শিরোনাম
বৃহস্পতিবার, ১৭ আগস্ট, ২০২৩ ০০:০০ টা
স্মরণসভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা

গণতন্ত্রের নামে এ অঞ্চল দখলে নিতে চায় একটি বিশেষ শক্তি

নিজস্ব প্রতিবেদক

গণতন্ত্রের নামে এ অঞ্চল দখলে নিতে চায় একটি বিশেষ শক্তি

গণতন্ত্রের নামে নানা তৎপরতায় কোনো কোনো দেশ ভারত মহাসাগর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করতে চায় বলে মন্তব্য করেছেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, গণতন্ত্রের দোহাই দিয়ে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করে বিশেষ একটি শক্তি ভারত মহাসাগর ও বঙ্গোপসাগর অঞ্চল দখলে নিতে চায়। তারা আশপাশের বিভিন্ন দেশ ধ্বংস করতে চায়।

গতকাল বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর ৪৮তম শাহাদাতবার্ষিকী উপলক্ষে স্মরণসভায় সভাপতির ভাষণে তিনি এসব কথা বলেন। আওয়ামী লীগ এ সভার আয়োজন করে। কোনো খেলা খেলে জনগণের ভাগ্য কেউ যাতে কেড়ে না নিতে পারে সেজন্য দেশবাসীকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আমাকে সরিয়ে তাদের কিছু পদলেহনকারী গোলামকে ক্ষমতায় বসিয়ে ভারত মহাসাগরের মধ্যে থাকা দেশগুলো যাতে হামলা ও অশান্তি সৃষ্টি করে ধ্বংস করা যায়, সেই উদ্দেশ্য নিয়েই তাদের এত টালবাহানা। শত ব্যথা-বেদনা মুখ বুজে সহ্য করে দেশের মানুষের কল্যাণে দিনরাত কাজ করে যাচ্ছি। কতবার মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছি। যতক্ষণ বেঁচে আছি, ততক্ষণ দেশের মানুষের ভাগ্য নিয়ে কাউকে ছিনিমিনি খেলতে দেব না। দেশের মানুষের স্বার্থ বিকিয়ে দিয়ে ক্ষমতায় থাকার লোভ আমার বাবারও (বঙ্গবন্ধু) কোনো দিন ছিল না, আমারও নেই।

শেখ হাসিনা বলেন, বঙ্গবন্ধুসহ সপরিবারে হত্যাকাণ্ড কারবালা হত্যাকাণ্ডকেও হার মানায়। কারবালা হত্যাকাণ্ডে কোনো শিশু ও নারীকে হত্যা করা হয়নি। বঙ্গবন্ধুর হত্যার সঙ্গে জিয়াউর রহমান জড়িত। তিনিই হত্যার মাস্টারমাইন্ড। জামায়াতের উত্থান জিয়াউর রহমানের হাত ধরে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে এ দেশকে পাকিস্তানের ভাবধারায় নিতে চেয়েছিল স্বাধীনতার পরাজিত শক্তি। তিনি বলেন, আমার ছোট বোন রেহানাকে নিয়ে মাত্র ১৫ দিন আগে ৩০ জুলাই জার্মানির উদ্দেশে রওনা হয়ে ৩১ জুলাই সেখানে পৌঁছাই। আমরা ভাবতেও পারিনি আমাদের জীবনে এমন একটা আঘাত অপেক্ষা করছে। ১৩ তারিখে আব্বার সঙ্গে, মায়ের সঙ্গে, সবার সঙ্গে কথা হয়। ১৫ তারিখে এ ঘটনা ঘটার পর যখন আমরা জানতে পারি, তখন সব তথ্য আমরা জানতে পারিনি। আপনজন হারিয়ে বিদেশে রিফিউজি হিসেবে থাকতে হয়েছে। শেখ হাসিনা বলেন, এখন নির্বাচন নিয়ে অনেকে উতলা হয়েছে। তাদের কাছে আমার প্রশ্ন, ২০০১ সালে যখন আমাদের নেতা-কর্মীদের নির্যাতন করেছে, তখন তো নির্বাচন নিয়ে তাদের এত মাথাব্যথা ছিল না। ’৯৬ সালে খালেদা জিয়ার বিতর্কিত নির্বাচন নিয়ে তো তাদের এমন চেতনা দেখিনি। খালেদা জিয়ার ভুয়া ভোটার নিয়েও তো তাদের কোনো উদ্বেগ দেখিনি। আমার মনে হয়, বাংলাদেশের উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রা তাদের পছন্দ না। এদের উদ্দেশ্য, নির্বাচন বা গণতন্ত্র না। এরা উন্নয়নের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে চায়।

যুক্তরাষ্ট্র সফরের কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তারা গণতন্ত্রের কথা বলে। আমি তাদের দেশে (যুক্তরাষ্ট্র) একটা প্রোগ্রামে গিয়ে দেখেছি, লেখা আছে গভর্নমেন্ট অব দ্য পিপল, বাই দ্য পিপল, ফর দ্য পিপল। এ বিষয়ে আমি তাদের বলেছি, আমি এমন দেশ (বাংলাদেশ) থেকে এসেছি, যেখানে গভর্নমেন্ট অব দ্য আর্মি, বাই দ্য আর্মি, ফর দ্য আর্মি। সেই দলের পক্ষে আপনারা কথা বলেন!

সরকারপ্রধান বলেন, আমাদের দেশে কিছু আঁতেল আছে, তারা এসব চিন্তা করে কি না জানি না। কিছু উপলব্ধি না করেই দুটো পয়সা পাওয়ার আশায় এদের সঙ্গে সুর মেলায়। এ বিষয়ে আমাদের সবাইকে সচেতন থাকতে হবে। আর আগেও গ্যাস বিক্রির কথা আসছিল, আমি বলেছিলাম, দেশের স্বার্থ বেচে ক্ষমতায় আসতে হবে, এত ক্ষমতালোভী আমি না। আমার বাবাও এমন ছিলেন না। নোবেল বিজয়ী ড. ইউনূসের সমালোচনা করে শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের দেশের একজন কুলাঙ্গার সুদখোর আছে। শ্রমিকের অর্থ মেরে খায়। দেশের ট্যাক্স দেয় না। গরিব থেকে উচ্চ সুদে টাকা নিয়ে মেরে দিয়ে বিদেশে পাচার করে। বিদেশে বসে বিলাসী জীবনযাপন করে। ভারত মহাসাগর ও বঙ্গোপসাগরের ভৌগোলিক গুরুত্ব তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রাচীনকাল থেকে এই জায়গা দিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য চলে। আমাদের ভারত মহাসাগরে যতগুলো দেশ আছে কারও সঙ্গে কোনো দ্বন্দ্ব নেই, সম্পূর্ণ নিষ্কণ্টক একটা যোগাযোগ পথ। এ জলপথে আন্তর্জাতিকভাবে সবচেয়ে নির্বিঘ্নে পণ্য পরিবহন হয়।

নির্বাচন বানচাল করতে চায় বিএনপি : বিএনপিকে সন্ত্রাসী-বোমা হামলাকারীদের দল হিসেবে চিহ্নিত করে দেশবাসীকে সতর্ক করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আগামী নির্বাচন যেন সুষ্ঠুভাবে হতে না পারে সেজন্য তারা চক্রান্তে লিপ্ত। জাতির পিতার হত্যাকারী, সন্ত্রাসী, জঙ্গিবাদ সৃষ্টিকারী, বোমা হামলাকারী, গ্রেনেড হামলাকারী ওই বিএনপি। তারা জানে তারা নির্বাচন করে কোনো দিন ক্ষমতায় যেতে পারবে না, জনগণের ভোটও পাবে না। তাই নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ করা এবং ভোট যেন না হয় সেজন্য যত রকমের চক্রান্ত করা, এই চক্রান্তে তারা লিপ্ত। তিনি বলেন, আসল কথা ওরাতো (বিএনপি) নির্বাচন চায় না। কারণ তারা কাকে নিয়ে নির্বাচন করবে? তাদের দুই নেতার একজন এতিমের অর্থ আত্মসাতের মামলায় সাজাপ্রাপ্ত, আরেকজনের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং, ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলা, খুন-খারাবি, ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলায় সাজাপ্রাপ্ত ও পলাতক এবং মুচলেকা দিয়ে দেশ থেকে চলে গিয়েছে যে আর কোনো দিন রাজনীতি করবে না। এখন সেখানে বসে হুমকি দিচ্ছে, কত টাকা লাগে দেব, আন্দোলন চালিয়ে যান! কত টাকা সে পাচার করেছে। জিয়া পরিবারের পাচার করা টাকা তো আমেরিকার এফবিআই ধরেছে, সাক্ষ্য দিয়েছে, যাতে তারেক রহমানের সাজা হয়েছে।

আমাদের মানবাধিকার কোথায় ছিল : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি ইঙ্গিত করে শেখ হাসিনা বলেন, সব থেকে অবাক লাগে, যেসব দেশে এই খুনিদের (বঙ্গবন্ধুর) আশ্রয় দিয়ে রাখা হয়েছে, তারা আমাদের কাছে এসে মানবাধিকারের কথা বলে। তারা নির্বাচনের কথা বলে, স্বচ্ছতার কথা বলে। বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে একেবারে উতলা হয়ে পড়েছে। তাদের কাছে আমার প্রশ্ন, ২০০১ সালের নির্বাচনের পর এ দেশে নির্বিচারে অত্যাচার চলল। কত মানুষকে খুন করেছে। হাত কেটেছে। চোখ তুলে নিয়েছে। ঘরবাড়ি জ্বালিয়েছে। তখন নির্বাচন নিয়ে কোনো কথা হয়নি কেন? সেই নির্বাচনে তো আমাদের হারার কথা নয়। সে নির্বাচনে তো জোর করে আমাদের হারানো হয়েছে। প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, খালেদা জিয়া ১৫ ফেব্রুয়ারি ভোটারবিহিন নির্বাচন করেছিল, তখন তাদের নির্বাচনী চেতনা কোথায় ছিল? জিয়াউর রহমান বা জেনারেল এরশাদের সময় ৪৮ ঘণ্টা ভোটের ফল বন্ধ করে রেখে ফল ঘোষণা করে; সেটা নিয়ে তো এদের কোনো উদ্বেগ আমরা দেখিনি। আজকে তাদের কাছ থেকে নির্বাচনের কথা, মানবাধিকারের কথা আমাদের শুনতে হয়। তো আমাদের মানবাধিকার কোথায় ছিল, যেখানে আমরা বাবা-মায়ের হত্যার বিচার চাইতে পারতাম না। হত্যার বিচার চেয়ে একটা মামলা করার অধিকার আমাদের ছিল না। এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ১৯৮৮ সালে এরশাদের নির্বাচনের সময় তো তাদের উদ্বেগ দেখিনি। হঠাৎ এবারের ইলেকশনের সময় যেন খুব বেশি উতলা হয়ে পড়ল। নির্বাচনের একেবারে দাঁড়ি, কমা, সেমিকোলন, কোথায় কী, কীভাবে হবে তাই নিয়ে সব থেকে বেশি এবং একের পর এক তাদের লোকজন আসা শুরু করল। কেন? কারণটা কী? আর বিএনপি এখন তাদের চোখের মণি, যে বিএনপি এত মানুষ হত্যা করেছে। জাতির পিতার হত্যার সঙ্গে জড়িত। তারা কয়দিন আগেও আগুন দিয়েছে। ২০১৩, ’১৪ ও ’১৫-তে অগ্নিসন্ত্রাস করে শত শত জীবন্ত মানুষকে পুড়িয়ে হত্যা করল।

১৫ আগস্ট মিথ্যা জন্মদিন পালনের সমালোচনা : প্রধানমন্ত্রী বলেন, ’৯১ সালে ক্ষমতায় আসার পর তাঁর (খালেদা জিয়া) আসল রূপ বেরোল। ১৫ আগস্ট মিথ্যা জন্মদিন পালন শুরু করল। জিয়াউর রহমানের সঙ্গে বিয়ের সময় জন্ম তারিখ ১৫ আগস্ট উল্লেখ করেননি। সার্টিফিকেটেও নেই। এমনকি ফার্স্ট লেডি হিসেবে সে যে পাসপোর্ট করেছেন, সেখানে ১৫ আগস্ট জন্মদিন ছিল না। ক্ষমতায় আসার পর মিথ্যা উৎসব শুরু করেছে জঘন্য হত্যাকাণ্ডের দিন। কত জঘন্য এটা! আজকে তাদের কাছে মানবাধিকারের কথা শুনতে হয়! মানবাধিকার সে সময় কোথায় ছিল? তিনি বলেন, ইতিহাস কখনো মুছে ফেলা যায় না। এটাই বাস্তবতা। ভেবেছিল কোনো দিন এ হত্যাকাণ্ডের বিচার হবে না। আমি কৃতজ্ঞতা জানাই এ দেশের মানুষকে, আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের। ২১ বছর পর তাদের সমর্থনে ক্ষমতায় এসে সেই বিচারের উদ্যোগ নিই। ৩৫ বছর লেগেছে বিচার পেতে। কিছু খুনির রায় কার্যকর হয়েছে। পলাতক খুনিদের ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে। তিনি আরও বলেন, খুনিদের আশ্রয়প্রশ্রয় দিয়েছে জিয়া। এরশাদ এসেও তাদের পুনর্বাসন করেছে। ব্যারিস্টার মইনুল খুনিদের নিয়ে দলও গঠন করে। এটা খুনিদের মদদ দেওয়া।

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে জিয়া ওতপ্রোতভাবে জড়িত : শেখ হাসিনা বলেন, জিয়াউর রহমান ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। যারা আমাদের বাড়িতে সব সময় ওঠাবসা, খাওয়াদাওয়া করেছে, তারা বেইমানি করেছে। এতে কোনো সন্দেহ নেই। তিনি বলেন, খুনিরা বঙ্গবন্ধুর হত্যার সঙ্গে বাংলাদেশের নাম পরিবর্তন করে ফেলে। ইসলামী প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা দেয়। বাংলাদেশ বেতারের নাম পরিবর্তন করে রেডিও বাংলাদেশ করে। জয় বাংলা স্লোগান বাদ দিয়ে জিন্দাবাদ নিয়ে আসে। ইতিহাস বিকৃতি করে। বাংলাদেশের মানুষের উন্নতির সব স্বপ্ন বন্ধ হয়ে যায়। তিনি বলেন, খুনি মোশতাক নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করল, প্রথমেই জিয়াকে সেনাপ্রাধন বানাল। জিয়াউর রহমান এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। মীর জাফর যেমন তিন মাসের বেশি থাকতে পারেনি, তেমনি মোশতাকও থাকতে পারেনি। জিয়া ক্ষমতা দখল করে। উর্দি পরে ক্ষমতারোহণ এবং পরে নিজেকে রাজনীতিবিদ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করারও চেষ্টা করে। আর্মি রুলস ভঙ্গ করে একটা রাষ্ট্রপতি নির্বাচনও করে। ভোট কারচুপি ও ভোট চুরির কালচার তো সেখান থেকে শুরু। এরপর বিএনপি নামক সেই দল করে। স্মরণসভায় সূচনা বক্তব্য দেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ড. আবদুস সোবহান গোলাপ ও উপ-প্রচার সম্পাদক সৈয়দ আবদুল আউয়াল শামীমের পরিচালনায় সভায় আরও বক্তব্য দেন আমির হোসেন আমু, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম, অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক, শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি, এস এম কামাল হোসেন, তারানা হালিম, এস এম মান্নান কচি ও হুমায়ুন কবির।

সর্বশেষ খবর