেলা হয়েছে। এভাবে ভুয়া রসিদ দিয়ে গ্রাহকের টাকা আত্মসাৎ করছে প্রতারক চক্র। এ অনিয়মের ঘটনায় উৎকণ্ঠা বাড়ছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের বাসিন্দাদের মধ্যে। গুলশানের বাসিন্দা সাবেক সরকারি কর্মকর্তা রুহুল হামিদ বলেন, ‘সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানে অনিয়মের এহেন চিত্র মোটেই কাম্য নয়। মশার কামড়ে চার শর বেশি মানুষ মারা গেছে। এ পরিস্থিতিতে মশার ওষুধ নিয়ে প্রতারণা ক্ষমার অযোগ্য। এর মধ্যে নতুন আতঙ্ক দেখা দিয়েছে গৃহকরের টাকা আত্মসাৎ। এসব প্রতারককে শনাক্ত করে ডিএনসিসি তাদের আইনের আওতায় আনবে বলে আমরা প্রত্যাশা করি।’