রবিবার, ৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

নিষেধাজ্ঞার ভয় দেখিয়ে লাভ নেই : প্রধানমন্ত্রী

♦ নৌকা মার্কাই স্মার্ট বাংলাদেশ দেবে ♦ এক্সপ্রেসওয়ে ঢাকাবাসীর জন্য উপহার

নিজস্ব প্রতিবেদক

নিষেধাজ্ঞার ভয় দেখিয়ে লাভ নেই : প্রধানমন্ত্রী

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সুধী সমাবেশের অভিবাদনের জবাব দিচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর বোন শেখ রেহানা -পিআইডি

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, অন্ধকার থেকে বাংলাদেশ আলোর পথে যাত্রা শুরু করেছে। মাঝে মাঝে আন্দোলন-সংগ্রাম দেখে অনেকেই একটু ঘাবড়ে যান। তারপর স্যাংশন (নিষেধাজ্ঞা) আসে, ভিসা স্যাংশন ইত্যাদি ইত্যাদি। আমার স্পষ্ট কথা, এই মাটি আমাদের, জাতির পিতার নেতৃত্বে আমরা দেশকে স্বাধীন করেছি। কাজেই এসব ভয় দেখিয়ে কোনো লাভ নেই। গতকাল বিকালে রাজধানীর পুরনো বাণিজ্য মেলা মাঠে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের দক্ষিণে কাওলা থেকে ফার্মগেট অংশ উদ্বোধন উপলক্ষে আয়োজিত সুধী সমাবেশে তিনি এসব কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, নৌকা সারা জীবন উজান ঠেলেই এগিয়েছে। উজান ঠেলেই এগিয়ে যাবে। বাংলার মানুষ জানে অধিকার আদায় করতে। ভয়কে জয় করেই বাংলাদেশের জনগণ তার উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে যাবে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ তো ছয় ঋতুর দেশ। কখনো বর্ষা, কখনো ঝড়, কখনো জলোচ্ছ্বাস, কখনো রৌদ্রোজ্জ্বল সময়, বিভিন্নতা দেখে আমাদের অভিজ্ঞতা আছে। তাই আজ যারা আন্দোলনের নামে রোজই ক্ষমতা থেকে আমাদের ফেলে দিচ্ছে, আমি আপনাদের বলতে চাই, যারা এখানে উপস্থিত সবাইকে বলব, সেটা কবির ভাষায় বলব, ‘মেঘ দেখে কেউ করিসনে ভয়/ আড়ালে তার সূর্য হাসে/ হারা শশীর হারা হাসি/ অন্ধকারেই ফিরে আসে।’ বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নৌকা মার্কায় ভোট চেয়ে বলেন, মেঘের ঘনঘটা আমরা দেখি। আবার তারপর তো সূর্য ওঠে। নৌকা মার্কা স্বাধীনতা দিয়েছে, নৌকা মার্কা অর্থনৈতিক উন্নতি দিয়েছে, নৌকা মার্কা ডিজিটাল বাংলাদেশ দিয়েছে, নৌকা মার্কাই স্মার্ট বাংলাদেশ আমাদের দেবে। আগামী নির্বাচনে নৌকা মার্কায় ভোট দিন। প্রধানমন্ত্রী প্রশ্ন রেখে বলেন, ’৭৫ থেকে ১৯৯৬ এবং ২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত এই ২৯ বছর যারা ক্ষমতায় ছিলেন, তারা দেশকে কী দিয়েছেন। নিজেদের আখের গোছানো, লুটপাট ছাড়া দেশকে তারা কিছুই দিতে পারেননি। এই সময়টা ছিল অন্ধকারের সময়। সেই অন্ধকার থেকে বাংলাদেশ আলোর পথে এগিয়ে যাচ্ছে।

উৎসবমুখর পরিবেশে উদ্বোধন : উৎসবমুখর পরিবেশে বিকাল ৩টা ৪০ মিনিটে প্রধানমন্ত্রীর গাড়িবহর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কাছে কাওলা থেকে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে প্রবেশ করে। সেখানে প্রথম যাত্রী হিসেবে টোলপ্লাজায় নিজ হাতে টোল পরিশোধ করে দক্ষিণ কাওলাপ্রান্তে সুইচ টিপে প্রকল্পের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ সময় তাঁর ছোট বোন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ রেহানা, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলামসহ অন্যরা উপস্থিত ছিলেন। উদ্বোধনের পর মোনাজাতে অংশ নেন বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। এরপর সেখানে প্রকল্পের খুঁটিনাটি সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীকে অবহিত করা হয়। উদ্বোধনের সময় হাজার হাজার রঙিন বেলুন, নানা রঙের আতশবাজি ফুটিয়ে উল্লাসে মেতে ওঠেন নগরবাসী। আনুষ্ঠানিকতা শেষে বহুল প্রতীক্ষিত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে যোগে ফার্মগেট হয়ে আগারগাঁও পুরনো বাণিজ্য মেলা মাঠে উপস্থিত হন প্রধানমন্ত্রী। তিনি পুনরায় সেখানে প্রকল্পটির উদ্বোধনী ফলক উন্মোচন ও মোনাজাতে অংশ নেন। দীর্ঘ পথের বিভিন্ন পয়েন্টে অবস্থান নেওয়া হাজার হাজার নেতা-কর্মী ও সাধারণ মানুষ হাত নেড়ে প্রধানমন্ত্রীকে অভিনন্দন জানান। এরপর সেখানে আয়োজিত সুধী সমাবেশে অংশ নেন। তবে লাখ লাখ মানুষের উপস্থিতিতে সুধী সমাবেশটি রীতিমতো জনসমুদ্রে রূপ নেয়। মাত্র ১৬ মিনিটে কাওলা থেকে ফার্মগেট প্রান্তে নেমে সমাবেশের মঞ্চে উঠে প্রথমেই প্রকল্পের উদ্বোধন ও মোনাজাতে অংশ নেন তিনি। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানের শুরুতেই স্বাগত বক্তব্য রাখেন সেতু বিভাগের সচিব মো. মঞ্জুর হোসেন। এরপর ৮ হাজার ৯৪০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত দেশের প্রথম এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের পিপিপি প্রকল্পের একটি ভিডিও প্রমাণচিত্র প্রদর্শন করা হয়। পরে প্রকল্পটির বিনিয়োগকারী সংস্থার প্রতিনিধি লি গুয়াংজিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের খুদে সংস্করণ উপহার দেন এবং তিনি তাঁর প্রতিষ্ঠানের পক্ষে বক্তব্য রাখেন। বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান। এ সময় মঞ্চে ছিলেন বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ কন্যা শেখ রেহানা, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপস, উত্তরের মেয়র আতিকুল ইসলাম, সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি রওশন আরা মান্নান, সংসদ সদস্য হাবিব হাসান, মোহাম্মদ এ আরাফাতসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ। অনুষ্ঠানে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, মন্ত্রিপরিষদের সদস্যবৃন্দ, সংসদ সদস্যবৃন্দ, কূটনীতিকবৃন্দ, সামরিক-বেসামরিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। গতকাল দুপুরে উৎসবমুখর পরিবেশে পুরনো বাণিজ্য মেলার অভিমুখে মানুষের ঢল নামে। কখনো টিপটিপ, আবার কখনো মুষলধারে বৃষ্টি- এমন বৈরী আবহাওয়ার মধ্যে মানুষের স্রোতকে এতটুকু বাধা দিতে পারেনি। কাকভেজা হয়েই বড় বড় মিছিল নিয়ে দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে হাজার-হাজার নেতা-কর্মী ও সাধারণ মানুষ সুধী সমাবেশে হাজির হন ইতিহাসের আরেকটি সাক্ষী হতে। ঢাকা মহানগরীর প্রতিটি নির্বাচনী এলাকা ছাড়া আশপাশের জেলা থেকেও হাজার হাজার নেতা-কর্মী সমাবেশে যোগ দেন। নারায়ণগঞ্জের সংসদ সদস্য এ কে এম শামীম ওসমান শত শত বাস-ট্রাকে করে ২০ হাজার নেতা-কর্মী নিয়ে সমাবেশে যোগ দেন। ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ বজলুর রহমান ও সাধারণ সম্পাদক এস এম মান্নান কচির নেতৃত্বে গোলাপি টুপি পরিহিত নেতা-কর্মীর ব্যাপক উপস্থিতি চোখে পড়ে। ছাত্রলীগ, যুবলীগ, যুব মহিলা লীগ, গাজীপুর, ময়মনসিংহ, ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। ৫ লাখেরও বেশি মানুষকে বাংলাদেশের প্রথম এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে যুগে প্রবেশের স্বপ্নপূরণের দুর্লভ মুহূর্তের সাক্ষী হতে দেখা যায়। সরকারের সাফল্যের মুকুটে যুক্ত হয় আরেকটি গৌরবময় পালক।

এক্সপ্রেসওয়ে রাজধানীবাসীর জন্য উপহার : শেখ হাসিনা বলেন, আজ ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে পিপিপি প্রকল্পের হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে তেজগাঁও পর্যন্ত অংশের উদ্বোধন আমি করেছি। এটা আপনাদের উপহার হিসেবে দিয়ে গেলাম। দেশের প্রথম এই এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েকে যোগাযোগের ক্ষেত্রে ‘নতুন মাইলফলক’ বলেও উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী। ঢাকা শহরের যোগাযোগব্যবস্থা, যানজট নিরসনে এই এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে বিশেষ ভূমিকা রাখবে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই এক্সপ্রেসওয়ে বিশেষ করে এয়ারপোর্ট, কুড়িল বিশ্বরোড, বনানী, মহাখালী, তেজগাঁও, ফার্মগেট, মগবাজার, কমলাপুর এলাকার যানজট নিরসন করবে। এর ফলে রাজধানীর যোগাযোগব্যবস্থার দ্রুত উন্নতি হবে, কর্মঘণ্টা নষ্ট হবে না, মানুষের কাজের সুযোগ সৃষ্টি হবে। ঢাকাবাসীর দীর্ঘদিনের যে একটি আকাক্সক্ষা এই এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের মাধ্যমে তা পূরণ হবে। আমরা আজ যতদূর পর্যন্ত (সম্ভব) করলাম, পরবর্তী সময়ে বাকিটাও হয়ে যাবে। বিএনপির প্রতি ইঙ্গিত করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, অনেকেই নাকি গণতন্ত্র চোখে দেখেন না, আর গণতন্ত্র উদ্ধার করবেন। যাদের জন্মই হচ্ছে অগণতান্ত্রিকভাবে সংবিধান লঙ্ঘন করে, উচ্চ আদালত যাদের ক্ষমতা দখল অবৈধ ঘোষণা করেছেন, তাদের হাতে গড়া দল কী গণতন্ত্র দেবে। তিনি বলেন, ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে আজকে একটা সাময়িক সমস্যা চলছে। আমাদের ওপর অর্থনৈতিক ধাক্কা এসেছে। এ জন্য আমি বলেছি, দেশে কোনো অনাবাদি জমি থাকবে না। নিজের ফসল নিজে ফলাব। নিজের খাবার নিজে উৎপাদন করে খাব। কারও কাছে হাত পাতব না। জাতির পিতা বলতেন, ভিক্ষুকের জাতির উন্নতি হয় না। সরকারপ্রধান আরও বলেন, পদ্মা সেতু নির্মাণ করে বিশ্বকে দেখিয়ে দিয়েছি, বাংলাদেশকে দাবায়ে রাখা যায় না। মেট্রোরেল, উড়ালসড়ক উদ্বোধন করলাম। এগুলো সবই জনগণের স্বার্থে। সারা দেশে যোগাযোগব্যবস্থার অভাবনীয় উন্নতি করেছি। আমরা চাই, আমাদের দেশ আরও এগিয়ে যাবে। তিনি বলেন, জাতির পিতার এই স্বাধীন দেশের একটি মানুষও গৃহহীন ও ভূমিহীন থাকবে না। তাদের ঘরবাড়ি করে দিচ্ছি। বেকারদের কর্মসংস্থান ব্যাংকের মাধ্যমে ঋণ দিয়ে কাজের সুযোগ করে দিচ্ছি। সরকারি চাকুরেদের মতো সবার জন্য সর্বজনীন পেনশন চালু করেছি। শুধু বর্তমান নয়, ভবিষ্যতও যেন আলোকিত হয়, আমরা সে উদ্যোগই নিচ্ছি। তিনি বলেন, ঢাকাকে যানজটমুক্ত করার জন্য আমাদের এই এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। নিজের হাতে টোল দিয়ে ওই সড়ক দিয়ে এখানে এসেছি। ফার্মগেট নেমে এখানে হাজির হয়েছি। আসতে মাত্র ১২-১৩ মিনিট সময় লেগেছে। বাকি অংশের কাজও তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যাবে। তিনি বলেন, আমরা চাই দেশ আরও এগিয়ে যাবে। আমরা ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে বলিয়ারপুর থেকে কেরানীগঞ্জ-ফতুল্লা ঝালকুড়ি হয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ৩৯ দশমিক ২৪ কিলোমিটার উড়ালসড়ক নির্মাণের পদক্ষেপ নিয়েছি। এটা হলে যানবাহন ঢাকা শহরে প্রবেশ না করে এ অঞ্চল থেকে আরেক অঞ্চলে চলে যেতে পারবে। কেবল যোগাযোগব্যবস্থা নয়, সার্বিকভাবে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে।

 

সর্বশেষ খবর