মঙ্গলবার, ৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

ভেজাল ওষুধে রোগীর সর্বনাশ

জয়শ্রী ভাদুড়ী

ভেজাল ওষুধে রোগীর সর্বনাশ

কিশোরগঞ্জের বিসিক শিল্পনগরীতে কারখানা করে ওষুধ তৈরি করছে ইস্ট বেঙ্গল ইউনানী। এখানে নিয়মিত আয়ুর্বেদিক ওষুধ উৎপাদন করার জন্য ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর অনুমোদন দেয়। কিন্তু আয়ুর্বেদিক ওষুধের আড়ালে এই কারখানায় দিনের পর দিন তৈরি হতে থাকে গ্যাস্ট্রিকসহ বিভিন্ন রোগের নকল ওষুধ। খবর পেয়ে ঔষধ প্রশাসন অধিদফতর অভিযান চালালে পালিয়ে যায় ভেজাল ওষুধ চক্রে জড়িতরা। কারখানাটি সিলগালা করেছে অধিদফতর।

ইউনানী ওষুধ উৎপাদনের জন্য লাইসেন্স রয়েছে ২৮৪টি প্রতিষ্ঠানের। নীতিমালা অনুসরণ করে ওষুধ উৎপাদনের কথা তাদের। তা না করে বৈধ কারখানায় নকল ওষুধ উৎপাদন করছে প্রতিষ্ঠানগুলোর কয়েকটি। এসব কারখানায় কিডনি, ক্যান্সার থেকে শুরু করে সব ধরনের দুরারোগ্য ব্যাধির নকল ওষুধ তৈরি হচ্ছে। আয়ুর্বেদিক কারখানার অনুমোদন থাকায় সন্দেহ করছে না প্রশাসন কিংবা সাধারণ মানুষ। জনবল সংকটের কারণে এসব কারখানায় নিয়মিত তদারকি করতে পারছে না ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহযোগিতায় মাঝে মাঝে পরিচালিত অভিযানে এসব অপরাধীকে গ্রেফতার করা হচ্ছে। কিন্তু নকল ওষুধের সিন্ডিকেটের জোরে অল্প সময়ের মধ্যে জামিনে বের হয়ে আবারও একই অপরাধে জড়াচ্ছে তারা। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘রোগ প্রতিরোধ করে জীবন বাঁচাতে মানুষ ওষুধ সেবন করে। কিন্তু জীবনরক্ষাকারী ওষুধেও ভেজাল। ভেজাল ওষুধ তৈরি এবং বাজারজাতকরণের সঙ্গে জড়িতদের বিষয়ে আমরা তথ্য সংগ্রহ করছি। এই চক্রকে ধরতে আমাদের নিয়মিত অভিযান অব্যাহত আছে।’ ঔষধ প্রশাসন অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, নকল, ভেজাল, নিম্নমানের এবং মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ বিক্রির ঘটনায় ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে এ বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ২৩৬টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। ১ হাজার ৯৪টি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে ১ কোটি ৩৬ লাখ ৪৩ হাজার ৯০০ টাকা জরিমানা আদায় করা হয়েছে।

এ ব্যাপারে ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরের উপ-পরিচালক ও আইন কর্মকর্তা মো. নুরুল আলম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘গত বছর কিশোরগঞ্জের অভিযানে নেতৃত্ব দিয়ে আমি ভেজাল ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান সিলগালা করেছিলাম। এরা ঠাকুরগাঁও, ঝিনাইদহসহ বিভিন্ন এলাকায় এসব ভেজাল ওষুধ সরবরাহ করত। বিদ্যমান ওষুধ আইনে ওষুধ সম্পর্কিত সব অপরাধ জামিনযোগ্য হওয়ায় অপরাধীরা সহজেই জামিন পেত। এখন প্রস্তাবিত ওষুধ ও কসমেটিকস আইন ২০২৩ এ নকল, ভেজাল ওষুধ উৎপাদন বিক্রি বাজারজাত করাসহ কিছু গুরুতর অপরাধকে অজামিনযোগ্য করার প্রস্তাব করা হয়েছে। আইন বাস্তবায়ন হলে নকল ভেজাল ওষুধ ব্যবসায় জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ সহজ হবে।’

ডিবি সূত্রে জানা যায়, হুবহু ‘আসল’ মোড়কে গ্যাস্ট্রিক, ক্যান্সার, ডায়াবেটিস, কিডনি রোগসহ বিভিন্ন জটিল রোগের নকল ওষুধ বাজারে ছাড়ছে সংঘবদ্ধ চক্র। যা দেখে ভোক্তাদের আসল-নকল পরখ করা অনেকটাই দুঃসাধ্য। এ চক্রকে সহযোগিতা করছে অতি মুনাফালোভী কিছু ফার্মেসি মালিক। স্বনামধন্য এবং পরিচিত ওষুধ কোম্পানির ওষুধগুলোই নকল করা হয় বেশি। সেগুলো দেখতে হুবহু আসল ওষুধের মতোই। নকল ওষুধগুলো সাধারণত রুগ্ন কারখানা বা ইউনানী-হারবালের মতো কারখানাগুলোতে উৎপন্ন করা হয়। রাতের শিফটে এসব নকল ওষুধ উৎপাদন করে থাকে এই ভেজাল সিন্ডিকেট চক্র। কারখানা থেকে কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে ঢাকায় চক্রের তালিকাভুক্ত কিছু ফার্মেসি চক্রের কাছে পৌঁছানো হয় এসব ভেজাল ওষুধ। মিটফোর্ড কেন্দ্রিক কিছু অসাধু ফার্মেসি ব্যবসায়ীরা এই চক্রের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। এখান থেকে পাইকারিভাবে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে এ ভেজাল ওষুধ। গ্রামেগঞ্জে ক্রেতার হাতে পৌঁছে যাচ্ছে প্রাণঘাতী এসব নকল ওষুধ। বাংলাদেশ কেমিস্টস অ্যান্ড ড্রাগিস্ট সমিতির পরিচালক জাকির হোসেন রনি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ব্যবসায়ীরা কোম্পানি থেকে ওষুধ কিনে যে দামে বিক্রি করে, নকল ওষুধ তার চেয়ে অনেক কমদামে বিক্রি করা হয়। এসব অসাধু ব্যবসায়ীর কারণে অন্য ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। সরকার রাজস্ব হারাচ্ছে এবং মানুষের জীবন ঝুঁকিতে পড়ছে। গুটিকয়েক নকল ব্যবসায়ীর জন্য দেশের সব ওষুধ ব্যবসায়ীকে এ অপকর্মের দায় নিতে হচ্ছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘অ্যান্টিবায়োটিক, গ্যাস্ট্রিক এবং মন্টিলুকাস ধরনের ওষুধ বেশি নকল হচ্ছে। মূলত ১৯৮৫ সালের দিকে নকল ওষুধ প্রচলন শুরু হয়। কিন্তু এখন নকল ওষুধ বাজারজাতকরা আরও সুবিধা হয়েছে। একটি জেলা থেকে নকল ওষুধ উৎপাদন করে একটি নির্দিষ্ট দাম ধরে ট্রান্সপোর্ট এজেন্সিতে ঢাকার কোনো এক ব্যবসায়ীর নামে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। অসাধু ব্যবসায়ীরা নকল ওষুধ কিনে গ্রামে উপজেলা পর্যায়ে খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে দেয়। সেখানে এই নকল ওষুধগুলোই কোম্পানির আসল ওষুধের দামে বিক্রি করা হয়। নকল ওষুধগুলো তিন-চার হাত বদল হওয়ায় একটি সিন্ডিকেট তাদের উদ্দেশ্য হাসিল করে নিচ্ছে।’ বিশ্ব বাজারে ১৪৭টি দেশে রপ্তানি হচ্ছে বাংলাদেশের ওষুধ। ভেজাল এবং নকল ওষুধ এই সুনাম এবং আস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। মফস্বলের ওষুধ ফার্মেসিগুলোকে টার্গেট করে একটি অসাধু সংঘবদ্ধ চক্র সারা দেশে ভেজাল ও নকল ওষুধ ছড়িয়ে দিচ্ছে। মাদকের চেয়েও ভয়াবহ ক্ষতি করছে এ ভেজাল ওষুধ। তবে অভিযান পরিচালনা করা হলেও যেসব ওষুধ কোম্পানির ওষুধ নকল হয় তারা সেরকম কোনো আইনি ব্যবস্থা নেয় না।

সর্বশেষ খবর