সোমবার, ৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

উদ্বেগ বাড়াচ্ছে অবৈধ অস্ত্র

সাখাওয়াত কাওসার

উদ্বেগ বাড়াচ্ছে অবৈধ অস্ত্র

গত ২৫ এপ্রিল রাত সাড়ে ৯টার দিকে সদর উপজেলার বশিকপুর ইউনিয়নের নাগেরহাট এলাকায় লক্ষ্মীপুর জেলা যুবলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবদুল্লাহ আল নোমান ও জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক রাকিব ইমামকে ফিল্মি স্টাইলে গুলি করে দুর্বৃত্তরা। জনসম্মুখে দুর্বৃত্তদের এমন নৃশংস আয়োজন রীতিমতো আতঙ্ক ছড়িয়েছে ওই এলাকার সাধারণ মানুষের মাঝে। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই হত্যাকান্ডে অংশ নেওয়া লাদেন বাহিনীর ক্যাডাররা নতুন ৭.৬৫ বোরের চকচকে অত্যাধুনিক অস্ত্রের ব্যবহার করে। এই কিলিং মিশনের জন্যই এসব অস্ত্র সংগ্রহ করেছিল। চাঞ্চল্যকর এই ডবল মার্ডারের নেপথ্য মদদদাতা স্থানীয় সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান কাশেম জিহাদী। গত শুক্রবার একটি বিদেশি পিস্তল ও পাঁচ রাউন্ড গুলিসহ সাদ্দাম হোসেন নামের এক অস্ত্র ব্যবসায়ীকে রাজশাহীর কাটাখালির আবহাওয়া পাড়া থেকে গ্রেফতার করে র‌্যাব-৫ এর একটি দল। সাদ্দাম একটি বইয়ের ভিতরের পাতা কেটে বিশেষ কৌশলে বিক্রির জন্য একজন ক্রেতার কাছে নিয়ে ঢাকার দিকে রওনা হচ্ছিল। তবে এর আগেই সাদ্দামকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। এর আগে গত ১৮ আগস্ট রাজশাহীর পুটিয়া থেকে ছদ্মবেশী বাদাম বিক্রেতা মিলন হোসেনকে চারটি ওয়ান শুটারগান ও ছয় রাউন্ড গুলিসহ গ্রেফতার করে র‌্যাব-৫ এর সদস্যরা।

ওপরের তিনটি ঘটনার একটি ভয়ঙ্কর নৃশংসতার অপর দুটি আইন প্রয়োগকারী সংস্থার আভিযানিক সাফল্যের। তবে সাম্প্রতিক তথ্যের বরাত দিয়ে গোয়েন্দারা বলছেন, আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সহিংসতার লক্ষ্যে  সন্ত্রাসীরা দেশি-বিদেশি অবৈধ অস্ত্রের মজুদ করছে। সীমান্তবর্তী অস্ত্র কারবারিদের দিয়েই সংগ্রহ করছে এসব আগ্নেয়াস্ত্র। এদের মাধ্যমে কয়েক হাত ঘুরে সীমান্ত পেরিয়ে আসা এসব অস্ত্র পৌঁছে যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনৈতিক অস্থিরতার সুযোগে নিজেদের টার্গেট শিকারের পরিকল্পনা রয়েছে অনেকের। এসব অস্ত্র ভাড়ায় খাটাচ্ছেন তাদের অনেকেই। নিজস্ব অনুসন্ধানসহ একাধিক সংস্থার গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। তারাও স্বীকার করেছেন সীমান্ত দিয়ে আগ্নেয়াস্ত্র ঢোকার বিষয়টি। একাধিক সূত্র বলছে, খোদ রাজধানীর গুলশান ১ নম্বর গুলশান শপিং প্লাজার নির্মাণ ঘিরে দোকান মালিকদের দুটি গ্রুপ মুখোমুখি গত তিন মাস ধরে। এদের একটি পক্ষের হয়ে কাজ করছে বিদেশে পলাতক ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী সাখাওয়াত হোসেন চঞ্চল গ্রুপের লোকজন। রাজধানীর মতিঝিল এলাকায় বহুল আলোচিত রিয়াজ মিল্কী হত্যা মামলার ফেরারি আসামি চঞ্চলের হয়ে মাঝেমাঝে অস্ত্রের মহড়া দিচ্ছেন দুলাল, পারভেজ। গত তিন দিন আগেও গুলশান থানা পুলিশের সামনে গুলশান শপিং কমপ্লেক্স এলাকায় অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে।  নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক গুলশান বিভাগ পুলিশের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, গুলশান শপিং কমপ্লেক্সকে ঘিরে নানা ঘটনা ঘটার আশঙ্কা রয়েছে। কেউ কেউ এর সুযোগ  নেওয়ারও চেষ্টা করছেন। হাম্মাদ নামের একজনের ভূমিকা অনেকেরই নজর কেড়েছে। সব খবরই আমরা রাখছি। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকেও অবহিত করা হয়েছে। সিগন্যাল পাওয়া মাত্রই প্রয়োজনীয় সবকিছুই করা হবে। গত ১৬ মার্চ দুপুরে নারায়ণগঞ্জ বন্দরের ফেরাজীকান্দা এলাকায় ফিল্মি স্টাইলে ফাঁকা গুলি ছুড়তে ছুড়তে বাজার দখল করতে যায় স্থানীয় পিজা শামীমের নেতৃত্বে হোন্ডা বাহিনীর সদস্যরা। প্রকাশ্য দিবালোকে এমন ঘটনায় রীতিমতো আতঙ্কিত হয়ে পড়েন স্থানীয়রা। অভিযোগ রয়েছে, পুলিশকে অবহিত করা হলেও তারা এগিয়ে আসেনি। প্রায় ২০ মিনিট ধরে চলে দুর্বৃত্তের মিশন। বাধা দিতে আসলে সন্ত্রাসীদের এলোপাতাড়ি গুলিতে গুলিবিদ্ধ হন জমির মালিক মঈনুল হক পারভেজ (৪২)। ধারালো অস্ত্রের আঘাতে গুরুতর আহত হন পারভেজের স্ত্রী সুমা আক্তার (৩০) ও বৃদ্ধা মা মাফুজা বেগম (৫৮)। পরবর্তীতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১৯ দিন পর গত ৪ এপ্রিল মারা যান পারভেজ।গত ২৫ ফেব্রুয়ারি এপ্রিল সকালে নরসিংদীর শিবপুর পৌর এলাকার বাজার সড়কে শিবপুর উপজেলা চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি হারুনুর রশিদ খানকে বাড়িতে ঢুকে গুলি করে দুর্বৃত্তরা। গুলি দুটি তার পিঠের দুই জায়গায় বিদ্ধ হলে তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়লে দুর্বৃত্তরা পালিয়ে যান। পুলিশ সদর দফতরের ডিআইজি (অপারেশন্স) মো. আনোয়ার হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার তো আমাদের রুটিনওয়ার্ক। অবৈধ অস্ত্রের বিরুদ্ধে আমাদের (পুলিশ) অভিযান চলমান আছে।  এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরই বিশেষ অভিযান শুরু করা হবে। তবে এরই মধ্যে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে পুলিশ, র‌্যাব ও এপিবিএন অবৈধ অস্ত্রের বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি। অনুসন্ধানে জানা গেছে, কেবল রাজশাহী বিভাগের ৩টি সীমান্ত ঘিরে রয়েছে অন্তত ২২টি অস্ত্র ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট। এর প্রতিটিতে ৫ থেকে ১০ জন করে সক্রিয় সদস্য রয়েছে। তাদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট হলো চাঁপাইনবাবগঞ্জের তেলকুপি, সোনামসজিদ এবং শিবগঞ্জ পয়েন্ট। অস্ত্র ব্যবসায় সক্রিয় রয়েছেন তেলকুপির সোহেল, লম্বু সোহেল, কামাল। শিবগঞ্জের টিপু সোনামসজিদের আমীর ও রফিক।  র‌্যাব-৫-এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল রিয়াজ শাহরিয়ার জানান, কখনো নানা ছদ্মবেশে, আবার কখনো অভিনব কৌশলে অবৈধ অস্ত্র দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিক্রি করছে অস্ত্র কারবারিরা। এক্ষেত্রে দেশে তৈরি ওয়ান শুটারগান বিক্রি হচ্ছে ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা, আর বিদেশি পিস্তল বিক্রি হচ্ছে ৮০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকায়। জানা গেছে, যশোরের বেনাপোলের বিশু মেম্বার ও আরমান রহস্যজনকভাবে সবকিছুকে ম্যানেজ করেই সক্রিয় রয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। সেভেন পয়েন্ট সিক্স ফাইভ ও নাইন এমএম পিস্তল বেশি ঢুকছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে। আর পয়েন্ট টু-টু বোরের রিভলবার আসছে সিলেটের কানাইঘাট সীমান্ত ব্যবহার করে। কুমিল্লা, যশোরের বেনাপোল ও হিলি সীমান্ত হয়েও নানা ধরনের অস্ত্র ঢুকছে দেশে। আখাউড়া সীমান্তে অস্ত্র কারবারের সঙ্গে জড়িত স্থানীয় সরকারের একজন জনপ্রতিনিধি। দীর্ঘদিন ধরে সন্দীপের হাতিয়া এলাকায় নদীপথে বিভিন্ন ছোট বড় ট্রলার থেকে আনলোড হয় অবৈধ অস্ত্র। চকরিয়া, কক্সবাজারের বহির্নোঙরে থাকা জাহাজ থেকে আনলোড হওয়া এসব অস্ত্র ছোট বড় লাইটার জাহাজ এবং ট্রলারে করে নিয়ে যাওয়া হয় হাতিয়ায়। মোহাম্মদ আলী নামের সেই ব্যক্তির তত্ত্বাবধানে দীর্ঘদিন ধরে অস্ত্র, মাদকসহ নানা অবৈধ পণ্য আনলোড হয় হাতিয়ায়। পরবর্তীতে নানা কৌশলে এগুলো রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় পৌঁছানো হয়। মোহাম্মদ আলী একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার তালিকাভুক্ত। সিলেটের কানাইঘাটের সীমান্ত দিয়ে মাঝেমাঝেই আসছে নাইন এমএম। দিনাজপুরের হিলিতে প্রশাসনের দুর্নীতিগ্রস্ত সদস্যদের ম্যানেজ করেই সক্রিয় রয়েছেন রনি, জাভেদ এবং শাহাবুদ্দীন। রাঙামাটির পার্বত্য এলাকা দিয়ে দেদার ঢুকছে ছোট, বড় অস্ত্র। চাহিদা অনুযায়ী নিয়মিতভাবেই অস্ত্রের জোগান দিয়ে আসছেন লালটন, পাংকুয়া, এসকে, অবনী নামের অস্ত্র ব্যবসায়ীরা।  ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ সূত্র বলছে, সম্প্রতি মাদকসহ মো. আনিস উদ্দিনকে মগবাজার থেকে আটকের পর একটি অডিও রেকর্ড পায় ডিবি। যেখানে বলতে শোনা যায়, ‘একটি মাল রেখে আসিছ।’ মাদকের অভিযান পরিচালনার সময় অস্ত্র কারবারিদের সন্ধান পাওয়া যায়। এ চক্রটির দলনেতা টেকনাফের মুন্না ওরফে মামা এবং পাবনার আরিফ বঙ্গাল। তারা মাদকের সঙ্গে অস্ত্রের চালান পাঠায়। অস্ত্রের অর্ডার নেয় বিভিন্ন অ্যাপসে। এসব অস্ত্রের দামও সস্তা। ক্ষেত্রবিশেষ ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকার মধ্যে এসব অস্ত্র বেচাকেনা হয়। জানা গেছে, গত ২১ জুলাই রাতে কক্সবাজার রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে একটি ৭ দশমিক ৬৫ এমএম পিস্তল, একটি বিদেশি রিভলবার, একটি শটগান, চারটি দেশি তৈরি এলজি, তিনটি দেশি রামদা ও গুলিসহ আরসার ছয়জনকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। এর আগে গত ৯ জুলাই গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলায় পাইপগানসহ জহিরুল ইসলাম ওরফে লিটন নামের এক স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতাকে গ্রেফতার করে। গত ২৩ জুন রাজধানীর লালবাগ এলাকা থেকে একটি দেশি পিস্তল ও একটি ম্যাগাজিনসহ রাকেশ আহম্মেদ নামের একজনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। গত ১৯ জুন সাতক্ষীরার তালা উপজেলায় বিদেশি পিস্তল ও ৭ রাউন্ড গুলিসহ ফিরোজ সানা (৪০) নামের একজনকে আটক করে। গত ১৫ মে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকা থেকে একটি বিদেশি পিস্তল, একটি ম্যাগাজিন, ৩ রাউন্ড গুলিসহ ইয়াসিন উদ্দিন লিটন ওরফে শুটার লিটনকে (৩৬) গ্রেফতার করেছে র‌্যাব-১০। উল্লিখিত অস্ত্রের বাইরেও এভাবে প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে আরও অনেক দেশি-বিদেশি অস্ত্র উদ্ধারসহ জড়িতদের গ্রেফতারের তথ্য জানা যায়। দীর্ঘদিন ধরেই অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার নিয়ে কাজ করেন ঢাকা মহানগর পুলিশের কয়েককজন কর্মকর্তা। এ প্রতিবেদককে তারা বলছেন, কিছু প্রযুক্তিগত সুবিধা আগের মতো ব্যবহার করতে না পারার কারণে এমনটাই হচ্ছে গত এক বছর ধরে। এ কারণে অস্ত্র উদ্ধারে সাফল্য বাহিনীগুলোতে কমে আসছে। আমরা ব্যবসায়ীদের আগের মতো মনিটরিং করতে পারছি না। হয়তো বিষয়টির সুরাহা দ্রুতই হবে বলে আমরা বিশ্বাস করি। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক নূর খান লিটন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, অবৈধ অস্ত্রের এখনই লাগাম টানা উচিত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর। এক্ষেত্রে অস্ত্র ব্যবসায়ী কিংবা ব্যবহারকারী কোন রাজনৈতিক দলের তা বিবেচনায় নেওয়া ঠিক হবে না। একাধিক সূত্র বলছে, অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার অভিযানে গুরুত্বপূর্ণ ২০টি জেলার দিকে বিশেষ নজর দেওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উচ্চ পর্যায়ের একটি সভায়। গত ১৯ ফেব্রুয়ারির আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত মন্ত্রিসভার বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় রাজনৈতিক উত্তাপ-অস্থিরতা ছড়ানোর আগেই টানা অভিযান চালিয়ে লাগাম টানার ব্যাপারে মত দেন বৈঠকে অংশ নেওয়া ব্যক্তিরা। প্রয়োজনে সে জেলাগুলোতে ব্লক রেইড দেওয়া হবে। র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, অস্ত্র, মাদক এবং জঙ্গিবাদের বিষয়ে আমাদের অবস্থান জিরো টলারেন্স। অবৈধ অস্ত্রের বিষয়ে আমরা খুবই সিরিয়াস। এরই মধ্যে অনেক সফলতাও এসেছে।

সর্বশেষ খবর