বৃহস্পতিবার, ২৪ আগস্ট, ২০২৩ ০০:০০ টা

জাপায় তোলপাড়, দিনভর বনানীতে বিক্ষোভ

জি এম কাদের বললেন, ভারত ভালো ভোট চায়

নিজস্ব প্রতিবেদক

জাপায় তোলপাড়, দিনভর বনানীতে বিক্ষোভ

বেগম রওশন এরশাদের নিজেকে চেয়ারম্যান ঘোষণার পর থেকে আতঙ্ক কাটছে না জাতীয় পার্টির নেতা-কর্মীদের মধ্যে। দলটির শীর্ষ নেতৃত্বে হরহামেশা এমন দ্বন্দ্ব দেখা দিলেও নির্বাচন সামনে রেখে এবারের এই নাটকীয় ধাক্কা বড় দাগ কেটেছে তাদের মনে। রওশন এরশাদের পক্ষ থেকে পরে নিজেকে চেয়ারম্যান ঘোষণার কথা অস্বীকার করা হলেও বিষয়টিকে তাৎপর্যপূর্ণ বলেই মনে করছেন পার্টির সব পর্যায়ের নেতা। তারা মনে করেন, জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে ক্ষমতাসীন দলের ইন্ধনে রওশনপন্থিরা দলে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করছেন।

পার্টির চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদেরের ভারতে অবস্থানের সময় রওশন এরশাদের নিজেকে চেয়ারম্যান ঘোষণার খবর শোনার পর থেকেই দলটির বনানী কার্যালয়ে ভিড় জমান দলীয় নেতা-কর্মীরা। তারা গতকাল ও আগের দিন মঙ্গলবার রাজধানীর বনানী কার্যালয়ে রওশন এরশাদের বিরুদ্ধে ব্যাপক বিক্ষোভ করেন। এ ছাড়া দলের সিংহভাগ সিনিয়র নেতা ফেসবুকে জি এম কাদেরের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে পোস্ট দেন। এদিকে গতকাল সন্ধ্যায় তিন দিনের সফর শেষে ভারত থেকে দেশে ফিরেছেন পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের। এ সময় দলের মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু, প্রেসিডিয়াম সদস্য লিয়াকত হোসেন খোকা, শফিকুল ইসলাম, নাজমা আক্তারসহ বিপুলসংখ্যক নেতা-কর্মী তাকে বিমানবন্দরে অভ্যর্থনা জানান। তবে কোনো কো-চেয়ারম্যানকে গতকাল বিমানবন্দরে দেখা যায়নি। বেগম রওশন এরশাদ অথবা তার চিঠি প্রসঙ্গে জি এম কাদেরও বিমানবন্দরে কোনো কথা বলেননি। মঙ্গলবার সকালে কেন্দ্রীয় জাপার প্যাডে নিজের স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে বেগম রওশন এরশাদ নিজেকে পার্টির চেয়ারম্যান ঘোষণা করার পর থেকেই ‘রওশন আতঙ্ক’ জেঁকে বসে দলটির নেতা-কর্মীদের মধ্যে। এর আগেও বিভিন্ন চিঠির মাধ্যমে কাউকে মহাসচিব, কাউকে কো-চেয়ারম্যান, এমনকি ৪২টি জেলা কমিটি অনুমোদন দেন রওশন এরশাদ। পরে এসব বিষয়ে একাধিকবার জানতে চাওয়া হলে তিনি গণমাধ্যমের কাছে তা অস্বীকার করেন।

অথচ যাদের স্বাক্ষরে রওশন এরশাদের নাম ব্যবহার করে বিভিন্ন চিঠি গণমাধ্যমে পাঠানো হয়েছিল, তাদের নিয়েই শনিবার গণভবনে যান রওশন এরশাদ।

এ বিষয়ে রওশনপন্থি জাপার এক প্রেসিডিয়াম সদস্য বলেন, ‘আমি জীবনেও এ ধরনের রাজনীতি দেখিনি। এসব হঠকারী সিদ্ধান্ত যারা নিচ্ছেন তারা উভয় পক্ষকে ক্ষতিগ্রস্ত করছেন।’ জাতীয় পার্টির অপর এক প্রেসিডিয়াম সদস্য বলেন, সম্প্রতি গণভবনে রওশন এরশাদ ছাড়া বাকি যে তিনজন গিয়েছিলেন, তারাই রবিবার জাতীয় পার্টির কাউন্সিলের ডাক দেন। অতঃপর তারাই আবার মঙ্গলবার রওশন এরশাদকে পার্টির চেয়ারম্যান হিসেবে ঘোষণা দেন। আসলে এর মাধ্যমে তারা পার্টির নেতা-কর্মীসহ দেশের মানুষকে বোঝাতে চেয়েছেন, প্রধানমন্ত্রীর বৈঠক থেকে এ ধরনের মেসেজ এসেছে। যদিও বরাবরের মতো এবারও নিজেকে চেয়ারম্যান ঘোষণার চিঠির বিষয় অস্বীকার করছেন বেগম রওশন এরশাদ। তবে তিনি এই চিঠি বা প্রেস বিজ্ঞপ্তির বিষয় অস্বীকার করলেও যারা এসব চিঠি গণমাধ্যমে পাঠান তাদের বিরুদ্ধে কোনো সাংগঠনিক ব্যবস্থা না নেওয়ায় নেতা-কর্মীদের অভিযোগের তীর রওশন এরশাদের দিকেই প্রতিফলিত হচ্ছে। এ বিষয়ে জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, রওশন এরশাদ যে চিঠি দিয়েছেন গঠনতন্ত্র অনুযায়ী তা তিনি দিতে পারেন না। আর চিঠিতে যাদের স্বাক্ষরের কথা উল্লেখ করা হয়েছে তারা সবাই অস্বীকার করেছেন। চুন্নু আরও বলেন, কয়েকজন লোক রওশন এরশাদের মানসম্মান নষ্ট করার চেষ্টা করছেন। তারা শনিবার প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে অনুষ্ঠিত রওশন এরশাদের বৈঠক নিয়ে অপব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করছেন। এর আগেও পার্টির চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদের অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন, সরকারের সমালোচনাসহ বিভিন্ন বিষয়ে কথা বললে রওশন এরশাদ এর বিপরীতে বক্তব্য দিয়ে নিজ অবস্থান তুলে ধরেছিলেন। মঙ্গলবার নিজেকে পার্টির চেয়ারম্যান ঘোষণা করা ছাড়াও গত বছরের ৭ ডিসেম্বর একটি চিঠির মাধ্যমে জি এম কাদেরকে অব্যাহতি দেওয়ার কথা বলা হয়। এতে পার্টির চারজন কো-চেয়ারম্যান ও দুজন প্রেসিডিয়াম সদস্যের স্বাক্ষরের কথা বলা হলেও কো-চেয়ারম্যান কাজী ফিরোজ রশীদ, সৈয়দ আবু হোসেন বাবলাসহ উল্লিখিত নেতারা তা অস্বীকার করেছেন। জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান কাজী ফিরোজ রশীদ এ বিষয়ে বলেন, ‘এসব বিষয়ে আমরা কিছুই জানি না। নির্বাচন ঘনিয়ে এলেই এ ধরনের ষড়যন্ত্র হতে থাকে।’ তিনি বলেন, ‘আমরা তো জন্ম থেকেই জ্বলছি। এটি ফেস করে আসছি। সামনে নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসবে, সমস্যা আরও বাড়বে। এসব বিষয়ে আমরা সতর্ক আছি।’ জাতীয় পার্টির অপর কো-চেয়ারম্যান সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা বলেন, জি এম কাদের জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এ নিয়ে কোনো বিভ্রান্তির সুযোগ নেই। রওশন এরশাদ পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষক। আর যে চিঠির কথা বলা হচ্ছে তা ভুয়া। এ ধরনের কোনো চিঠিতে আমরা কোনো স্বাক্ষর করিনি।

ভারতে খোলামেলা কথা হয়েছে, অনুমতি ছাড়া বলতে পারব না : তিন দিনের ভারত সফর শেষে গতকাল সন্ধ্যায় দেশে ফিরে জাতীয় পার্টির (জাপা) চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ (জি এম) কাদের সাংবাদিকদের প্রশ্নে জবাবে বলেছেন, ভারতে খোলামেলা কথা হয়েছে, কিন্তু এগুলো অনুমতি ছাড়া বলতে পারব না।

হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে জি এম কাদের বলেন, ‘আমি ভারত সরকারের আমন্ত্রণে সেখানে গিয়েছিলাম। সেখানে বেশ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা হয়েছে। সেই আলোচনা কার সঙ্গে হয়েছে বা কী বিষয়ে হয়েছে- এ প্রসঙ্গে বিস্তারিত বলতে পারব না। কারণ আলাপগুলো ওইভাবেই হয়েছে। উনারা যদি কিছু প্রকাশ করতে চান করবেন, আমার পক্ষ থেকে উনাদের পারমিশন (অনুমতি) ছাড়া কিছু বলতে পারব না। তবে দ্বিপক্ষীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে।’

বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে খুব একটা আলোচনা হয়নি উল্লেখ করে জাপা চেয়ারম্যান বলেন, ‘তবে উনারা একটা ভালো নির্বাচন দেখতে চান। এটা সময়মতো যেন হয়। নির্বাচনের আগে-পরে কোনো ধরনের সহিংসতা বা সাধারণ মানুষের জীবনধারায় অনিশ্চিত কিছু যেন না হয়। এটা হলে উনারা খুশি হবেন। কারণ বাংলাদেশে ভারতের বিভিন্ন ধরনের বিনিয়োগ রয়েছে।’

জি এম কাদের আরও বলেন, ‘উনারা আশা প্রকাশ করেন যে, বাংলাদেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক থাকলে, বাংলাদেশ স্থিতিশীল থাকলে, সুন্দর নির্বাচনের মাধ্যমে পরবর্তী সরকার যদি গঠিত হয় তাহলে তাদের পক্ষে এসব কাজ করা সহজ হবে। উনারা প্রত্যাশা করেন, যেন সবাই মিলে ওই ধরনের একটা পরিবেশ সৃষ্টি করেন, যাতে সুন্দর নির্বাচন হয়। নির্বাচনে যেন সহিংসতা, অরাজকতার পরিস্থিতি না হয়।’

জাপা সম্পর্কে ভারতের ভালো ধারণা আছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমার কাছে ভালো লেগেছে যে জাতীয় পার্টি সম্পর্কে উনাদের ধারণা ভালো। পার্টিকে একটা সম্ভাবনাময় দল মনে করেন তারা। উনাদের আস্থা আছে যে জাতীয় পার্টির সঙ্গে তাদের সম্পর্ক সৌহার্দ্যপূর্ণ ছিল যা সবসময় থাকবে।’

জাপার চেয়ারম্যান পদ নিয়ে নানা ঘটনা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘বেগম রওশন এরশাদ আমার ভাবি। আমার বড় ভাইয়ের স্ত্রী। বড় ভাইকে বাবার মতো মনে করতাম আমরা। সেই হিসেবে বয়সে যাই হোক ভাবিকে আমরা মায়ের মতো দেখেছি। তার সঙ্গে আমার কোনো সময় দ্বন্দ্ব ছিল না। এখনো নেই। কিছু মানুষ উনার অসুস্থতার সুযোগ নিয়ে বিভিন্নভাবে কাগজপত্র সই করিয়ে নিচ্ছে, উনাকে দিয়ে বক্তব্য দেওয়ানো হচ্ছে। আমার জানামতে এগুলো উনি নিজের ইচ্ছায় বা জেনেশুনে করছেন না। এটা করার উদ্দেশ্য হলো জাতীয় পার্টিকে দুর্বল করা।’

সর্বশেষ খবর