মঙ্গলবার, ২৯ আগস্ট, ২০২৩ ০০:০০ টা

তারেকের বক্তব্য অনলাইন থেকে সরানোর নির্দেশ

আইনজীবীদের হট্টগোল, সাড়ে তিন ঘণ্টা বিচার বন্ধ

নিজস্ব প্রতিবেদক

বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সাম্প্রতিক দেওয়া সব বক্তব্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ সব ধরনের অনলাইন প্ল্যাটফরম থেকে সরাতে বিটিআরসিকে নির্দেশ দিয়েছেন হাই কোর্ট। গতকাল বিচারপতি মো. খসরুজ্জামান ও বিচারপতি মো. খায়রুল আলমের সমন্বয়ে গঠিত হাই কোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেন।

এদিকে এ আদেশ কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি সমর্থক আইনজীবীদের তর্ক, হইচই ও হট্টগোলের মধ্যে একপর্যায়ে এজলাস ত্যাগ করেন বেঞ্চের দুই বিচারপতি। বিচারকাজ বন্ধ থাকে সাড়ে ৩ ঘণ্টার বেশি। দুপুর ২টা ৩৫ মিনিটে দুই বিচারপতি এজলাসে ফিরলে ওই আদালতের স্বাভাবিক কার্যক্রম শুরু হয়। আইনের দৃষ্টিতে পলাতক অবস্থায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বক্তব্য ও বিবৃতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক ও ইউটিউব থেকে সরাতে বিটিআরসিকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে রিট আবেদনকারীর আবেদন মঞ্জুরের পর এ ঘটনা ঘটে। এর আগে সকাল সাড়ে ১০টার দিকে বিচারপতি মো. খসরুজ্জামান ও বিচারপতি মো. খায়রুল আলমের সমন্বয়ে গঠিত হাই কোর্ট বেঞ্চ আবেদনটি মঞ্জুর করে আদেশ দেন। এরপর আদালতে উপস্থিত হয়ে এ নিয়ে আপত্তি জানান বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা। ১০টা ৪০ মিনিটের দিকে বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা আদালতের উদ্দেশে বলেন, ‘প্রধান বিচারপতির কাছে অন্য আদালতে এ-সংক্রান্ত রিটটি বদলির জন্য রবিবার আবেদন জমা দেওয়া হয়েছে। এ অবস্থায় আদেশ দেওয়া সমীচীন নয়। আবেদনটি (তারেকের বক্তব্য সরাতে করা) নথিভুক্ত রাখেন। অপেক্ষা করুন।’ এরপর আবেদন মঞ্জুর করা নিয়ে আবার আপত্তি জানাতে শুরু করেন বিএনপিপন্থি কয়েকজন আইনজীবী। তখন আদালত বলেন, ‘আপনাদের সবার বলা শেষ হলে কিছু বলব।’ এ সময় বিএনপিপন্থি একজন আইনজীবী বলেন, ‘ইটস লাইক আ গেম শো।’ আদালত বলেন, ‘আমরা একটু বলি।’ তখন বিএনপিপন্থি একাধিক আইনজীবী বলেন, ‘না, মাই লর্ড।’

একপর্যায়ে বেঞ্চের নেতৃত্বদানকারী বিচারপতির উদ্দেশে বিএনপিপন্থি এক আইনজীবী বলেন, ‘আমরা না বললে মানুষ ভুল বুঝবে।’ তখন আদালত বলেন, ‘ভুল বুঝবে না। প্রধান বিচারপতির কাছে দেওয়া আবেদন সম্পর্কে আপনি অবহিত নন? দরখাস্তটি আপনি দেখবেন না, অথচ আবেদন সম্পর্কে আপনি অবগত!’

এর একপর্যায়ে হইচই শুরু হয়। আদালত বলেন, ‘আপনাদের বলা শেষ হলে আমরা বলব।’ বেঞ্চের নেতৃত্বদানকারী বিচারপতিকে উদ্দেশ করে বিএনপিপন্থি এক আইনজীবী বলেন, ‘আপনাকে বলতে হবে যে আপনি দরখাস্ত সম্পর্কে জানেন কি না? আপনি বলে দেন আমরা যা-ই বলি না কেন, আপনি রায় দেবেন। তাহলে আমরা এখানে দাঁড়াব না। মিডিয়ায় যাব।’ একপর্যায়ে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, তারা মিডিয়া ট্রায়াল চাচ্ছেন।

আদালত বলেন, ‘আদেশ দেওয়ার আগে যদি আপনারা একটু বলতেন।’ এ সময় উচ্চৈঃস্বরে বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা বলেন, ‘বলা হয়েছে। বলা হয়েছে। কোর্টের সামনে পুলিশ মোতায়েন করা রয়েছে।’ এ সময় একাধিক আইন কর্মকর্তা বলেন, ‘এটি কোর্ট, এখানে শাউটিং করা যাবে না।’ তখন বিএনপিপন্থি একজন আইনজীবী বলেন, ‘হু ইজ হি?’ এর পরপরই আবার শুরু হয় হইচই, হট্টগোল।

একপর্যায়ে আদালত বলেন, ‘আদেশ দেওয়া হয়েছে, সংক্ষুব্ধ হলে আপনারা আপিল বিভাগে যেতে পারেন।’ এ সময় বিচারপতিকে উদ্দেশ করে বিএনপিপন্থি একাধিক আইনজীবী বলেন, ‘আপনি বায়াস, আপনার প্রতি আস্থা নেই।’ তখন বিচারকের উদ্দেশে একজন আইন কর্মকর্তা বলেন, ‘আপনার থেকে কেউ জোর করে আদেশ নিতে পারবে না।’ তাঁকে উদ্দেশ করে বিএনপিপন্থি একাধিক আইনজীবী উচ্চৈঃস্বরে বলেন, ‘এই চুপ, চুপ।’ তখন বিচারকদের উদ্দেশে ওই আইন কর্মকর্তা বলেন, ‘আপনারা আপনাদের মতো করে কোর্ট চালাবেন। ক্রমানুসারে মামলা ডাকা হোক।’ এ নিয়ে একপর্যায়ে দুই পক্ষের মধ্যে তর্ক, তুমুল হইচই ও হট্টগোল শুরু হয়।

একপর্যায়ে আদালত বলেন, ‘আমরা আদেশ দিয়েছি। এখন নিয়মিত আইটেমে (কার্যতালিকায় থাকা অন্য মামলা) যাই।’ এতে আপত্তি জানিয়ে বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা ‘নো’ ‘নো’ বলতে থাকেন। ‘রিটটি কার্যতালিকা থেকে বাদ দেন। আদেশ প্রত্যাহার করেন।’ বিচারপতির উদ্দেশে বিএনপিপন্থি একজন আইনজীবী বলেন, ‘আপনি অ্যানার্কি তৈরি করছেন জুডিশিয়ারিতে।’ এতে আপত্তি জানান একাধিক আইন কর্মকর্তা। বিএনপিপন্থি আইনজীবীদের কয়েকজন ‘শেইম’ ‘শেইম’ বলেন। এ সময় দুই পক্ষের মধ্য তর্ক ও হইচই হয়। এর একপর্যায়ে ১০টা ৫৫ মিনিটের দিকে এজলাস ত্যাগ করেন দুই বিচারপতি। এ সময় বিচারপতির দিকে একজন আইনজীবী কার্যতালিকা ছুড়ে মারেন। দুপুর সোয়া ১টা পর্যন্ত আদালত কক্ষে বসে ছিলেন বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা। এজলাসে বসে তাঁরা শিঙ্গাড়াও খেয়েছেন। এসব এজলাসের বাইরে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়। দুপুর ২টা ৩৫ মিনিটে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে এজলাসে ওঠেন দুই বিচারপতি।

আদালতে রিট আবেদনকারীর পক্ষে ছিলেন আইনজীবী কামরুল ইসলাম ও সানজিদা খানম। বিএনপিপন্থি আইনজীবী কায়সার কামাল, এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন, এম বদরুদ্দোজা, মো. রুহুল কুদ্দুস, গাজী কামরুল ইসলাম প্রমুখ কথা বলেন। অন্যদিকে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বিপুল বাগমার ও কামরুল হক খান, সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল এস আর সিদ্দিকী সাইফ প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

এক রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৫ সালের ৭ জানুয়ারি তারেক রহমানের বক্তব্য গণমাধ্যমে প্রচারের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেন হাই কোর্ট। একই সঙ্গে রুল জারি করেন। রুলে তারেক রহমানের বক্তব্য প্রকাশ ও প্রচার নিষিদ্ধ করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে কেন বিবাদীদের নির্দেশ দেওয়া হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়। ওই রুল শুনানির জন্য আট বছর পর হাই কোর্টে আবেদন জানায় রিটকারী পক্ষ। কিন্তু তারেক রহমানের ঠিকানা ভুল থাকায় নোটিস সঠিকভাবে জারি হয়নি। এ কারণে ঠিকানা সংশোধন করে ফের আবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন হাই কোর্ট। ওই নির্দেশনা মোতাবেক তারেক রহমানের ঠিকানা সংশোধন করে নোটিস জারির নির্দেশ দেন আদালত। এর পরই গত সপ্তাহে নোটিস জারি করা হয়।

সর্বশেষ খবর