সোমবার, ৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা
এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে

যানজটের ঢাকায় নতুন অভিজ্ঞতা

শরিফুল ইসলাম সীমান্ত ও আজহারুল ইসলাম

যানজটের ঢাকায় নতুন অভিজ্ঞতা

ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে শুরু হয়েছে যান চলাচল -জয়ীতা রায়

ঘড়ির কাঁটায় ভোর ৬টা। খুলে দেওয়া হলো ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের গেট। শুরু হলো বাধাহীন পথচলা। এক দিন আগেও এয়ারপোর্ট থেকে ফার্মগেট যেতে সময় লাগত এক থেকে দেড় ঘণ্টা। রাজধানীবাসী গতকাল দেখল নতুন এক ঢাকাকে। এক থেকে দেড় ঘণ্টার পথ পাড়ি দিতে তাদের সময় লাগল মাত্র ১০ মিনিট। যানজটে নাকাল ঢাকাবাসীর জন্য এই অভিজ্ঞতা সিন্দাবাদের জাদুর পাটির চেয়ে কোনো অংশেই কম নয়। ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের একাংশ খুলে যাওয়া পথ ধরে যানজটবিহীন ঢাকার স্বপ্নপূরণের পথে আরও এক ধাপ এগিয়ে গেল বাংলাদেশ। শনিবার বিকাল সাড়ে ৩টায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্বোধনের পর গতকাল ভোর ৬টা থেকে শুরু হয় ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে গাড়ি চলাচল। রাত ৩টা থেকেই উৎসুক কিছু যাত্রী গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকেন এক্সপ্রেসওয়েতে ওঠার জন্য। প্রয়োজনের পাশাপাশি অনেকেই এক্সপ্রেসওয়েতে উঠেছেন দেশের প্রথম এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের গতিময় ও আনন্দময় অভিজ্ঞতা নিতে। বনানী থেকে মহাখালীর মূল সড়কে থেমে থেমে যানজট দেখা গেলেও সিগন্যালবিহীন এক্সপ্রেসওয়ে যারা ব্যবহার করেছেন, যানজট এড়িয়ে অল্প সময়ের মধ্যেই তারা পৌঁছাতে পেরেছেন গন্তব্যে। শহরের মাথার ওপর দিয়ে আনন্দময় এই উড়ে চলার অভিজ্ঞতায় যাত্রী ও গাড়িচালকদের চোখেমুখে ছিল উচ্ছ্বাস। কথা হয় বেসরকারি এক প্রতিষ্ঠানের গাড়িচালক আবদুর রবের সঙ্গে। সারা দিন অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অফিস থেকে বাসা, বাসা থেকে অফিসে পৌঁছে দিতে বেশ কয়েকবার এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে উঠেছেন তিনি। বাংলাদেশ প্রতিদিনকে আবদুর রব বলেন, ‘জ্যামের শহর ঢাকায় আজকের মতো স্বস্তিতে এর আগে আর কখনো গাড়ি চালাইনি। বনানী, মহাখালীর মতো ব্যস্ততম সড়কের যানজট এড়িয়ে দেড় থেকে দুই ঘণ্টার পথ যে মাত্র ১০ মিনিটে পাড়ি দিতে পারব এটিও কখনো চিন্তা করিনি।’ এক্সপ্রেসওয়েতে ওঠা বেশির ভাগ যানই ছিল মাইক্রো ও প্রাইভেট কার। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দেখা মেলে কয়েকটি বাসেরও, যার মধ্যে ছিল বিআরটিসির যাত্রীবাহী বাস আর সরকারি-বেসরকারি অফিস কর্মচারীদের বহনকারী কিছু বাস। এ ছাড়া বেশ কিছু কাভার্ড ভ্যানও লক্ষ্য করা গেছে। বিমানবন্দর এলাকা থেকে এক্সপ্রেসওয়েতে ওঠা প্রাইভেট কারের চালক নোমান বলেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ। এক্সপ্রেসওয়েতে গাড়ি চালানোর অভিজ্ঞতা অত্যন্ত আনন্দময় ছিল। যেখানে অন্য সময় দুই থেকে আড়াই ঘণ্টাও যানজটে বসে থাকতে হতো, সেখানে মাত্র ১৪ মিনিটে বিমানবন্দর থেকে ফার্মগেট এসেছি।’ অতিসম্প্রতি বিশ্বব্যাংক প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, শুধু যানজটের কারণে প্রতিদিন ৩২ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হয় ঢাকা শহরে। যানজট খেয়ে ফেলে দেশের জিডিপির একটি বড় অংশ। কমে আসে মাথাপিছু আয়। বিভিন্ন জরিপে দেখা গেছে, ট্রাফিক জ্যামের কারণে প্রতিদিন গড় ক্ষতি ৩০০-৩৫০ কোটি টাকা। গত এক যুগে ঢাকার গড় ট্রাফিক স্পিড ঘণ্টায় ২১ কিমি থেকে নেমে ৫ কিমিতে দাঁড়িয়েছে এবং এই গতি আরও নেমে যাওয়ার কথা বলছিলেন বিশেষজ্ঞরা। তবে একের পর এক মেগা প্রকল্পের দুয়ার খোলার মিছিলে সদ্য যোগ হওয়া ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের একাংশের বদৌলতে সে সমস্যার কিছুটা হলেও সমাধান মিলছে এটি ভেবে আনন্দিত ঢাকাবাসী। এক্সপ্রেসওয়ের বাকি অংশ তেজগাঁও থেকে কুতুবখালীর জন্য অপেক্ষা করতে হবে আগামী বছরের জুন পর্যন্ত। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কাছে কাওলা থেকে তেজগাঁও, মগবাজার, কমলাপুর হয়ে যাত্রাবাড়ীর কাছে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুতুবখালীতে গিয়ে শেষ হবে এটি। এক্সপ্রেসওয়ের পুরো সুবিধা যুক্ত হলে আরও গতিময় হয়ে উঠবে রাজধানীবাসীর জীবন। কথা হয় ডিএমপির তেজগাঁও ট্রাফিক জোনের ডেপুটি পুলিশ কমিশনার মোশতাক আহমেদের সঙ্গে। বাংলাদেশ প্রতিদিনকে তিনি বলেন, ‘এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নিঃসন্দেহে যুগান্তকারী পদক্ষেপ। এয়ারপোর্ট থেকে সরাসরি ফার্মগেট এবং এর মধ্যবর্তী স্থানগুলোতে কোনো ধরনের বিঘ্ন ছাড়া যাতায়াত করতে পারাটা বাংলাদেশের যে কোনো নাগরিকের জন্য, বিশেষ করে ঢাকাবাসীর জন্য অত্যন্ত আনন্দদায়ক ঘটনা। এক্সপ্রেসওয়ে ব্যবহার করায় নিচের মূল সড়কের ওপর থেকে যানজট কমতে শুরু করবে এটাই আমাদের প্রত্যাশা।’ এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের বিজয় সরণি, বনানী ও মহাখালীর র‌্যাম্পগুলোর মুখে যানজট নিয়ে প্রশ্ন করা হলে মোশতাক আহমেদ বলেন, ‘ঢাকা মহানগরে ধারণক্ষমতার চেয়ে অতিরিক্ত যানবাহন আছে। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের আশপাশের যেসব ব্যবসায়িক জোন রয়েছে সেখানে যানবাহনের আধিক্য সব সময়ই বেশি থাকে। এসব এলাকায় যে র‌্যাম্পগুলো যুক্ত হয়েছে সেগুলোর সামনে ট্রাফিক পুলিশের ভালো ব্যবস্থাপনা আমরা রাখব। ইতোমধ্যে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের সুবিধা বৃদ্ধি-সংক্রান্ত কিছু কারিগরি পরিবর্তনের জন্য আমাদের পর্যবেক্ষণসমূহ সেতু কর্তৃপক্ষ ও সিটি করপোরেশনকে জানিয়েছি। এ লক্ষ্যে কয়েক দিনের মধ্যেই আমরা কিছু পোস্ট কো-অর্ডিনেশনাল মিটিং করব। এ ছাড়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে থেকে সর্বোচ্চ সেবা আদায়ের জন্য আমাদের ট্রাফিক পুলিশের কোনো পুনর্বিন্যাসের প্রয়োজন হলে সেটিও আমরা করব। আগামীতে এক্সপ্রেসওয়ে ঘিরে যানবাহনের আধিক্য বাড়বে সেটি নিয়েও আমাদের পরিকল্পনা রয়েছে।’

এক্সপ্রেসওয়েতে ১৪ ঘণ্টায় ১২ লাখ টাকা টোল আদায় : ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের প্রকল্প পরিচালক এ এইচ এম এস আকতার জানান, রবিবার সকাল ৬টা থেকে চালু হয়েছে ঢাকায় এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। চালু হওয়ার পর থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত টোল আদায় হয়েছে ১১ লাখ ৯৭ হাজার ৪০ টাকা। ১৪ ঘণ্টায় মোট গাড়ি চলেছে ১৪ হাজার ৭২৭টি। এর মধ্যে বিমানবন্দর থেকে বনানী ও মহাখালী  গেছে ৮ হাজার ৪২৭টি গাড়ি। কুড়িল থেকে বনানী ও মহাখালী গেছে ১ হাজার ৮৬৪টি গাড়ি। বনানী থেকে কুড়িল গেছে ১ হাজার ৭২৩টি গাড়ি। তেজগাঁও থেকে মহাখালী, কুড়িল, বনানী ও বিমানবন্দর গেছে ২ হাজার ৭১৩টি গাড়ি।

সর্বশেষ খবর