বৃহস্পতিবার, ৩১ আগস্ট, ২০২৩ ০০:০০ টা

চীনের কত বিনিয়োগ বাংলাদেশে

লাখ কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ ২৫ প্রকল্পে

মানিক মুনতাসির

বাংলাদেশের বাজারে ব্যবসা ও বিনিয়োগে চীনের আধিপত্য বাড়ছে। ছোট-বড়-মাঝারি মিলিয়ে অন্তত ২৫টি প্রকল্প চলমান রয়েছে। এ ধরনের নয়টি বৃহৎ প্রকল্পেই চীনের বিনিয়োগ ৮ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার; যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ১ লাখ কোটি টাকার বেশি। এর প্রায় ৭০ শতাংশই হয়েছে বিআরআইয়ের (বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ) আওতায়। বাংলাদেশে বিনিয়োগকারী একক দেশ হিসেবে চীনের অবস্থান দ্বিতীয়। প্রথম জাপান। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। এসব প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে- পদ্মা সেতুতে রেলসংযোগ, কর্ণফুলী টানেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, বাঁশখালী বিদ্যুৎ কেন্দ্র, পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্র, ন্যাশনাল ডেটা সেন্টার অ্যান্ড পাওয়ার গ্রিড নেটওয়ার্ক, ঢাকেশ্বরী স্যুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্লান্ট, ডেভেলপমেন্ট অব আইসিটি ইন্ট্রা নেটওয়ার্ক ফর ফেজ-২৫, অষ্টম বাংলাদেশ-চায়না ফ্রেন্ডশিপ ব্রিজ। এ ছাড়া যোগাযোগ, প্রযুক্তি, বিদ্যুৎ-জ্বালানি ও শিক্ষা খাতের আরও অনেক প্রকল্পে বিনিয়োগ করছে চীন।

সূত্র জানান, চীনা ঋণে নেওয়া নয় প্রকল্পের মধ্যে সবশেষ প্রকল্পটি ২০২৬ সালের মাঝামাঝি শেষ হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ২০১৬ সালে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিংয়ের বাংলাদেশ সফরকালে ২০ বিলিয়ন ডলার খরচে ২৭টি প্রকল্প নিয়ে ‘বিনিয়োগ ও উৎপাদন সক্ষমতা সহযোগিতা জোরদারকরণ’ সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। এর অংশ হিসেবে এখন পর্যন্ত ২৫টি প্রকল্পে ঋণ দিয়েছে; একই সঙ্গে কিছু অনুদানও দিয়েছে চীন।

অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের তথ্যানুযায়ী, স্বাধীনতার পর থেকে ২০২১-২২ অর্থবছর পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন খাতে ঋণ ও অনুদান হিসেবে মোট ১ হাজার ৭৭ কোটি ডলারের বেশি অর্থ বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে চীন। এর মধ্যে প্রায় ৬৯৪ কোটি ডলার ছাড় হয়েছে। অনুদান হিসেবে এসেছে খুব সামান্য। সিংহভাগই ঋণ। এসব ঋণের বেশির ভাগই এসেছে গত দুই দশকে।

বিশ্লেষকদের মতে, বিশ্ব অর্থনীতি ও রাজনীতিতে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে চলছে এক ধরনের স্নায়ুযুদ্ধ। ভবিষ্যতে তারা যুক্তরাষ্ট্রের জায়গাটা দখলের স্বপ্ন দেখে। তবে সেটা করতে গেলে তাদের মিত্র জোগাড় করতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র রাষ্ট্র হলো ইউরোপের বিভিন্ন দেশ। ঠিক সেভাবেই এশিয়া, আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকার অপেক্ষাকৃত গরিব ও কম শক্তিশালী দেশগুলোকে অর্থনৈতিক সাহায্য দিয়ে চীন তাদের নিজের শিবিরে টানার চেষ্টা করছে। এর অংশ হিসেবে সারা বিশ্বে প্রভাব বিস্তার করতে চীন ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ নামক প্রকল্প হাতে এগিয়ে চলেছে। এ প্রকল্পের সঙ্গে ইতোমধ্যে পৃথিবীর অন্তত ৬৮টি দেশ যুক্ত হয়েছে। প্রকল্পটি শেষ হবে ২০৪৯ সালে।

এ প্রসঙ্গে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘চীন আমাদের অন্য দেশের মতো একটি উন্নয়ন সহযোগী। তবে চীন আমাদের পুরনো বন্ধুও। সেই স্বাধীনতার সময় থেকেই চীন আমাদের বন্ধুদেশ। বিশ্বায়নের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় চীন আমাদের প্রযুক্তিগতভাবেও সহযোগিতা দিয়ে আসছে।’

চীনের বিশাল এই বিনিয়োগ সম্ভাবনা কাজে লাগিয়ে এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে পারলে বাংলাদেশকে এক অনন্য সুবিধা এনে দেওয়া সম্ভব হবে বলে মনে করেন চায়না-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্সের মুখপাত্র আল মামুন মৃধা। তিনি বলেন, ‘এখানে চীনা বিনিয়োগের যে প্রবাহ তা ধরে রাখতে পারলে বাংলাদেশ অচিরেই শক্তিশালী অর্থনীতির দেশ হিসেবে বিকাশ ঘটাতে পারবে। আর চীনা প্রযুক্তি স্থানান্তরের মাধ্যমে বাংলাদেশ প্রযুক্তি খাতেও এগিয়ে যাবে। এ বিশ্বে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের প্রধান হাতিয়ারই হলো প্রযুক্তি। ফলে আগামী এক দশকে যারা প্রযুক্তিগতভাবে শক্তিধর হবে তারাই বিশ্ব শাসন করবে। আর এখানে চীন আগে থেকেই এগিয়ে আছে। এজন্য এখন পর্যন্ত ১ হাজার বিলিয়ন ডলারের বেশি ব্যয় করেছে চীন।’

সূত্র জানান, বিদ্যুৎ, জ্বালানিসহ দেশের বিভিন্ন খাতে সরকারি-বেসরকারিভাবে বাস্তবায়নাধীন এমন আরও বেশকিছু মেগা প্রকল্পে এখন চীনের বিনিয়োগ রয়েছে। অবশ্য অর্থনীতির পর্যবেক্ষকরা বলছেন, বাস্তবায়ন শেষে প্রকল্পগুলোর ঋণের কিস্তি পরিশোধ শুরু হলে বাংলাদেশ বেশ চাপে পড়বে। কেননা আগামী চার বছরের মধ্যে বিদেশি ঋণ পরিশোধের বোঝা বেড়ে যাবে অনেক গুণ।

জানা গেছে, চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে বেসরকারি উদ্যোগে ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট সক্ষমতার একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে প্রায় ২৪৯ কোটি ডলার। এর মধ্যে প্রায় ১৭৬ কোটি ডলারের ঋণ অর্থায়ন হয়েছে চীনা উৎস থেকে। অর্থায়ন করছে চায়না ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক, ব্যাংক অব চায়না ও চায়না কনস্ট্রাকশন ব্যাংক। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ছাড়াও সড়ক যোগাযোগ, রেলওয়ে ও সেতু নির্মাণ খাতের বড় প্রকল্পগুলোয়ও বিপুল পরিমাণ চীনা বিনিয়োগ রয়েছে। এরই একটি পদ্মা সেতু রেলসংযোগ প্রকল্প। ইআরডি জানিয়েছে, প্রকল্পটিতে চীনা ঋণ প্রায় ২৬৭ কোটি ডলার। এ প্রকল্পে প্রধান অর্থায়নকারী চায়না এক্সিম ব্যাংক। উদ্বোধনের অপেক্ষায় রয়েছে চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত বঙ্গবন্ধু টানেল। এটি নির্মাণে অর্থায়নের বড় অংশ এসেছে চীনের এক্সিম ব্যাংক থেকে। ২০ বছর মেয়াদি ঋণের পরিমাণ ৭০ কোটি ডলারের বেশি। ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণে প্রায় ১১৩ কোটি ডলার ঋণ নেওয়া হয়েছে চীন থেকে। প্রিফারেনশিয়াল বায়ার্স ক্রেডিটের (পিবিসি) আওতায় চীনা এক্সিম ব্যাংকের অর্থায়নে বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পটির ঋণের অর্থ পাঁচ বছরের রেয়াতকালসহ ২ শতাংশ সুদে ২০ বছরের মধ্যে শোধ করতে হবে।

এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) তথ্যানুযায়ী, ২০১৯ সালের ডিসেম্বরের আগের দুই বছরে দেশে বিভিন্ন প্রকল্পে ১০ কোটি ডলারের বেশি অর্থায়ন করেছে সাতটি বিদেশি প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে শীর্ষ পাঁচটিই ছিল চীনের। ওই দুই বছরে ব্যাংক অব চায়না, এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট ব্যাংক অব চায়না (চায়না এক্সিম ব্যাংক), চায়না কনস্ট্রাকশন ব্যাংক- এ তিন ব্যাংকের প্রতিটি বাংলাদেশি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দিয়েছে ৫৯ কোটি ডলারের কিছু বেশি। এক্সিম ব্যাংক অব চায়না ঋণ দিয়েছে ৪৬ কোটি ১০ লাখ ডলার। ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড কমার্শিয়াল ব্যাংক অব চায়নার কাছ থেকে বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়েছে ৪০ কোটি ডলার।

পায়রা কয়লাবিদ্যুৎ কেন্দ্র নিয়ে এরই মধ্যে তৈরি হয়েছে বিপত্তি। চায়না ন্যাশনাল মেশিনারি ইমপোর্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট করপোরেশন (সিএমসি) এবং বাংলাদেশের রাষ্ট্রমালিকানাধীন নর্থ ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি লিমিটেডের (এনডব্লিউপিজিসিএল) যৌথ উদ্যোগে নির্মিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি পরিচালনা করছে বাংলাদেশ-চায়না পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (বিসিপিসিএল)। এটি নির্মাণে ব্যয় হয়েছে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা। নির্মাণ ব্যয়ের প্রায় ৮০ শতাংশ ঋণ হিসেবে দিয়েছে চীনের এক্সিম ব্যাংক ও চায়না ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক। পায়রা আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তির কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু হয় ২০২০ সালের মে মাসে। একই বছরের অক্টোবরে দ্বিতীয় ইউনিট বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু করে। গত বছর সংকটপূর্ণ পরিস্থিতিতে জ্বালানি তেল ও গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো বন্ধ হতে থাকলে পায়রার ওপর নির্ভরতা বাড়তে থাকে। বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, দেশের দক্ষিণাঞ্চলের বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থায় বৃহৎ কেন্দ্রটির বড় ভূমিকা রয়েছে।

এ প্রসঙ্গে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘চীন বৈশ্বিকভাবে এখন অধিক শক্তিশালী দেশ। সেটা অর্থনৈতিকভাবে যেমন, তেমন পরাশক্তিতেও। আর প্রযুক্তিতে তো চীনকে এখন টপকে যাওয়ার মতো দেশ নেই বললেই চলে। একটা সময় হয়তো এই চীনই বিশ্ব শাসন করবে। আর সে সময়টা হয়তো আর খুব দূরে নয়।’

 

সর্বশেষ খবর