মঙ্গলবার, ২৯ আগস্ট, ২০২৩ ০০:০০ টা

ডিসিদের কাঁধে ভোটের বোঝা

♦ মাঠ প্রশাসনে অজানা উদ্বেগ ♦ রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবে অভিজ্ঞতা নেই ♦ মনস্তাত্ত্বিক চাপ অনুভব করছেন অনেক ডিসি ♦ দক্ষ কর্মকর্তা, চাপ সামলানোর অভিজ্ঞতা আছে : প্রতিমন্ত্রী

ওয়াজেদ হীরা

ডিসিদের কাঁধে ভোটের বোঝা

জাতীয় নির্বাচন ও ভোট নিয়ে বাড়ছে নানা উদ্বেগ। এতে মাঠপ্রশাসনের কর্মকর্তারা বাদ যাচ্ছেন না। আগামীর নির্বাচনে মাঠপর্যায়ে ডিসিরা থাকবেন রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবে, যাদের জাতীয় নির্বাচনে রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবে পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই। সেই সঙ্গে রাজনৈতিক সমঝোতা হবে কি না সে বিষয়েও রয়েছে অনিশ্চয়তা। এর বাইরে বিভিন্ন দেশের চাপ রয়েছে নির্বাচন নিয়ে। সব মিলিয়ে ডিসিদের ঘাড়ে বাড়তি চাপ এই জাতীয় নির্বাচন। তবে মাঠ প্রশাসনে কাজের অভিজ্ঞতা থাকায় এটি সামলে উঠবেন এমনটাই বলছেন সংশ্লিষ্টরা। যদিও অভিজ্ঞ সিনিয়রদের কাছে পূর্ব অভিজ্ঞতা জানতে অনেক ডিসি ফোন করে যোগাযোগও করছেন। সেই সঙ্গে খোঁজ রাখছেন দেশের সার্বিক পরিস্থিতির ওপর।

সংবিধান অনুযায়ী চলতি বছর নভেম্বর থেকে ২০২৪ সালের জানুয়ারির মধ্যে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে হবে ইসিকে।

একাধিক সূত্রে জানা গেছে, নির্বাচন কমিশনের অত জনবল না থাকায় জনপ্রশাসনের কর্মকর্তাদের নিয়েই সেই কাজটি সারা হয়। রাজনৈতিক পরিস্থিতি দেখে ২০১৮ আর এবারের নির্বাচনের মধ্যে পার্থক্য থাকবে বলে মনে করছেন মাঠ প্রশাসনের অনেক কর্মকর্তা। নির্বাচনের কয়েক মাস আগে দায়িত্ব পেয়ে খুশির চেয়ে বেশ চিন্তিত কেউ কেউ। কেউ এবারের দায়িত্বে অন্যবারের চেয়ে চাপ বেশি অনুভব করছেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা বিভাগের একটি জেলার এক ডিসি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘সত্যি বলতে ডিসি হয়েছি এটা যেমন খুশির, তবে একটা চাপও অনুভব করছি। কী হতে যাচ্ছে নির্বাচন নিয়ে বুঝতে পারছি না এখনো। নির্বাচন কমিশনের গাইড লাইন মানব। তবে দেখুন, অবস্থাটা মাঠে কিন্তু আমাকেই সামলাতে হবে।’ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের এক ডিসি বলেন, ‘ভোটের সময় আমরা বলির পাঁঠা বলতে পারেন। কষ্ট করে ঘুম হারাম করে কাজ করি। হেরে যাওয়া দল বলবে দালালি করেছে। আর ভোটে কোনো কেন্দ্রে একটু গণ্ডগোল হলে সব দলই নানা অভিযোগ তুলবে। মানসিক স্বস্তিটা কম অনুভব করছি, কাউকে বলতেও পারছি না। তবে এমনিতে কোনো সমস্যা নেই। সরকারের গাইডলাইন মেনে কাজ করছি।’ ডিসি হিসেবে আছেন ২৪, ২৫ ও ২৭ ব্যাচের কর্মকর্তারা। কমপক্ষে ১০ জন ডিসির সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ভোটের পরিস্থিতি নিয়ে তারা কিছুটা চিন্তিতই বলা চলে। পরোক্ষভাবে কূটনৈতিক চাপের কথাও উল্লেখ করেন তারা। চট্টগ্রাম বিভাগের একটি জেলার এক ডিসি বলেন, “সরকারি চাকরি করি। তবে ডিসি হলে রাজনৈতিকভাবে রং লাগিয়ে দেখা হয়। ডিসি হয়েছি মানে সরকারের ‘গুডবুকে’ আছি এটা সবাই ভেবেই নেয়।” রংপুর বিভাগের এক ডিসি বলেন, ‘অন্য সময় দায়িত্ব পালন আর নির্বাচনের সময়কার দায়িত্ব একভাবে দেখা যাবে না। এটা জাতীয় নির্বাচন। এখন দায়িত্ব অনেক চ্যালেঞ্জিং।’ তবে কয়েকটি জেলার ডিসিরা এটিও জানান, সরকারের গাইডলাইন মেনে কাজ করবেন তারা। তারা বলেন, ‘বাড়তি চাপের কী আছে, সরকার যোগ্য মনে করেছে, ফিটলিস্ট করে সঠিক মনে করে দায়িত্ব দিয়েছে।’ আরেক ডিসি বলেন, ‘চাপ তো থাকবেই। পদটাই তো চাপের। সরকার গাড়ি দিয়েছে, নিরাপত্তা দিয়েছে। আমাকে এসব সামলেই চলতে হবে।’

নির্বাচনে ডিসিদের দায়িত্ব বাড়তি চাপ- এ বিষয়ে জানতে চাইলে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আসলে যারা ডিসি হয়েছেন তারা এসিল্যান্ড ছিলেন, ইউএনও ছিলেন। তারা মাঠপর্যায়ে কাজ করেছেন। বিভিন্ন সময় পরিস্থিতি সামলেই কিন্তু তারা এসেছেন। এই ডিসিরা কিন্তু ২০১৮-এর নির্বাচন বা অন্য নির্বাচনেও কাজ করেছেন সিনিয়রদের সঙ্গে। একটা নির্বাচন কেমন হয়, জাতীয় নির্বাচন বা স্থানীয় নির্বাচন কেমন হয়, কী কী বিষয় থাকে সে অভিজ্ঞতা কিন্তু আছে। প্রশাসনের একা চাপ নিতে হয় তা কিন্তু নয়। ডিসিদের এসব ম্যানেজ করে নিতে হয়। তবে যাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তারা ভালো কর্মকর্তা, কাজে যথেষ্ট মনোযোগী।’ জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘এখানে কোনো চাপের বিষয় নেই। সব জায়গায় দায়িত্ব পালনকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীরা জনগণের সেবক হিসেবে কাজ করেন। তারা দক্ষ কর্মকর্তা। সব সামলে চলতে পারবেন বলেই মনে করি। পুলিশ করবে পুলিশের কাজ আর প্রশাসন করবে প্রশাসনের। সবার দায়িত্ব আলাদা। ডিসিরা মুখ্য সমন্বয়ক হিসেবে কাজ করবেন। তাদের নির্বাচনে নির্বাচন কমিশন গাইডলাইন দেবে। মাঠ প্রশাসনে বিভাগীয় কমিশনাররা আছেন। ডিসি কখনো একা নন, তিনি টিমের একজন সদস্য।’

মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সাবেক সচিব মোহাম্মদ মোশাররাফ হোসাইন ভূইঞা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, মানসিক চাপ থাকতে পারে। যারা প্রশাসন বা পুলিশে যোগ দিয়েছেন তারা মানসিক প্রস্তুতি নিয়েই যোগ দিয়েছেন। একেকটা নির্বাচন একেক রকম। মাঠ প্রশাসনে দুশ্চিন্তা থাকতেই পারে। তবে মাঠ পর্যায়ে যারা কাজ করেন তাদের এসব নিয়ে ভাবা উচিত নয়। যে কোনো পরিস্থিতিতে কাজ করার মতো মানসিক শক্তি তাদের থাকা উচিত। তিনি বলেন, ‘মানসিক চাপ থাকলে তা যেন মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তারা কাটিয়ে উঠতে পারেন নির্বাচন কমিশনের নির্দেশনা থাকা উচিত। আর রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে যারা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার তারা করুন, ডিসিদের চিন্তার দরকার নেই।’ জানা গেছে, নির্বাচন পরিচালনার সব দায়িত্ব রিটার্নিং কর্মকর্তার। তার অধীনেই হয় আইনশৃঙ্খলাসহ ভোটের যাবতীয় কার্যক্রম। নির্বাচন পরিচালনা বিধিমালা ও আচরণবিধি অনুযায়ী কাজ করেন রিটার্নিং অফিসার। ইসির তত্ত্বাবধান, নির্দেশনা ও নিয়ন্ত্রণ সাপেক্ষে রিটার্নিং অফিসার নির্বাচন পরিচালনার সব কাজ তত্ত্বাবধান করবেন। আর ইসি নিজের ওপর অর্পিত দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করবে। ডিসিদের সঙ্গে সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবে ইউএনওরা থাকেন। গত নির্বাচনে কয়েকটি সংসদীয় আসনে ইউএনওর পাশাপাশি কয়েকজন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক, সহকারী কমিশনার (ভূমি), স্থানীয় সরকার বিভাগের উপ-পরিচালক ও থানা নির্বাচন কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। আর রিটার্নিং কর্মকর্তাকে সহায়তা করার জন্য সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা তো আছেনই।

একাদশ সংসদ নির্বাচনে মহানগরগুলো বাদে জেলাগুলোতে রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্ব ডিসিরাই পালন করেছেন। ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরের সংসদীয় আসনগুলোতে এই দুই বিভাগের বিভাগীয় কমিশনাররা রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্বে ছিলেন। সর্বশেষ ডিসি সম্মেলনে লিখিত এজেন্ডা না থাকলেও দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের বিষয়টি আলোচনায় ছিল।

 

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর