নামসর্বস্ব হাউজিং কোম্পানি ও বাণিজ্যিক দখলদারদের কবলে পড়ে ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাচ্ছে বহুল আলোচিত আড়িয়াল বিল। প্রাকৃতিকভাবে গড়ে ওঠা মুন্সীগঞ্জের আড়িয়াল বিলে আবাসনের নামে বালু ও মাটি ভরাট, হাউজিংয়ের নামে অসংখ্য সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দখল ও স্থাপনা নির্মাণের কারণে ধ্বংসের পথে জীববৈচিত্র্য। সরকার এ বিলে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নির্মাণের উদ্যোগ থেকে সরে গেলেও স্বার্থান্বেষী দখলদাররা তাদের তৎপরতা বন্ধ করেনি। পদ্মা সেতু, ঢাকা-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়েসহ এ এলাকায় বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের ফলে এলাকাটি অর্থনৈতিকভাবে অনেক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। এ প্রেক্ষাপটে পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর একশ্রেণির হাউজিং কোম্পানি পদ্মা সেতুর সংযোগ সড়কের দুই পাশে এবং আশপাশে বিল-নদী দখল করে ভরাট শুরু করে। সর্বশেষ মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগরের আড়িয়াল বিল ভরাটে নেমে পড়েছে তারা। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান অনুমোদিত কোনো প্রকল্প ছাড়াই জমি ভাড়া নিয়ে সাইনবোর্ড টানিয়ে ক্রেতাদের প্রলুব্ধ করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার পাঁয়তারা করছে। নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই এসব দখলদার সিন্ডিকেট সদস্যরা অবৈধ ড্রেজার ও ড্রাম ট্রাক দিয়ে বালু ভরাট এবং আড়িয়াল বিলের উর্বর মাটি শত শত বড় ট্রলার দিয়ে বিভিন্ন ইটভাটায় বিক্রির মাধ্যমে গিলে খাচ্ছে। এদিকে অবৈধ দখলদার ঠেকাতে আড়িয়াল বিলে আবাসনের নামে বালি ও মাটি ভরাট, স্থাপনা নির্মাণ এবং দখল বন্ধের নির্দেশ দিয়েছেন হাই কোর্ট। ১৬ আগস্ট হাই কোর্ট এ নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়নে মুন্সীগঞ্জের জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, শ্রীনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও পরিবেশ অধিদফতরের পরিচালকের (এনফোর্সমেন্ট) প্রতি এ নির্দেশ দিয়েছেন। একই সঙ্গে ২০১০ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত আড়িয়াল বিলের স্যাটেলাইট এরিয়াল ম্যাপসহ তিন মাসের মধ্যে একটি পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন জমা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। একই সঙ্গে আড়িয়াল বিলে যাতে কেউ মাটি ভরাট, নির্মাণ ও দখল কার্যক্রম করতে না পারে, তা নিশ্চিত করতেও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। রুলে আড়িয়াল বিল সংরক্ষণে বিবাদীদের নিষ্ক্রিয়তা ও ব্যর্থতা কেন অবৈধ হবে না এবং আড়িয়াল বিলে অবৈধ দখল, ভরাট, স্থাপনা অপসারণ ও বিলটি সংরক্ষণের নির্দেশ কেন দেওয়া হবে না, তা জানতে চেয়েছেন হাই কোর্ট। এ বিষয়ে আদালতে রিট করেন সিনিয়র আইনজীবী মনজিল মোরসেদ। রিটের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত আড়িয়াল বিল রক্ষায় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেন। মুন্সীগঞ্জের আড়িয়াল বিলে এখন দখলের মহোৎসব চলছে। ১৩৬ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এ বিলে একশ্রেণির হাউজিং ব্যবসায়ী ড্রেজার ও ড্রাম ট্রাক দিয়ে কৃষি ও সরকারি খাসজমিসহ খাল, জলাশয়, পুকুর ভরাট করছে। পদ্মা নদীর সংযোগ খালসহ চারদিক থেকে বহু খালের মুখ বন্ধ করে দিয়েছে দখলদাররা। চারদিকের খাল দিয়ে আড়িয়াল বিলের পানি আসতে না পারায় বিলের মাছ ও শস্যভান্ডার পুরোপুরি হুমকিতে পড়েছে। ছোটবড় খাল, জলাশয়, পুকুর, ডাঙা ভরাটে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়ে বিপাকে পড়েছে হাজার হাজার কৃষকসহ স্থানীয় মানুষ। কৃষিজমি ভরাট করে দখলদাররা গড়ে তুলেছে আবাসনের নামে চটকদার অবৈধ হাউজিং প্রকল্প। এর ফলে দেশের কৃষিভূমির বিরাট একটি অংশ অবরুদ্ধ হওয়ায় খাদ্য উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। বিল এলাকা সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, মেরিন গ্রুপ, গুলশান সিটি, বাতায়ন, পুষ্পধারা প্রপার্টিজ লিমিটেড, ধরিত্রী, দখিনাচল, শান্তিনিবাস, বারিধারা হাউজিং কোম্পানি, মৈত্রী ইকো ভিলেজ, পদ্মা সিটি হাউজিং নামের নানা সাইনবোর্ডে সয়লাব এ এলাকার কৃষিজমি। বহুল আলোচিত আড়িয়াল বিল প্রমত্তা পদ্মা ও ধলেশ্বরী নদীর মাঝখানে মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর, সিরাজদিখান, ঢাকার দোহার ও নবাবগঞ্জ উপজেলার অন্তর্গত বৃহৎ একটি ভূমি। এটি দেশের মধ্যাঞ্চলের সবচেয়ে বড় ও প্রাচীন বিল। আড়িয়াল বিলের বেশির ভাগ এলাকাই শুষ্ক ঋতুতে আর্দ্র এবং বিলে যথেষ্ট পরিমাণ পানি থাকে। বর্ষায় পানিতে টইটম্বুর থাকলেও শীতকালে এটি বিস্তীর্ণ শস্য খেতে পরিণত হয়। এখানে শীতকালে নানা ধরনের সবজির চাষ হয়। ২৮ হাজার হেক্টর জমির মধ্যে প্রায় ১০ হাজার হেক্টরই খাস ও ভেস্টেড প্রপার্টি। কিন্তু আড়িয়াল বিল পাড়ের চারদিকে যে হারে অবৈধ ড্রেজার ও ড্রাম ট্রাক দিয় কৃষি ও খাস জমি ভরাট হচ্ছে, তাতে অল্প সময়ে এ বিশাল জলাভূমির কেন্দ্রস্থল ‘কংক্রিটের জঙ্গল’-এ পরিণত হবে। পরিবেশ অধিদফতর, মুন্সীগঞ্জ শাখার উপপরিচালক মো. মিজানুর রহমান বলেন, ‘আড়িয়াল বিলে এখন পর্যন্ত কোনো আবাসন প্রকল্পের অনুমতি আমরা দিইনি। অন্য দখলদারদের বিষয়ে খোঁজ নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ উল্লেখ্য, ২০১১ সালে সরকার আড়িয়াল বিলে ‘বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর’ তৈরির পরিকল্পনা নেয়। এ লক্ষ্যে ভূমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া শুরু হলে আড়িয়াল বিলের মানুষ তাদের পৈতৃক জমিতে সরকারের পরিকল্পনার বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে। বিলরক্ষায় তারা গঠন করে ‘আড়িয়াল বিল রক্ষা কমিটি’। ২০১১ সালের ৩১ জানুয়ারি হাজার হাজার কৃষকসহ নারী-পুরুষ আড়িয়াল বিল রক্ষায় লাঠিহাতে বিক্ষোভ করে ঢাকা-মাওয়া মহাসড়ক অবরোধ করে যানবাহন ভাঙচুর করে। সেই বিক্ষোভে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সঙ্গে সংঘর্ষে এক পুলিশ সদস্য প্রাণ হারান। সরকার বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নির্মাণ প্রকল্প বাতিল করে দেয়। ওই সময় কৃষক তাদের কয়েক প্রজন্মের পৈতৃক আড়িয়াল বিলের জমি আঁকড়ে ধরে ছিল। এখন নামসর্বস্ব হাউজিং ও বিভিন্ন কোম্পানির নামে স্বার্থান্বেষী মহল ওই কৃষকদের নানাভাবে চাপে ফেলে বাপদাদার আমলের জমি বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে। একশ্রেণির দালাল অনেক বেশি টাকার লোভ দেখিয়ে কৃষকের জমি দখল করে নিচ্ছে। কোনো কোনো দালাল কৃষকের কাছ থেকে জমি ভাড়া নিয়ে বিভিন্ন হাউজিং কোম্পানির সাইনবোর্ড টানিয়ে দিচ্ছে। যারা জমি বিক্রি করতে চাচ্ছে না তাদের নানাভাবে ভয়ভীতি দেখিয়ে এবং আশপাশের জমি কিনে তাদের জমি বিক্রিতে বাধ্য করছে। কারও কারও জমিতে রাতের আঁধারে বালি ফেলে ভরাট করে দখল করা হচ্ছে। এতে হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে কৃষকের জমি। এভাবে গোটা আড়িয়াল বিল অবৈধ দখলদারদের নিয়ন্ত্রণে চলে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে প্রাকৃতিক জলাধার বিলের পরিবেশ বিপর্যয়ের মুখে পড়ছে। প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইন-২০০০ অনুযায়ী, সরকারি যে কোনো জলাধার কোনোভাবেই ভরাট করা যাবে না। কোনো ব্যক্তি বা সংস্থা উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের পূর্বানুমতি ছাড়া সরকারি কোনো জলাধারে কোনো কাঠামো নির্মাণ, জমির উন্নয়ন, বালি বা কাদা উত্তোলন করে জলের গতি বন্ধ বা পরিবর্তন বা পরিবর্তনের চেষ্টা করতে পারবে না। এ ছাড়া কোনো প্রকার আবাসন প্রকল্প করতে গেলে বেশ কয়েকটি নীতিমালা অনুসরণ এবং নিয়মকানুন মেনেই করতে হবে। তার মধ্যে রয়েছে- কোনো কোম্পানি যদি আবাসন প্রকল্প করতে চায় তাহলে তাদের নামে কমপক্ষে ১০ একর জমি থাকতে হবে। সংশ্লি ইউনিয়ন পরিষদ থেকে ট্রেড লাইসেন্স নিতে হবে। গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নিতে হবে। জেলা প্রশাসনের কাছ থেকে দায়মুক্তি সনদ নিতে হবে। পরিবেশ অধিদফতর থেকে তিন ধাপের ছাড়পত্র নিতে হবে। এসব নিয়মনীতি পরিপালন সাপেক্ষে কোনো কোম্পানি একটি আবাসন প্রকল্প করতে পারে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আড়িয়াল বিল এলাকায় এ ধরনের কোনো ছাড়পত্র, নিয়মনীতির বালাই দখলদারদের মধ্যে নেই। তারা কেউ সবে জেলা প্রশাসনে দরখাস্ত করেছে। কেউ আবার কিছুই করেনি। আবার কেউ বলছেন, তাদের জমি বেদখল ঠেকাতে আবাসনের সাইনবোর্ড লাগিয়েছেন। এসব দখলদারের বিষয়ে হাষাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. সোলায়মান হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, হাউজিং সম্পর্কে জেলা প্রশাসনের কড়া নির্দেশনা রয়েছে। কেউ চাইলেই এ বিষয়ে ট্রেড লাইসেন্স দেওয়া যায় না। তা নিতে হলে নিয়মকানুন মেনে দায়মুক্তি ছাড়পত্র দেখিয়ে নিতে হবে। এ পর্যন্ত তিনি কোনো ট্রেড লাইসেন্স কাউকে দেননি। হাষাড়ায় তিনি যেসব আবাসনের সাইনবোর্ড দেখেন তার কোনোটারই ট্রেড লাইসেন্স দেননি বলেও জানান। এ বিষয়ে শ্রীনগর সদর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. তাজুল ইসলাম জানান, তাঁর কাছ থেকেও কোনো আবাসন প্রকল্পের নামে কেউ ট্রেড লাইসেন্স নেয়নি। তিনি বলেন, আড়িয়াল বিল এলাকায় এবং তাঁর ইউনিয়নের মধ্যে যেসব আবাসন প্রকল্পের সাইনবোর্ড রয়েছে তার কোনো ট্রেড লাইসেন্স তিনি দেননি। এগুলো সবই অবৈধভাবে গড়ে উঠেছে। এ বিষয়ে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের এসএ শাখার ক্লার্ক শিরিন আক্তার সাংবাদিকদের জানান, শ্রীনগর উপজেলার অন্তর্গত এলাকায় বেশ কয়েকটি হাউজিং কোম্পানি জেলা প্রশাসনের বরাবর দায়মুক্তি সনদ চেয়ে আবেদন করেছে; কিন্তু কেউই এখনো এটা পায়নি। এদিকে আড়িয়াল বিলের আশপাশে থাকা একাধিক দখলদার কৌশলে বিমানবন্দর ঠেকিয়ে এখন সেখান থেকে মাটি লুট করে নিয়ে বিক্রি করছে বিভিন্ন ইটভাটায়। মহলটি দিনে রাতে সমানতালে আড়িয়াল বিলের মাটি লুট করছে মাটিবাহী বাল্কহেড বোঝাই করে।
আড়িয়াল বিলের বিভিন্ন পয়েন্টে বিশালকায় শত শত মাটির স্তূপ রয়েছে। আর এ মাটি বিভিন্ন ইটভাটায় বিক্রি করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে ওই মহল। স্থানীয় প্রশাসন কোনো অভিযোগ না পাওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারছে না বলে জানিয়েছে থানা প্রশাসন। অড়িয়াল বিলের বাড়ৈখালী মৌজা, আলমপুর মৌজা ও কাঁঠালবাড়ি এলাকার কতিপয় মাটি ব্যবসায়ী এ বিলের ফসলি জমির মাটি কেটে ইটভাটায় বিক্রি করছেন। এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক মো. আবু জাফর রিপন সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমি এ জেলায় নতুন যোগ দিয়েছি। ইতোমধ্যে আড়িয়াল বিলে কৃষিজমি কেটে নেওয়া বা ভরাট করে আবাসন ব্যবসা করার কথা শুনেছি এবং এটা জানার সঙ্গে সঙ্গেই সংশ্লিষ্ট ইউএনওকে এ বিষয়ে নজর দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছি। এ বিষয়ে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। আবাসন প্রকল্প গড়ে তুলতে হলে সব ধরনের নিয়মকানুন মেনে এবং পরিপালন করে করতে হবে। কেউই এখানে অবৈধভাবে আবাসন ব্যবসা করতে পারবে না বা আড়িয়াল বিলের মাটি লুট করতে পারবে না। অবৈধ আবাসন প্রকল্পের তালিকা করার জন্যও আমি উপজেলা প্রশাসনকে নির্দেশ দিয়েছি। সে অনুযায়ী তারা কাজও শুরু করেছেন। খুব শিগগিরই অবৈধ আবাসন প্রকল্পের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’