শনিবার, ২ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা
মামলার খড়গ ১

পুলিশের তদন্তে অভিযুক্ত পুলিশের তদন্তেই নির্দোষ

মাহবুব মমতাজী

পুলিশের তদন্তে অভিযুক্ত পুলিশের তদন্তেই নির্দোষ

পুলিশের চার্জশিটে আসামি হয়েই গ্রেফতার। পুলিশেরই আরেক তদন্তে একই ঘটনায় অভিযোগের মেলেনি কোনো সত্যতা। ততদিনে মামলা আদালতে বিচারাধীন। আদালতে বিচার শুরুর আগে ভুক্তভোগীরা সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ঊর্ধ্বতনদের কাছে অভিযোগ করেও মামলার খড়গ থেকে রেহাই পাননি।

২০১৩ সালের ১২ নভেম্বর বিএনপির ডাকা হরতাল কর্মসূচিতে গাড়ি পোড়ানোর ঘটনায় পল্টন থানায় করা চারটি মামলার চার্জশিটে বিএনপি নেতা-কর্মীদের সঙ্গে আবদুল মালেক মালু নামে এক ব্যক্তিকে অভিযুক্ত করা হয়। এসব মামলায় গ্রেফতার হয়ে ওই ব্যক্তি ১৮ দিন জেলও খাটেন। অথচ তিনি ডেমরার তৎকালীন সারুলিয়া ইউনিয়নের যুবলীগের সহসভাপতি ছিলেন।

তার বিরুদ্ধে করা মামলাগুলোর মধ্যে একটি মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে এবং তিনটি চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে বিচারাধীন।

এ বিষয়ে কথা হয় সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) নূর মোহাম্মদের সঙ্গে। তিনি বলেন, যে কোনো মামলার এজাহার হয় প্রাথমিক তথ্যের ভিত্তিতে। এরপর তদন্তে এজাহারের বাইরেও কিছু পাওয়া গেলে তা চার্জশিটে অন্তর্ভুক্ত করা হয়ে থাকে। আর এখানে যা হয়েছে, তা হলো- পুলিশের গাফিলতি ছিল, না হয় অসৎ উদ্দেশ্য ছিল। পুলিশের পরবর্তী তদন্তে জড়িত যেসব পুলিশ কর্মকর্তার নাম এসেছে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। যেহেতু মামলাটি আদালতে চলে গেছে তাই সেটি আদালতের এখতিয়ারের মধ্যে পড়েছে। তবে সাক্ষ্য-প্রমাণ উপস্থাপনের সময় পরবর্তী তদন্ত প্রতিবেদনের বিষয়টি অবহিত করে সেই নিরপরাধ ব্যক্তি রেহাই পেতে পারেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আবদুল মালেক মালুর বিরুদ্ধে করা মামলাগুলোর এখন সাক্ষ্য গ্রহণ চলছে। গত ২৮ আগস্টও তিনি সাক্ষ্য গ্রহণ চলাকালীন আদালতে হাজির ছিলেন। জানতে চাইলে আবদুল মালেক মালু বলেন, পুলিশের পরের তদন্তে আমি নির্দোষ, তা প্রমাণিত হয়েছে। এরপরও আমার নামে ওই চার মামলায় বিচার চলছে। নির্দোষ প্রমাণিত হওয়ার পরও আদালতের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হচ্ছে। জানি না এ থেকে আমি কবে রেহাই পাব। এর আগে জেল থেকে জামিনে মুক্ত হওয়ার পর আবদুল মালেক মালু ২০১৪ সালের ২৯ ডিসেম্বর পুলিশ মহাপরিদর্শকের (আইজিপি) কাছে দেওয়া এক আবেদনে তাকে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে ফাঁসিয়ে দেওয়ার অভিযোগ করেন। ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনারের কাছেও সেই আবেদনের অনুলিপি দেওয়া হয়। আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে মালুর অভিযোগ তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় মতিঝিল বিভাগের তৎকালীন উপ-কমিশনারের (ডিসি) ওপর। তিনি তা অনুসন্ধানের দায়িত্ব দেন একই বিভাগের তৎকালীন অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) মোহাম্মদ ফরিদ উদ্দিনকে (বর্তমানে তিনি অতিরিক্ত ডিআইজি এবং র‌্যাব-১০ এর সিও)। এ অনুসন্ধানের বিষয়ে জানতে গত ৬ আগস্ট তথ্য অধিকার আইনে ডিএমপির মিডিয়া ও পাবলিক রিলেশনস বিভাগের ডিসি ফারুক হোসেনের কাছে একটি আবেদন দেওয়া হয়। গত ২৮ আগস্ট তিনি এক চিঠিতে ওই অনুসন্ধানের বিষয়ে কোনো তথ্য দেওয়া সম্ভব না বলে জানিয়ে দেন। পরবর্তীতে মতিঝিল বিভাগে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মোহাম্মদ ফরিদ উদ্দিন ২০১৫ সালের ২৫ মে তদন্ত প্রতিবেদন সংশ্লিষ্ট বিভাগের ডিসির কাছে জমা দেন (স্মারক-১৫১৩/আর ও মতিঝিল)। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৩ সালে বিএনপি-জামায়াত সমর্থিত লোকজনের সহিংসতার কারণে পল্টন থানার চারটি মামলা পর্যালোচনা করা হয়। মামলার তদন্তভার গ্রহণ করেন পল্টন থানার তৎকালীন এসআই শওকত আলী। তিনি তদন্ত শেষে ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে মোট চারটি চার্জশিট দাখিল করেন। কিন্তু চার্জশিটভুক্ত আসামি আবদুল মালেক মালু একজন সহজ-সরল ও নিরীহ মানুষ। তার বিষয়ে কোনো রকম তদন্ত ও রাজনৈতিক পরিচয় যাচাই না করে অসদুদ্দেশ্যে আর্থিকভাবে লাভবান হয়ে রাজনৈতিক মামলায় জড়িয়ে আসামি করা হয়। সম্পূর্ণ বিচার-বিবেচনাহীনভাবে মালুর বিরুদ্ধে চারটি চার্জশিট দেওয়া হয়। অথচ আবদুল মালেক মালু ডেমরার সারুলিয়া ইউনিয়ন যুবলীগের সহসভাপতি। বিষয়টি নিশ্চিত করেন তৎকালীন স্থানীয় এমপি হাবিবুর রহমান মোল্লা (বর্তমানে মৃত) ও সারুলিয়া ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি মো. দুলাল খান (এখন সেই ইউনিয়ন সিটি করপোরেশনের অন্তর্ভুক্ত)। পুলিশের ওই তদন্ত প্রতিবেদন এবং স্থানীয় এমপির সে সময়ের প্রত্যয়নপত্র এই প্রতিবেদকের কাছে রয়েছে। তদন্তে পল্টন থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোরশেদ আলম ও পরিদর্শক (তদন্ত) তোফায়েল আহমেদেরও গাফিলতি বেরিয়ে আসে। পরিদর্শক তোফায়েল আহমেদ বর্তমানে ডিএমপি সদর দফতরে কর্মরত। তিনি বলেন, সেই তদন্তের বিষয়ে আমার কিছু জানা নেই। জানা গেছে, আবদুল মালেক মালুর বিরুদ্ধে করা ষড়যন্ত্রমূলক মামলা থেকে অব্যাহতি দিতে পুলিশ সদর দফতরে চিঠিও দেয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ২০১৭ সালের ১১ এপ্রিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের (আইন-২ অধিশাখা) উপসচিব মমতাজ উদ্দিন স্বাক্ষরিত ওই চিঠি আইজিপি বরাবর পাঠানো হয়। পরে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পুলিশ সদর দফতর সেই চিঠি নিয়ে পরবর্তীতে কোনো কাজ করেনি। আবদুল মালেক মালুর মতো সেলিম নামে আরেক ব্যক্তিকেও ২০১৭ সালের অন্য একটি মামলায় ফাঁসানো হয়েছে বলে জানা গেছে। সেলিম জনশক্তি রপ্তানি ব্যবসায় জড়িত। তিনি বলেন, আমার নামে মামলাটি হয় দক্ষিণখান থানায়। মামলার পর চার্জশিট হয়েছে, আমার নামে গ্রেফতারি পরোয়ানা এবং জামিনও হয়েছে। এক বছর পর আমি জানতে পারি। সেই মামলা থেকে এখনো আমি মুক্তি পাইনি। এখনো মামলা চলমান। পুলিশ সদর দফতরের ডিআইজি (ক্রাইম ম্যানেজমেন্ট) জয়দেব কুমার ভদ্র এ প্রতিবেদককে বলেন, একবার চার্জশিট হয়ে গেলে পুলিশের আর কিছু করার নেই। তবে পুলিশের পরবর্তী তদন্তে যা এসেছে তা ভুক্তভোগী সাফাই সাক্ষীর সময় আদালতে উপস্থাপন করতে পারেন।

সর্বশেষ খবর