সোমবার, ৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

দখল দূষণে বিপন্ন চলনবিল

নাসিম উদ্দীন নাসিম, নাটোর ও এস এ আসাদ, পাবনা

দখল দূষণে বিপন্ন চলনবিল

পাবনায় চলনবিলে স্থাপনা নির্মাণ চলছেই। নাটোরে ফেলা হচ্ছে ময়লা-আবর্জনা -বাংলাদেশ প্রতিদিন

জলবায়ু পরিবর্তন, ফারাক্কার বিরূপ প্রভাব ও বড়াল নদের উৎসমুখে যত্রতত্র স্লুইসগেট নির্মাণের কারণে পলি জমে অস্তিত্ব সংকটে দেশের সবচেয়ে বৃহৎ জলাধার চলনবিল। অপরিকল্পিত বাঁধ, সেতু, কালভার্ট সড়কসহ নানা অবকাঠামো নির্মাণ, দখল ও দূষণে বিলের অস্তিত্ব হুমকির মুখে। শুষ্ক মৌসুমে বিলের ভিতর দিয়ে প্রবাহিত ৭৭টি নদী, বিল, খাড়ি ভরাট হয়ে আবাদি জমিতে রূপান্তরিত হয়েছে। এতে বিল-নদী নির্ভর প্রায় ২১ হাজার হেক্টর জমির সেচ কার্যক্রম বিঘিœত হচ্ছে।

ফলে দিগন্ত বিস্তীর্ণ বিলাঞ্চলের ফসল আবাদ গভীর-অগভীর নলকূপনির্ভর হয়ে পড়েছে। বর্ষার পানি নামার পর চলনবিলের বুকজুড়ে আবাদ হয় বোরো ধান, সরিষা, রসুন, গম প্রভৃতি ফসল। বর্ষায় অপার জলসমুদ্রের চলনবিল পরিণত হয় সবুজের গালিচায়। দিগন্ত বিস্তৃত এই সবুজ ফসলের মাঠ দেখে চোখ জুড়ালেও গত কয়েক বছর ধরে প্রশান্তি নেই কৃষকের মনে। কারণ, অভাবনীয় বাস্তবতায় ক্রমশ পানিশূন্য হয়ে পড়ছে চলনবিল। এক সময় যে বিলের পানিতেই সারা বছর চলেছে সেচের কাজ, সেখানেই শুষ্ক মৌসুমে এখন পানির জন্য হাহাকার। এতে চাষাবাদে খরচ বাড়ার পাশাপাশি, বিরূপ প্রভাব পড়েছে প্রতিবেশেও।

দখল ও দূষণে পানি সংকটে দেশি জাতের মাছের বিচরণক্ষেত্র হ্রাস আর নির্বিচার নিধনে ক্রমেই মাছশূন্য হয়ে পড়ছে উত্তরবঙ্গের সর্ববৃহৎ মৎস্যভান্ডার চলনবিল। মৎস্য সম্পদ রক্ষায় অভয়াশ্রম গড়ে তোলা ও প্রশাসনিক নজরদারি বাড়ানোর দাবি জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। বৃহত্তম এ বিলের পানি চলমান হওয়ায় এ বিলের নামকরণ করা হয় চলনবিল।

কিন্তু চলমান পানি তো দূরের বিষয়, শতাধিক ফ্লাসিং ইনলেটের জালে জড়িয়ে অখন্ড চলনবিল এখন বহু বিভক্ত। এতে চলনবিলের মৎস্য সম্পদ ও জলজ প্রাণী বিলুপ্তির পথে। অন্যদিকে প্রভাবশালী ভূমিদস্যুরা জাল দলিল করে দখলে নিয়েছে বিলের কয়েক হাজার একর খাস জমি। ইম্পেরিয়াল গেজেটিয়ার অব ইন্ডিয়া বই থেকে জানা গেছে, চলনবিল অঞ্চলে ৩৯টি বিল, ১৬টি নদী এবং ১২ হাজার ২২টি খাল রয়েছে। এর মধ্যে প্রধান নদী ৯টি, ২০টি খালসহ ছোট ছোট বিভিন্ন বিল ও খাল রয়েছে। অতীতে ২৩ হাজারের মতো বড় বড় পানির আধার ছিল। যার বেশির ভাগই বেদখল ও হাতছাড়া হয়ে গেছে। সংশ্লিষ্ট ভূমি অফিসের রেকর্ড অনুযায়ী, বর্তমানে নাটোরের বড়াইগ্রাম, গুরুদাসপুর, সিংড়া, পাবনার চাটমোহর, ভাংগুড়া, ফরিদপুর এবং সিরাজগঞ্জের তাড়াশ ও রায়গঞ্জ উপজেলার ৬২টি ইউনিয়ন ও আটটি পৌরসভার ১ হাজার ৬০০টি গ্রাম নিয়ে চলনবিলের অবস্থান। উপকারভোগী মোট লোক সংখ্যা প্রায় ২০ লক্ষাধিক। চলনবিলে জমির পরিমাণ প্রায় ১ লাখ ৬৬ হাজার ৫৩৫ হেক্টর। প্রায় ১ হাজার ৭৫৭ হেক্টর আয়তনের ৩৯টি বিল, ৪ হাজার ২৮৬ হেক্টর আয়তন বিশিষ্ট ১৬টি নদী এবং ১২০ বর্গ কিলোমিটার বিশিষ্ট ২২টি খাল রয়েছে। চলনবিলের তিনটি জেলা নাটোর, পাবনা ও সিরাজগঞ্জে বেশির ভাগ খাস জমি ও জলাশয় এখন এলাকার প্রভাবশালীদের দখলে। শুষ্ক মৌসুমে চলনবিলের নদী বিল শুকিয়ে জেগে ওঠা দিগন্ত বিস্তৃত মাঠ। স্থানীয় কৃষকরা মাঠে ধান, পাট, সরিষা, রসুন, পিঁয়াজসহ নানা রকমের ফসল আবাদ করছেন। এসব নদী-বিল শুকিয়ে যাওয়ায় এক সময়ের অতি পরিচিত দেশি ৬৫ প্রজাতির মাছ আজ বিলুপ্তির পথে। কোনো কোনো মাছ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে। জানা যায়, এক সময় বড়াল, নন্দকুজা, ভদ্রাবতী, সরস্বতী, ইছামতী, গুমানী, আত্রাই, গুড়নদী, করতোয়া, ফুলজোর, তুলসী, চেঁচুয়া, ভাদাই, চিকনাই, বানগঙ্গা ও গোয়ালা নদীসহ অসংখ্য বিল ছিল চলনবিলের গর্ব ও ঐতিহ্য।

এ ছাড়া নবী হাজীর জোলা, হক সাহেবের খাল, নিয়ামত খাল, সাত্তার সাহেবের খাল, কিনু সরকারের ধর, পানাউলার খাল, নিমাইচরা-বেশানী, বেশানী-গুমানী ও উলিপুর-মাগুড়া, দোবিলা খাল, বেহুলার খাড়ি, বাঁকাই খাড়ি, গাঁড়াবাড়ি-ছারখালী খাল, জানিগাছার জোলা ছিল চলনবিলের প্রাণ। কিন্তু ধীরে ধীরে এসব নদী-বিল ও খাড়ি ভরাট হয়ে যাওয়ায় মৎস্য ও জলজ সম্পদে ভরপুর চলনবিলে এখন মাছের আকাল দেখা দিয়েছে। এক সময় চলনবিলের মাছ স্থানীয় অর্থনীতি ও জীবনযাত্রায় দারুণ প্রভাব ফেলেছিল। মাছ বিক্রি করে আর্থিকভাবে সচ্ছল হয়ে উঠেছিল এ অঞ্চলের মানুষ। এই নদীগুলো ঘিরেই একসময় গড়ে উঠেছিল বাঘাবাড়ী, কলম, গুরুদাসপুর, নলডাঙ্গা, আহসানগঞ্জ, মির্জাপুর, ভাঙ্গুড়া, বড়াল ব্রিজ, ফরিদপুর, গোবিন্দপুর ঘাট, সিংড়া, চাঁচকৈড়, বিলদহর, হালসা, দয়রামপুর, নাজিরপুর, ছাইকোলার মতো বড় বড় বাজার। চলত রমরমা ব্যবসা। সেই সময় নদনদীতে বছরজুড়েই পানি থাকত। বাজারগুলোতে ব্যবসা-বাণিজ্য চলত। বছরের পর বছর পলি পড়ে, আর ড্রেজিং না করার কারণে নদনদী এখন খালে পরিণত হওয়ার পথে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নদনদী হারিয়েছে তার সৌন্দর্য আর জৌলুস। এখন বর্ষাকালে নদনদী পানিতে ভরে থাকলেও বর্ষা শেষ হলে পানির দেখা মেলে না; পানি শুকিয়ে যায়। চলনবিলের নদনদীতে অনেক আগেই বছরজুড়ে নিয়মিত নৌচলাচল বন্ধ হয়েছে। অথচ নদনদীগুলোতে একসময় লঞ্চ চলত! নদনদী দখল আর বর্জ্য ফেলে ভরাট করার কারণে নৌপথ সংকুচিত হয়েছে। নদনদীকেন্দ্রিক কর্মজীবী মানুষ হয়েছে বেকার, তারা পেশা বদলে বাধ্য হয়েছে। প্রভাবিত হয়েছে ব্যবসা-বাণিজ্য, কৃষি জমিতে সেচকাজ ব্যাহত হয়েছে; প্রতিবেশ ব্যবস্থা আর মৎস্য সম্পদ পড়েছে হুমকির মুখে। ১৯১৪ সালে চলনবিলের মাঝ দিয়ে প্রথম ঈশ্বরদী-সিরাজগঞ্জ রেলপথ নির্মিত হলে চলনবিলের সঙ্গে কলকাতার যোগাযোগ স্থাপিত হয়। ওই সময় উত্তরাঞ্চলের চাহিদা মিটিয়ে এ বিলের মাছ ট্রেনে করে ভারতে রপ্তানি হতো। ১৯৭৭ সালে চলনবিলের মাঝ দিয়ে বাঘাবাড়ী থেকে সিংড়া পর্যন্ত বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ তৈরি হয়। ২০০২ সালে চলনবিলের বুক চিরে নির্মাণ করা হয় ৫৫ কিলোমিটার দীর্ঘ বনপাড়া-হাটিকুমরুল মহাসড়ক।

স্থানীয়দের অভিযোগ, একটি স্বার্থান্বেষী মহল প্রভাব খাটিয়ে এসব নদী দখল করছে। ফলে নদী সংলগ্ন এলাকায় ফসলহানি, বদ্ধ পানিতে দূষণ-দুর্গন্ধ-রোগবালাই, জেলে-কৃষক, ব্যবসায়ী-বেকাররা দিশাহারা হয়ে পড়েছে। দখলদাররা নদী তীরবর্তী জেলে, কৃষক ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের বেকার বানিয়ে নদী ধ্বংসের অপকর্মে নেমেছে। ব্যবস্থাপনার নামে অকেজো হয়ে পড়া স্লুইসগেটগুলো এখন সরকারি টাকা অপচয়ের প্রধান উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছে। চলনবিলের নদীগুলোকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার দাবি করেছেন নদী তীরবর্তী মানুষ। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞানী ড. মো. রেদওয়ানুর রহমানের তার প্রবন্ধে উল্লেখ করেন, ২৫ বছর আগেও চলনবিলের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত নদী ও বিলে বছরজুড়েই ৬ থেকে ১২ ফুট পানির গভীরতা থাকত। সারা বছরই নৌচলাচল করত। কিন্তু বছরের পর বছর পলি জমে এসব নদী-বিল ভরাট হয়ে গেছে। জলবায়ু পরিবর্তন, ফারাক্কা বাঁধের প্রভাবে এবং ১৯৮০ দশকে বড়ালের উৎসমুখে স্লুইসগেট নির্মাণের ফলে চলনবিলের বিভিন্ন নদী বিল জলাশয় ও খাড়িগুলোয় পলি জমে ক্রমে ভরাট হয়ে গেছে। পাবনার চাটমোহর উপজেলার হান্ডিয়াল ইউনিয়নের কৃষক আফজাল হোসেন জানান, এ বছর আষাঢ়, শ্রাবণ এমনকি ভাদ্রেও পানির দেখা মেলেনি চলনবিলে। আমরা যারা পাট চাষাবাদ করেছি, তাদের পাট পচানোতে চরম ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে। অপরদিকে বর্ষা চলে যাওয়ার পরপরই পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় সেচের কাজ ব্যাহত হচ্ছে। ডিজেলচালিত শ্যালোমেশিনে ঠিকমতো পানি ওঠে না। অগভীর নলকূপ নষ্ট হয়ে যায় শুষ্ক মৌসুমে। শ্যালো পাম্পগুলোতে পানি কম ওঠায় তা গভীর থেকে আরও গভীরে নামানো হচ্ছে। মাটি থেকে ১০ থেকে ১২ ফুট গভীরে গর্ত করে শ্যালোমেশিন ও পাম্প বসানো হয়।

বিপন্ন প্রাণ-প্রতিবেশ : জলবায়ু পরিবর্তন ও চাষাবাদে যথেচ্ছ কীটনাশকের ব্যবহারের প্রতিক্রিয়ায় বিলুপ্ত হয়েছে চলনবিলের ৭২ প্রজাতির মাছ, ৭১ প্রজাতির পাখি, ২৮ প্রজাতির প্রাণী, ১৭ প্রজাতির সরীসৃপ আর নানা ধরনের জলজ সম্পদ। হারানোর তালিকায় রয়েছে ৪১ জাতের আউশ ধান ও ১০ জাতের আমন ধান।

চলনবিলের জীববৈচিত্র্য নিয়ে দীর্ঘদিন গবেষণা করছেন কৃষিবিদ আবদুল মান্নান পলাশ। তিনি জানান, ৩০ বছর আগেও এই চলনবিল ছিল এক ছোটখাটো সমুদ্র। তখন সারা বছর বিলে পানি থাকত। পাওয়া যেত দেশি জাতের মিঠাপানির সুস্বাদু মাছ। দেশিজাতের আমন-আউশ ধানই ছিল চলনবিলের প্রধান ফসল। সুখ্যাত পানসা ফল, পদ্মচাকা, মাখনা, শিঙ্গট, ঢ্যাপ, শালুক-শাপলা জাতীয় স্বাদু ফল পাওয়া যেত বিলের পানিতে। বিভিন্ন প্রজাতির সাপ, কচ্ছপ, ঝিনুক ও জোঁক ছিল বিলে বেশুমার। বিলের বদ্ধ জলাশয়ের আমন-আউশ ধানের সঙ্গে এসব জলজ উদ্ভিদ ও প্রাণীর ছিল অবাধ বিচরণ। এগুলো খেয়েই বেঁচে থাকত বিভিন্ন প্রজাতির মাছ ও পাখি। সেসবের কিছুই এখন আর চোখে পড়ে না। চলনবিলের এ বিশেষজ্ঞের মতে, আশির দশকে বন্ধ হয়ে যাওয়া বহুমুখী চলনবিল প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে চলনবিলের জীববৈচিত্র্য রক্ষা করা সম্ভব। চলনবিল উদ্ধার আন্দোলন কমিটির সদস্য সচিব এস এম মিজানুর রহমান বলেন, দীর্ঘদিন নদীগুলো খনন না হওয়ায় নাব্য হারিয়ে ফেলেছে। ফলে বছরের প্রায় ৭ মাস পানিশূন্য থাকছে। চাটমোহরসহ চলনবিলের নদীগুলোর পাড়ের হাজার হাজার কৃষক নদী থেকে পানি তুলে জমিতে সেচ দিতে পারছে না। তারা নদীগুলো খনন করে পানি ধারণের উপযোগী করার দাবি জানিয়ে আসছে দীর্ঘদিন।

এ প্রসঙ্গে পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. নাজমুল ইসলাম বলেন, পরিবেশগত সমীক্ষা ছাড়া বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতিকর প্রভাব ডেকে এনেছে চলনবিলের প্রাণ প্রকৃতি ও বিলনির্ভর মানুষের জীবন জীবিকায়। প্রকৃতি যদি তার ওপর অত্যাচারের প্রতিশোধ নেয়, তা কতটা ভয়াবহ হতে পারে তা হাওর অঞ্চলের মানুষ প্রত্যক্ষ করেছে। চলনবিল অঞ্চলে বিগত কয়েক দশকে তাপমাত্রা বেড়েছে বহুগুণ, খরা, অসময়ে বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দিচ্ছে। চলনবিলের প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় পরিবেশগত সমীক্ষা সাপেক্ষে পরিকল্পিত উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন।

পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) জানায়, ১৯৭০ সালে চলনবিলের উন্নয়নের লক্ষ্যে ২০০ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘চলনবিল প্রকল্প’ হাতে নেয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী ২৫১ মাইল বাঁধ, ১৮৭টি খাল, ২৪টি রেগুলেটর, ৫৮টি ফ্লাসিংইনসেট, ৫৫টি ব্রিজ এবং ১৩২টি কালভার্ট নির্মাণের কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়। কিন্তু ১৯৮৪ সালে রাজশাহীর চারঘাটে পদ্মায় বড়াল নদীর উৎসমুখে একটি (স্লুইসগেট) রেগুলেটর নির্মাণ করার পর প্রকল্পটি বন্ধ হয়ে যায়।

সর্বশেষ খবর