বৃহস্পতিবার, ১৭ আগস্ট, ২০২৩ ০০:০০ টা

পুরান ঢাকায় ভয়ংকর ১৫০ রাসায়নিক গুদাম

মাহবুব মমতাজী

পুরান ঢাকায় ভয়ংকর ১৫০ রাসায়নিক গুদাম

পুরান ঢাকায় নিমতলীর পর চুড়িহাট্টা। স্মরণকালের ভয়াবহ আগুনের দুটি ঘটনার পরও রাসায়নিকের গুদাম স্থানান্তর করা হয়নি।

পুরান ঢাকার রাসায়নিকের গুদামগুলোর মধ্যে গ্রিন রাবার কারখানা একটি। এটি চকবাজারের সোয়ারীঘাট এলাকার কামালবাগে। ২০১৯ সালের ১২ মার্চ ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন গঠিত টাস্কফোর্স ওই কারখানা থেকে দাহ্য পদার্থ সরিয়ে নেওয়ার জন্য সাত দিনের সময় বেঁধে দেয়। সে সময় কারখানাটি ছিল ৩০/৬ নম্বর কামালবাগ হোল্ডিং নম্বরের বাড়িতে। গতকাল সরেজমিনে ওই ঠিকানায় গিয়ে সেই কারখানা পাওয়া যায়নি। কিন্তু আটটি ভবন পার হয়ে পাওয়া যায় সেই কারখানার খোঁজ। সেখানে দেখা গেছে, সেই আগের মতোই চলছে দাহ্য পদার্থ নিয়েই কারবার। তবে সেখানে মালিকের দেখা পাওয়া যায়নি। ছিলেন কর্মরত শ্রমিক ও কর্মচারীরা।

তবে মোবাইল ফোনে কারখানার মালিক মিজানুর রহমান এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘সিটি করপোরেশনের টাস্কফোর্স আমাকে শুধু অব্যবহৃত দাহ্য পদার্থ সরাতে বলেছিল। সব দাহ্য সরানোর জন্য বলেনি।’

এমন রাসায়নিকের গুদাম পুরান ঢাকায় অন্তত ১৫০টিরও বেশি আছে বলে খোঁজ পাওয়া গেছে। এসবের কারণে আতঙ্ক নিয়ে বসবাস করছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। অলিগলিতে রাসায়নিকের গুদাম থাকায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন চকবাজার, ছোট কাটরা, বড় কাটরা, কামালবাগ ও আগামসি লেনের বাসিন্দারা। পলাশ নামে চকবাজারের এক বাসিন্দা জানান, রাসায়নিকের এসব গুদাম সরানোর বিষয়ে কর্তৃপক্ষ একবার পদক্ষেপ নিয়েছিল। পরে আবার তারা পিছিয়ে পড়ে। যেভাবে গুদাম ছিল সেভাবেই আছে। জীবনের ঝুঁকি নিয়েই তাদের বসবাস করতে হচ্ছে। ২০১০ সালের ৩ জুন রাজধানীর পুরান ঢাকার নবাব কাটরার নিমতলীর ৪৩ নম্বর বাড়িতে রাত ৯টায় রাসায়নিকের গুদামে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়। জানা যায়, এরপর পুরান ঢাকার ঘিঞ্জি এলাকাগুলো থেকে রাসায়নিকের গুদাম সরানোর উদ্যোগ নেয় সরকার। এ জন্য স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে সিটি করপোরেশন ও ফায়ার সার্ভিস রাসায়নিক ব্যবসায়ীদের তালিকা তৈরি করে মন্ত্রিপরিষদে উপস্থাপন করে। ওই সময় সিটি করপোরেশন ও ফায়ার সার্ভিস যৌথভাবে ১ হাজার ৯২৪ ব্যবসায়ীর তালিকা করে মন্ত্রিপরিষদ গঠিত উচ্চপর্যায়ের কমিটির কাছে হস্তান্তরও করে। পরে ওই কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সরকার স্থায়ীভাবে মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখানের তুলসীখালীতে কেমিক্যাল পার্ক নির্মাণ করার দায়িত্ব দেয় শিল্প মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বিসিককে। এরপর ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি চকবাজারে চুড়িহাট্টায় রাসায়নিকের গুদামে আগুনে ৭৮ জনের মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় প্রশাসন কঠোরভাবে সিদ্ধান্ত নেয় পুরান ঢাকার সব রাসায়নিকের গুদাম কেরানীগঞ্জের নির্দিষ্ট একটি স্থানে স্থানান্তর করা হবে।

চকবাজার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কাজী শাহীনুজ্জামান বলেন, রাসায়নিকের সব গুদাম সরেনি। তবে কিছু সরেছে। এর সংখ্যা ৫ শতাংশের কিছু বেশি। চুড়িহাট্টার আগুনের প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, আগুন লাগার পর চুড়িহাট্টার ওয়াহিদ ম্যানশনে বিকট শব্দে ক্যানগুলো বিস্ফোরিত হয় এবং বিস্ফোরিত জ্বলন্ত ক্যান উড়ে এসে রাস্তায়ও পড়ে। সুগন্ধি তৈরিতে ব্যবহৃত অতি দাহ্য রাসায়নিকগুলোর মধ্যে ছিল ইথাইল অ্যালকোহল, বিউটেন, আইসো বিউটেন, প্রোপেইন, বুটোক্সি ইথানল, গ্লাইকল ইথার, ডাইইথাইল থালেট ও প্রোপিলিন।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা আরিফুল হক বলেন, টাস্কফোর্স গঠন করে পুরান ঢাকার যেসব রাসায়নিকের গুদাম সরাতে বলা হয়েছিল, সেগুলো এখনো সরেনি। পুরান ঢাকার রাসায়নিকের গুদামগুলোতে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, রাসায়নিক দিয়ে তৈরি রাবার, পলিথিন ব্যাগ ও প্লাস্টিকের দানা তৈরি হচ্ছে। এগুলো শ্রমিকদের কেউ কেউ বস্তায় সারি সারি করে রাখছেন। কেউ সেই বস্তা ভ্যানে তুলছেন অন্য কোথাও পাঠিয়ে দেওয়ার জন্য। আবার কেউবা রাসায়নিকের খালি প্লাস্টিকের ড্রামগুলো পাশের ফাঁকা স্থানে স্তূপ করে রাখছেন। ডিএসসিসির ৩১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর শেখ মোহাম্মদ আলমগীর এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘টাস্কফোর্স গঠনের পর পুরান ঢাকায় দাহ্য পদার্থ রাখা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। যারা এসবের ব্যবসা করছিলেন তাদের স্থানান্তর করার শর্তে ট্রেড লাইসেন্স বন্ধ রাখা হয়েছে। কিন্তু তারা কেরানীগঞ্জ উপজেলা থেকে ট্রেড লাইসেন্স নিয়ে রাসায়নিক আমদানি করছেন এবং সেগুলো পুরান ঢাকাতেই আগের মতো বিক্রি করছেন। তাদের বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছিল। কিন্তু কীভাবে তারা পুনরায় সংযোগ নিয়েছেন তা আমি বলতে পারব না। এই রাসায়নিক গুদামের সংখ্যা অগণিত।’ ডিএসসিসির টাস্কফোর্সের তথ্য অনুযায়ী পুরান ঢাকায় রাসায়নিক, প্লাস্টিক ও অন্যান্য ঝুঁকিপূর্ণ দাহ্য পদার্থের যেসব কারখানা ও গুদাম পাওয়া যায় এর মধ্যে রয়েছে আরমানিটোলার আরমানিয়ান স্ট্রিটের নুর ট্রেড হাউস, মোহসিন অ্যান্ড ব্রাদার্স, মেসার্স নোমান পারফিউমারি হাউস, ডিভাই ট্রেডলিংক, কিং সেন্ট ট্রেডিং, কেমি মার্ট, মেসার্স নয়নমণি কেমিক্যাল, ইয়ামান কেমিক্যালস পারফিউমারি, হাজী ট্রেডার্স, মোডল এন্টারপ্রাইজ, মেসার্স মারিয়া পারফিউমারি হাউস, এনবি কেমি কর্নার, জোহরা ট্রেডিং করপোরেশন, হাফসা এন্টারপ্রাইজ, এসআর কেমিক্যাল, মদিনা ট্রেড সেন্টার, দি ওরয়েন্ট কেমিক্যাল, ৮/১/এ নম্বর আরমানিয়ান স্ট্রিটের পরিত্যক্ত একটি ভবনে রাসায়নিকের গুদাম, বংশালের পুরানা মোগলটুলীর রোজিনা এন্টারপ্রাইজ, মালিটোলা রোডের মামুন ট্রেডার্স, চকবাজারের দেবীদাস ঘাট লেনের আলমগীর ব্যাপারী প্লাস্টিক, রাপী প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং, মেসার্স বার্জার রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ, কুদ্দুস প্লাস্টিক, রোমানা রাবার, হাফিজ প্লাস্টিক, নাজমুল রাবার প্লাস্টিক, হান্নান মেটাল, আলমানি এন্টারপ্রাইজ, তানভীর প্লাস্টিক, সোহাগ প্লাস্টিক, নিউ পলাশ রাবার, ফ্রেম প্লাস্টিক, মেসার্স আরএফ প্লাস্টিক, সোয়ারীঘাট কামালবাগের হেনা এন্টারপ্রাইজ, এটলাস প্লাস্টিক ও লোকমান প্লাস্টিক। এদিকে গত বছর ১ ফেব্রুয়ারি পুরান ঢাকার যেসব ভবনে রাসায়নিকের গুদাম, দোকান ও কারখানা আছে, সরকারের কাছে এর একটি তালিকা চেয়েছেন হাই কোর্ট। ওই বছর ১৭ এপ্রিলের মধ্যে এই তালিকা আদালতে জমা দেওয়ার নির্দেশও দেওয়া হয়েছিল। বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) আইনজীবী এস হাসানুল বান্না বলেন, সরকার এখনো সেই তালিকা হাই কোর্টে জমা দিতে পারেনি।

সর্বশেষ খবর