শুক্রবার, ১৮ আগস্ট, ২০২৩ ০০:০০ টা

ভয়ংকর ত্রিদেশীয় ব্ল্যাক ট্রায়াঙ্গল

♦ তৈরি হচ্ছে মাদক অস্ত্র, পাচার হয় বাংলাদেশ-ভারতে ♦ দুর্গম কয়েক হাজার বর্গকিলোমিটার অপরাধীদের আশ্রয়স্থল

মুহাম্মদ সেলিম, চট্টগ্রাম

ভয়ংকর ত্রিদেশীয় ব্ল্যাক ট্রায়াঙ্গল

ভয়ংকর হয়ে উঠছে বাংলাদেশ, ভারত ও মিয়ানমারের ত্রিদেশীয় সীমান্ত এলাকা। কয়েক হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকাটিতে উৎপাদিত হচ্ছে হেরোইনের অন্যতম উপাদান অপিয়াম। তৈরি হচ্ছে অত্যাধুনিক মারণাস্ত্র। একই সঙ্গে এ জোন ব্যবহার করে মাদকের ‘গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গল’ সান স্টেট থেকে আসছে মরণনেশা ইয়াবা, যা ছড়িয়ে পড়ছে বাংলাদেশ ও ভারতে। মাদক ও অস্ত্রের স্বর্গরাজ্য হয়ে ওঠা ত্রিদেশীয় এ এলাকা দুর্গম এবং অপরাধের স্বর্গরাজ্য হওয়ায় এটিকে আখ্যা দেওয়া হচ্ছে ‘ব্ল্যাক ট্রায়াঙ্গল’। নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর (অব.) এমদাদুল ইসলাম বলেন, ‘বাংলাদেশ, ভারত ও মিয়ানমার সীমান্তে বিশাল দুর্গম এলাকা রয়েছে। কয়েক হাজার বর্গ কিলোমিটারের বিশাল এ সীমান্ত এলাকায় বলতে গেলে কোনো দেশেরই কর্তৃত্ব নেই। তাই এ সুযোগে কিছু বিচ্ছিন্নবাদী ও সন্ত্রাসী সংগঠন নিরাপদ আশ্রয়স্থল হিসেবে বেছে নিয়েছে দুর্গম ওই এলাকাকে। এ এলাকায় অস্ত্র ও মাদক ব্যাপক হারে বেচাকেনা হচ্ছে।’

দেশের সীমান্ত এলাকার অপরাধ নিয়ে গবেষণা করছেন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের চট্টগ্রাম বিভাগীয় গোয়েন্দা কার্যালয়ের উপপরিচালক হুমায়ন কবির খোন্দকার। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ, ভারত ও মিয়ানমারের ত্রিদেশীয় দুর্গম পাহাড়ি এলাকা এখন অস্ত্রের বাণিজ্যিক অপরাধের হাবে পরিণত হয়েছে। দুর্গম এলাকায় ব্যাপক হারে উৎপাদিত হচ্ছে হেরোইন। একই সঙ্গে সান স্টেট থেকে আসা মাদকের চালান দুর্গম এলাকা হয়েই ছড়িয়ে পড়ছে বাংলাদেশ, ভারত ও মিয়ানমারে, যা আমাদের জন্য অশনিসংকেত।’

অনুসন্ধানে জানা যায়, বাংলাদেশ, ভারত ও মিয়ানমারের ত্রিদেশীয় দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় অবস্থান ব্ল্যাক ট্রায়াঙ্গলের। ভারতের মিজোরাম রাজ্য, বাংলাদেশের বান্দরবান ও রাঙামাটি এবং মিয়ানমারের চীন ও রাখাইন রাজ্যের কয়েক হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে অপরাধরাজ্য হয়ে ওঠা ব্ল্যাক ট্রায়াঙ্গলের অবস্থান। হাজার হাজার বর্গ কিলোমিটারের এ এলাকাটি দুর্গম হওয়ায় বাংলাদেশ, ভারত কিংবা মিয়ানমার কোনো দেশেরই নিয়ন্ত্রণ নেই। তাই এলাকাটি মিয়ানমারভিত্তিক বিভিন্ন সন্ত্রাসী গ্রুপ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। এ অঞ্চলে ব্যাপক হারে উৎপাদিত হচ্ছে মাদকের অন্যতম উপাদান অপিয়াম। এ ছাড়া গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গল হিসেবে পরিচিত মিয়ানমারের মাদকের রাজধানী খ্যাত সান স্টেট থেকেও ব্যাপক হারে আসছে ইয়াবার চালান। ব্ল্যাক ট্রায়াঙ্গল হয়েই রাঙামাটি, বান্দরবান ও কক্সবাজার হয়ে দেশে প্রবেশ করছে ইয়াবার বড় বড় চালান। মাদকের চালান ছাড়াও ব্ল্যাক ট্রায়াঙ্গল খ্যাত এ অঞ্চলে ব্যাপক হারে তৈরি হচ্ছে অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র, যা বিদ্যমান সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ছে বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমারের সন্ত্রাসী ও বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনগুলোর হাতে। ব্ল্যাক ট্রায়াঙ্গল নিয়ন্ত্রণে কাচিন ও সান স্টেটের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনগুলোর একটা জোট রয়েছে। এ জোটের নাম হচ্ছে ‘নর্দার্ন অ্যালায়েন্স’, বর্তমানে যা ‘ব্রাদার্সহুড’ নামে পরিচিতি পেয়েছে। এ ছাড়া ব্ল্যাক ট্রায়াঙ্গল নিয়ন্ত্রণ করে থাকে বিভিন্ন সন্ত্রাসী ও বিচ্ছিন্নতাবাদী গ্রুপ। এগুলোর মধ্যে অন্যতম আরাকান আর্মি, কাচিন ডিফেন্স আর্মি (কেডিআই), কাচিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (সিএনএফ), আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা), চীন ন্যাশনাল আর্মি, কুকি চীন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ), চীন ডিফেন্স ফোর্স (সিডিএফ), চীন লিবারেশন আর্মি ও মিজু ন্যাশনাল ফ্রন্ট (এমএনএফ)। এ ছাড়া অত্র অঞ্চলে গ্রুপ ও উপগ্রুপ রয়েছে আরও অন্তত ১৫টি। ‘গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গল থেকে বাংলাদেশ’ গবেষণায় উঠে এসেছে ব্ল্যাক ট্রায়াঙ্গলের মাদকের বিস্তার। গবেষণায় বলা হয়, ত্রিদেশীয় দুর্গম এলাকায় বিদ্রোহী গ্রুপের অধীনে অপিয়াম উৎপাদিত হচ্ছে। এ এলাকার মাদক উৎপাদন অচিরেই মাদকের রাজধানী খ্যাত সান স্টেটকে ছাড়িয়ে যেতে পারে। ব্ল্যাক ট্রায়াঙ্গলে ইয়াবা উৎপাদনে ভারতীয় প্রিকারসর কেমিক্যাল ব্যবহারের আশঙ্কা রয়েছে। ফলে এ অঞ্চলে গড়ে উঠবে অসংখ্য মাদক তৈরির কারখানা। এটা হলে মিজোরাম রাজ্য ও নাফ নদ হয়ে বঙ্গোপসাগর ব্যবহার করে ইয়াবা পাচার আরও বৃদ্ধি পাবে। গবেষক হুমায়ন কবির খোন্দকার বলেন, ‘অপরাধ-বাণিজ্যপ্রবণ এলাকা হওয়ার জন্য কিছু উপাদান লাগে। যেমন দুর্গম এলাকা, নদী ও সাগর, যার সবকিছুই রয়েছে বাংলাদেশ-ভারত-মিয়ানমার সীমান্তবর্তী এলাকায়। গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গলে যেমন মেকং নদী রয়েছে, একইভাবে নাফ নদ ও বঙ্গোপসাগরের সমন্বয়ে বাণিজ্যিক অপরাধের স্বর্গভূমিতে পরিণত হচ্ছে ত্রিদেশীয় সীমান্ত এলাকাটি। এখনই কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা না হলে অত্র অঞ্চলের জন্য খুবই ভয়ংকর হয়ে উঠবে ব্ল্যাক ট্রায়াঙ্গল।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর