শুক্রবার, ২৫ আগস্ট, ২০২৩ ০০:০০ টা

নারী কর কর্মকর্তাকে অপহরণ নির্যাতনের ভয়ংকর ১৮ ঘণ্টা

নিজস্ব প্রতিবেদক

ছয় মাস আগে পুরান ঢাকার ব্যবসায়ী ইলিয়াস খানকে বিয়ে করেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) যুগ্ম-কমিশনার মাসুমা খাতুন (৪৮)। তখন থেকে এক ধরনের টানাপোড়েন চলছিল সাবেক স্বামী হারুনের সঙ্গে। উভয়েই তখন রাজধানীর রমনা থানায় পৃথক সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। গত ১৭ আগস্ট ওই যুগ্ম-কমিশনারকে প্রায় ১৮ ঘণ্টা অপহরণের মামলাটি তদন্ত করছে রমনা থানা পুলিশ।

তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঘটনাটির সঙ্গে জড়িত হিসেবে ভুক্তভোগী মাসুমা খাতুন তার সাবেক ড্রাইভারকে অভিযুক্ত করেছেন। তবে তার বর্তমান স্বামী ইলিয়াস খান অভিযুক্ত করেছেন সাবেক স্বামীকে। ঘটনার দিবাগত রাত ৮টা ১৫ মিনিটে নিজের ব্যবহৃত মাইক্রোবাসে করে রাজধানীর মগবাজার থেকে সিদ্ধেশ্বরীর বাসায় ফিরছিলেন ওই নারী যুগ্ম-কমিশনার। ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ৯ নম্বর গেটে পৌঁছলে কয়েকজন মাইক্রোবাস থামিয়ে তার চালক আনোয়ারকে মারধর শুরু করেন। একপর্যায়ে গাড়ি থেকে চালককে নামিয়ে মাইক্রোবাসসহ মাসুমা খাতুনকে অপহরণ করেন তারা। অপহরণের পর প্রায় ১৮ ঘণ্টা কোনো খোঁজ ছিল না তার। পর দিন দুপুর ২টায় ভুক্তভোগী মাসুমা খাতুন কৌশলে একটি গাড়ি থেকে নেমে চিৎকার শুরু করলে স্থানীয় জনতা ঢাকার সবুজবাগ থেকে তাকে উদ্ধার করেন। পাশাপাশি তিন অপহরণকারীকে আটকও করা হয়। তবে তার সাবেক ড্রাইভার মাসুদ এখনো গ্রেফতার হননি। জানা গেছে, ওই ঘটনায় গ্রেফতার সাইফুল ইসলাম, আবু বক্কর সিদ্দিক ওরফে সাব্বির ও ইয়াছিন আরাফাত রাজুকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আদালত এক দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন। এখনো তাদের রিমান্ডে আনা হয়নি। আজ শুক্রবার তাদের রিমান্ডে আনার কথা রয়েছে। গত ১৯ আগস্ট ওই নারী যুগ্ম-কমিশনার রমনা থানায় চারজনের নাম উল্লেখ করে অপহরণ মামলা করেন। মামলার প্রধান আসামি করা হয়েছে তার সাবেক ড্রাইভার মাসুদকে। মাসুদ চলতি বছরের জুলাইয়ে তার গাড়ির চালক ছিলেন। গত ১ আগস্ট তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়। মামলায় ওই নারী বলেছেন, অপহরণ করে অজ্ঞাত বিভিন্ন স্থানে নিয়ে আসামিরা শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করে তার বাম পা ভেঙে ফেলে, মাথায় ও চোখে আঘাত করে গুরুতর আহত করে। এ ছাড়া বিভিন্ন জায়গায় নীলা ফুলা জখম করে। আসামিরা গাড়িতে থাকাবস্থায় তার কাছে ৫০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। তার কাছে থাকা নগদ ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা এবং একটি মোবাইলফোন নিয়ে নেয়। মুক্তিপণের বাকি টাকা না দিলে তাকে হত্যার পর বস্তাবন্দি করে পানিতে ফেলে দেওয়ার হুমকি দেয়। পরে অজ্ঞাত একটি গ্যারেজে গাড়ির মধ্যে তাকে আটকে রাখে। পর দিন ১৮ আগস্ট তাকে মেরে ফেলার জন্য অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যায়। সাইফুল, আবু বক্কর ও ইয়াছিনকে পাহারায় রেখে মাসুদ খাবার কিনতে যায়। এ সুযোগে তিনি গাড়ি থেকে নেমে ‘বাঁচাও, বাঁচাও’ বলে চিৎকার করলে আশপাশের লোকজন এসে তাকে উদ্ধার করে। আর তার পাহারায় থাকা তিনজনকে আটক করে সবুজবাগ থানায় সোপর্দ করে। পরে তিনি জানতে পারেন- তাকে সবুজবাগের নন্দিপাড়া ৬ নম্বর রোডে কবরস্থানের পাশে আটকে রাখা হয়েছিল। পুলিশ বলছে, ভুক্তভোগী ওই যুগ্ম-কমিশনারের (ট্যাক্স) নাম মাসুমা খাতুন। তিনি এনবিআর-এর কর অঞ্চল-২-এ কর্মরত। উদ্ধারের পর পুলিশ ওই নারীকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে ভর্তি করে। পরে তাকে নেওয়া হয় মগবাজারের একটি হাসপাতালে। আঘাত গুরুতর হওয়ায় পরে অন্য একটি বেসরকারি হাসপাতালে পাঠানো হয়। এখন তিনি গ্রিন রোডের একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে গতকাল বাসায় ফেরেন বলে জানা গেছে।

রমনা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল হাসান জানান, ওই নারীর অভিযোগের প্রাথমিক তদন্তে এর সত্যতা মিলেছে। মূল আসামি মাসুদ গ্রেফতার হলে রহস্য বেরিয়ে আসবে। এ ছাড়া গ্রেফতার তিনজনকে রিমান্ডে নিয়ে এলে অনেক কিছু জানা যাবে। ওই নারীর পারিবারিক সূত্র জানায়, গাড়িচালক মাসুদকে চাকরিচ্যুত করার কারণে এমন ঘটনা ঘটেছে, সেটি বিশ্বাসযোগ্য নয়। যেভাবে তাকে মারধর করেছে, হত্যার চেষ্টা করেছে- এর পেছনে অন্য কোনো কারণ থাকতে পারে। এ ঘটনার পেছনে মাসুমা খাতুন ও তার সাবেক স্বামীর সঙ্গে ব্যক্তিগত কোনো বিরোধও থাকতে পারে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হারুন নামে এনবিআরের অবসরপ্রাপ্ত এক শীর্ষ কর্মকর্তার সঙ্গে ৬ মাস আগে বিচ্ছেদ হয় মাসুমা খাতুনের। এরপর বিয়ে করেন ব্যবসায়ী ইলিয়াসকে। সিদ্ধেশ্বরীতে একটি ভবনে পাশাপাশি দুটি ফ্ল্যাট তাদের ছিল। একটি ছিল তাদের মেয়ের নামে, অপরটি ভুক্তভোগী ওই নারীর নামে। মেয়ের নামে থাকা ফ্ল্যাটে থাকতেন ওই নারীর সাবেক স্বামী। আর নিজের নামে থাকা ফ্ল্যাটে বর্তমান স্বামীকে নিয়ে থাকা শুরু করেন ওই নারী। এ নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে এক ধরনের বিরোধ দেখা দেয়। উভয়েই রমনা থানায় এ নিয়ে জিডিও করেন। পরে বাধ্য হয়ে ওই নারীর সাবেক স্বামী অন্যত্র বাসা নিয়ে বসবাস করতে থাকেন।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা রমনা থানার এসআই সহিদুল ওসমান মাসুম বলেন, মামলাটির তদন্ত চলছে, একই সঙ্গে মাসুদকে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। সে গ্রেফতার হলে পেছনের অনেক কিছুই বেরিয়ে আসবে।

সর্বশেষ খবর