শিরোনাম
বৃহস্পতিবার, ১৭ আগস্ট, ২০২৩ ০০:০০ টা

নতুন সব জঙ্গি সংগঠনের নেপথ্যে জেএমবি

সাখাওয়াত কাওসার

দেশব্যাপী সিরিজ বোমা হামলার কারিগর জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) জঙ্গিরা এখনো সক্রিয়। দীর্ঘদিন ধরে সংগঠনটির শীর্ষ নেতৃত্বের অনেকেই কারাবন্দি হলেও গোপনে তৎপর তারা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নতুন ফরম্যাটে কারাগারের মধ্যেই তারা দাওয়াতি কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছেন। পুরনো জেএমবির সদস্যরা নানা কৌশলে নতুন জঙ্গি সংগঠনে মিশে যাচ্ছেন। নতুন নামে সংগঠন তৈরির পেছনেও তারা রাখছেন বিশেষ ভূমিকা। সবশেষ ১৩ আগস্ট মৌলভীবাজারের কুলাউড়ার পাহাড়ে ‘ইমাম মাহমুদের কাফেলা’ নামে নতুন জঙ্গি সংগঠনের অনেক শীর্ষ নেতা পুরনো জেএমবির আদর্শে দীক্ষিত ছিলেন। এর আগে গত বছরের শেষ দিকে জামায়াতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া গঠনেও পুরনো জেএমবির বিশেষ ভূমিকা ছিল। ৯ আগস্ট এই জঙ্গি সংগঠনটিকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। এলিট ফোর্স র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, ‘র‌্যাবের অভিযানেই জেএমবির আমির শায়খ আবদুর রহমান, সেকেন্ড ইন কমান্ড সিদ্দিকুল ইসলাম বাংলাভাই, আতাউর রহমান সানি, খালেদ সাইফুল্লাহ, আবদুল আউয়াল, আসাদুল ইসলাম আরিফসহ শীর্ষ জঙ্গি নেতারা গ্রেফতার হন। তাদের বিচারের মুখোমুখিও করা হয়েছে। ফাঁসির রায়ও সরকার কার্যকর করেছে। জঙ্গিরা এখন সাইবার মাধ্যমে তাদের কার্যক্রম চালানোর চেষ্টা চালাচ্ছে। তবে আমরা সাইবার ওয়ার্ল্ডে খোঁজখবর ও নজরদারি করছি। এটা নিয়ে আমরা সতর্ক অবস্থায় রয়েছি। অন্যান্য গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় করে জঙ্গিদের ওপর নজরদারি করা হচ্ছে।’ খন্দকার মঈন আরও বলেন, ‘আমরা খুব অল্প সময়ে জঙ্গিবাদ নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়েছি। জঙ্গি কার্যক্রম থেকে ফিরিয়ে এনে তাদের পুনর্বাসন করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে কয়েকজনকে পুনর্বাসন করা হয়েছে। তাই বলে এটা নিয়ে আত্মতুষ্টিতে ভুগছি না।’ জানা গেছে, জেএমবি এখন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তাদের কার্যক্রম বিস্তারের চেষ্টা করছে। ইতোমধ্যে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে এদের শক্তিশালী নেটওয়ার্কের তথ্য মিলেছে। মাওলানা সালাউদ্দীন সালেহীন এখনো সংগঠনটির আমিরের দায়িত্ব পালন করছেন। বাংলাদেশ অংশের তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত আমির রেজাউল হক ওরফে রেজা ওরফে তানভীর মাহমুদ ওরফে শিহাব আহনাফকে (৩৭) ২০২১ সালের ১০ এপ্রিল বাড্ডা থেকে গ্রেফতার করে ডিএমপির কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট (সিটিটিসি)। তিনি ২০০৫ সালে দেশজুড়ে সিরিজ বোমা হামলায় জড়িত ছিলেন। সিরিজ বোমা হামলার ঘটনায় ওই বছর গ্রেফতার হয়ে দীর্ঘদিন কারাগারে ছিলেন তিনি। ২০১৭ সালে জামিনে মুক্তি পেয়ে আবারও সাংগঠনিক কাজে সম্পৃক্ত হন। বর্তমানে কারাবন্দি খালেদ এবং রিপন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সংগঠনকে সক্রিয় করার চেষ্টা করছেন। এরই মধ্যে তারা আত্মগোপনে থাকা জঙ্গি সদস্যদের কাছে নানাভাবে বার্তা পৌঁছাচ্ছেন। চলতি বছরের ২৩ জুন তুহিন রেজা নামে এক সিরিজ বোমা হামলার আসামিকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব-৩। রেজা ২০০৪ সালে জেএমবির ঝিনাইদহ সদর শাখায় সদস্য ছিলেন। তিনি সেই শাখার লিফলেট তৈরি, লিখিত প্রচার-প্রচারণার সম্পাদনা, গোপন ও নাশকতামূলক খবরাখবর আদানপ্রদান করা ছাড়াও ভিডিও এডিটিং করে বিভ্রান্তিমূলক প্রামাণ্যচিত্র বানাতেন। পরিচয় লুকিয়ে রেজা প্রথমে একটি বেসরকারি টেলিভিশনে এবং সবশেষ আরেকটি বেসরকারি টেলিভিশনে ভিডিও এডিটর হিসেবে কাজ করে আত্মগোপনে ছিলেন। র‌্যাব বলছে, চাকরি করা অবস্থায়ও জঙ্গিদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন তিনি। একাধিক সূত্র বলছেন, সালেহীনের অন্যতম ঘনিষ্ঠ সহযোগী এবং সংগঠনের অপারেশন শাখার প্রধান জাহিদুল ইসলাম ওরফে বোমা মিজান ভারতীয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হয়ে বর্তমানে দিল্লি করাগারে রয়েছেন। ২০১৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি সালেহীন, বোমা মিজানসহ তিনজনকে ত্রিশালে প্রিজন ভ্যান থেকে ফিল্মিস্টাইলে ছিনতাই করেছিল জঙ্গিরা। ২০১৪ সালের ২ অক্টোবর ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমানের খাগড়াগড়ে জেএমবি বোমা বিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে তাদের আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অবস্থান জানান দেয়। ২০১৮ সালের ৭ আগস্ট ভারতের বেঙ্গালুরু থেকে জেএমবির দুর্ধর্ষ পলাতক জঙ্গি বোমারু মিজানকে গ্রেফতার করে ওই দেশের এনআইএ টিম। ২০১৯ সালের ২৯ এপ্রিল রাজধানীর গুলিস্তানে কর্তব্যরত পুলিশের ওপর বোমা হামলায় তিন পুলিশ সদস্য আহত হন। ওই বছরের ২৭ মে মালিবাগে পুলিশ ভ্যানে বোমা হামলায় একজন পথচারী আহত হন। একই বছরের ২৩ জুলাই রাতে খামারবাড়ি ও পল্টন পুলিশ বক্সে অজ্ঞাত ব্যক্তিরা দুটি শক্তিশালী আইইডিযুক্ত বোমা ফেলে রেখে যায়। সিটিটিসি বলছে, ভারপ্রাপ্ত আমিরের পদ ছাড়াও রেজাউল সংগঠনটির দাওয়াহ ও বায়তুলমাল বিভাগের প্রধান হিসেবে কাজ করতেন। বিভিন্ন সময় অনলাইনে সারা দেশের জেএমবি সদস্যদের মধ্যে মৌলবাদী বিষয় নিয়ে বক্তৃতা দিতেন। তিনি মূলত জেএমবির শীর্ষ নেতা সালাউদ্দিন সালেহীনের নির্দেশনায় বর্তমানে সংগঠনকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। সালেহীন অনেক দিন ধরে দেশের বাইরে পলাতক। সিটিটিসির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. রহমত উল্লাহ চৌধুরী বলেন, ‘আমরা জেএমবির সাংগঠনিক শক্তি ক্ষয় করতে পেরেছি। তবে কারাবন্দি কিংবা জামিনে থাকা সদস্যদের ওপর আমাদের তীক্ষè নজর রয়েছে।’ জানা গেছে, বাংলাদেশে সিরিজ বোমা হামলার ১৮ বছর পরও দেশ থেকে জঙ্গি হামলার আতঙ্ক যায়নি। মাঝেমধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ধরা পড়ছে ভয়ংকর জঙ্গি সদস্য। এর মধ্যেও গত বছরের শেষের দিকে জামা’আতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া নামে একটি নতুন জঙ্গি সংগঠনের আত্মপ্রকাশ ঘটে। এ সংগঠনের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের গ্রেফতারের পর ৯ আগস্ট এই জঙ্গি সংগঠনটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।

সর্বশেষ খবর